সারাদেশে শীতের দাপট ফের বাড়ছে
সারাদেশে শীতের দাপট ফের বাড়ছে। বর্তমানে দেশের পাঁচ জেলা তথা রাজশাহী, পাবনা, নওগাঁ, পঞ্চগড় ও চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আগামী তিনদিনে তা আরও বিস্তৃত হতে পারে। ফলে রাতের তাপমাত্রা কমে যেতে পারে। এতে বাড়তে পারে শীতের তীব্রতা। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে আগামী ৭২ ঘণ্টার পূর্বাভাসে এ কথা বলা হয়েছে।
পূর্বাভাসে উল্লেখ করা হয়, এ সময় সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা ২ থেকে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। পাশাপাশি অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারাদেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকতে পারে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘এ সময় দিন ও রাতের তাপমাত্রা দুই থেকে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কমতে পারে, যা পরবর্তী দুই-তিনদিন পর্যন্ত চলতে পারে। সব মিলিয়ে আগামী ১৪ জানুয়ারির মধ্যে দেশজুড়ে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার একটি শৈত্যপ্রবাহ বইতে পারে। তবে সেটি বেশিদিন স্থায়ী হবে না। খুব স্বল্প সময়ের জন্য থাকতে পারে।
তাপমাত্রা সাধারণত ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়। ৬ থেকে ৮ ডিগ্রিতে নেমে এলে তা মাঝারি এবং ৬ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামলে তাকে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলা হয়।
১৪ জানুয়ারির পরের সপ্তাহের শেষের দিকে শীতের তীব্রতা কিছুটা কমে আসবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর কয়েকদিন পর জানুয়ারির শেষ দশ দিনে আরও এক থেকে দুটি মৃদু থেকে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ আসতে পারে। ওই সময় রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট, যশোর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গায় শীত বেশি অনুভূত হতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, উপমহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। মৌসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে এবং এর বর্ধিতাংশ উত্তর বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে।
হঠাৎ কুয়াশা বাড়ছে কেন ॥ যেসব কারণে বাংলাদেশে এ বছর শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে, সেগুলোর একটি হচ্ছে দীর্ঘ সময় ধরে কুয়াশা পড়া। বুধবার প্রায় সারাদিনই ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় কুয়াশা পড়তে দেখা গেছে। হঠাৎ এই কুয়াশা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বায়ুদূষণকে দায়ী করছেন আবহাওয়াবিদরা। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের সূচকে ঢাকা এখন বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরের তালিকায় রয়েছে।
যানবাহন, ইটভাঁটি ও শিল্প-কারখানার দূষিত ধোঁয়ার পাশাপাশি নির্মাণকাজের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ নানান কারণে সারাদেশেই আগের চেয়ে বায়ুদূষণ বেড়েছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে। এর মধ্যেই আবার জানুয়ারিতে দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে দূষিত বায়ু প্রবেশের পরিমাণ বেড়েছে বলে জানাচ্ছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘দূষিত এই বাতাসে প্রচুর পরিমাণে ধূলিকণা মিশে রয়েছে, যা মেঘ ও কুয়াশা তৈরিতে নিয়ামক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে, দীর্ঘ সময়ের কুয়াশার কারণে সূর্যের কিরণকাল কমে এসেছে। অর্থাৎ সূর্যের আলো বেশিক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাভাবিক সময়ে সূর্যের কিরণকাল আট থেকে ১২ ঘণ্টা হলেও এখন কুয়াশার কারণে সেটি কমে আসছে। এতে ভূপৃষ্ঠ উত্তপ্ত হতে না পারায় দিনের ও রাতের তাপমাত্রার পার্থক্য অনেকটাই কমে গেছে। এর ফলে শীত বেশি অনুভূত হচ্ছে।
নীলফামারী ॥ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে এলেই নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলের অন্যান্য এলাকায় উত্তুরে বরফশীতল বাতাস ও কনকনে শীতের ধাক্কা শুরু হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার আকাশ ছিল আংশিক মেঘলা। তার সঙ্গে হালকা রোদেরও দেখা মিলেছে। তার পরও কনকনে ঠান্ডার প্রকোপ কমেনি। কারণ হিসেবে আবহাওয়াবিদরা বলেছেন সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পতনে ঠান্ডার প্রকোপ বেশি অনুভূত হচ্ছে।
রংপুর বিভাগীয় আবহাওয়া অফিসের সহকারী পরিচালক প্রকৌশলী মোস্তাফিজার রহমান জানান, গেল বছরের ডিসেম্বর থেকে চলতি জানুয়ারি মাসের এ পর্যন্ত এই অঞ্চলের সর্বনি¤œ তাপমাত্রার চেয়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড পরিমাণে কমেছে। কয়দিন আগেও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি ও সর্বনি¤œ ১২ ডিগ্রিতে অবস্থান করায় শীতের কনকনে ভাব ছিল না। তার মতে বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার এক ধাক্কায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রার আট ডিগ্রি সেলসিয়াসের পতন ঘটে।
কুড়িগ্রাম ॥ হিমালয়ের বরফ ছোঁয়া কনকনে হিমেল বাতাসে কাহিল হয়ে পড়েছে এ জনপদের মানুষ। মানুষর পাশাপাশি গবাদি পশু-পাখি চরম কষ্টে পড়েছে। বিশেষ করে চর-দ্বীপ চর এলাকার কয়েক লাখ মানুষ চরম কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। ঠান্ডার মধ্যেও এ অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষ আলু খেতে কাজ করছে। শহরের মানুষের চলাচল কমে গেছে। শীতের কারণে রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। শিশু ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঠাকুরগাঁও ॥ পীরগঞ্জ পৌর এলাকাসহ ১০টি ইউনিয়নে শীতজনিত কারণে ও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার বাড়ছে। প্রচ- শীত, ঘন কুয়াশা, শৈত্য প্রবাহের কারণে বয়স্ক নারী-পুরুষ ও শিশুদের রোগ বালাই বাড়ছে। গত ১০ দিনে এ উপজেলায় ২৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বিশেষ করে বয়স্ক ও শিশুরা শীতজনিত কারণে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
পীরগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার সংকটের কারণে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। মুমূর্ষু রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হলে তাদের দ্রুত দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল অথবা রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করে থাকে কর্তৃপক্ষ।
ঝালকাঠি ॥ কনকনে শীত, ঘন কুয়াশা, বৈরী আবহাওয়া আর শ্রমিক এবং সেচ সংকটে ঝালকাঠিতে বোরো আবাদ ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যে সার, কীটনাশক ও উপকারণের মূল্য বৃদ্ধিতে হতাশায় ভুগছেন চাষিরা। এ অবস্থায় বোরো আবাদের লক্ষমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ঝালকাঠি জেলায় চলতি মৌসুমে ১৩ হাজার ৮শ’ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ।
ইতোমধ্যে ৭৬৫ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করেন কৃষকরা। শুরুতেই সার, কীটনাশক এবং বীজসহ উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, শীত এবং কুয়াশার কবল থেকে বীজতলা রক্ষার জন্য কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
মাগুরা ॥ শীতের তীব্রতা বেড়েছে। ফলে দরিদ্র মানুষেরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বৃদ্ধ ও শিশুরা ঠান্ডায় অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হাসপাতার ও চিকিৎসকের চেম্বারে রোগীদের সংখ্যা বেড়েছে। শীত তীব্রতা বাড়ায় পুরনো শীতবস্ত্রের বাজারে ক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে । শহরের প্রধান ডাকঘরের সামনে ও মাতৃসদন সড়কে বসেছে পুরনো শীতবস্ত্রের বাজার। ক্রেতারা শীত নিবারণ করার জন্য এখান থেকে তাদের পছন্দ মতো শীতবস্ত্র ক্রয় করছেন । জেলোরা পানিতে নামতে পারছে না মাছ ধরার জন্য। কৃষক ভোরে মাঠে কাজতে পারছে না।
চুয়াডাঙ্গা ॥ বুধবার রাত থেকে তাপমাত্রা কমতে শুরু করেছে। কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রৌদ্রময় আবহাওয়া দেখা দিয়েছে। কিন্তু হিমেল হাওয়ায় জনজীবনে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। গত একদিনের ব্যবধানে চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা কমেছে ৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ কারণেই জনজীবনে স্থবিরতা বিরাজ করছে। শীতের তীব্রতায় জনজীবন আড়ষ্ট হয়ে গেছে।
বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় এ জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৫ শতাংশ। এদিন সকাল ৬টায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময় বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৫ শতাংশ। তাপমাত্রা আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
পঞ্চগড় ॥ ফের শৈত্যপ্রবাহের কবলে পঞ্চগড়ের মানুষ। সকাল থেকে ঝলমলে রোদ উঠলেও দুপুরের মধ্যে তা মিলিয়ে যায়। শুরু হয় অব্যাহত পাহাড়ি হিম বাতাস। তাপমাত্রা ৯ ডিগ্রির ঘরে নেমে আসে। বুধবার ছিল ১২ ডিগ্রির ঘরে তাপমাত্রা। একদিনের ব্যবধানে ৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা নেমে আসায় এ জেলার ওপর দিয়ে ফের বয়ে যাচ্ছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ।
বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া অফিস বলছে, জানুয়ারি মাস জুড়ে কয়েকটা শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাবে এ জেলার ওপর দিয়ে। একইসঙ্গে বাড়বে শীত।
নওগাঁ ॥ জানুয়ারির প্রথমে তুলনামূলক তাপমাত্রা কিছুটা বেশি থাকলেও এক দিনের ব্যবধানে ৬ দশমিক ৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমে ফের মৃদু শৈত্যপ্রবাহের কবলে পড়েছে উত্তরের জেলা নওগাঁ। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় এই জেলায় সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা চলতি বছর এখন পর্যন্ত এই জেলার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা। এর আগে বুধবার রেকর্ড করা হয়েছে ১৫ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সূর্যের দেখা মিললেও মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে চলায় কনকনে শীত অনুভূত হয়। দিনের বেশির ভাগ সময় সূর্যের দেখা থাকলেও দিনভর হিমেল বাতাসে ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক কাজকর্ম। সূর্য পশ্চিম দিকে গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে শীত। একইসঙ্গে বয়ে চলে হিমেল বাতাস।
কুমিল্লা ॥ নাঙ্গলকোটে তীব্র শীতে ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। যতই শীত বাড়ছে মৌসুমি রোগবালাই ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবারে পৌষের শুরুতে বইছে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ যারফলে শীতে বেশি ভাগ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধ বয়সী লোক গুলো। ঠান্ডাজনিত রোগে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে চিকিৎসকরা।
সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বেশিভাগ শিশু ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রয়েছে । শীতের হিমেল হাওয়া বৃদ্ধ বয়সের মানুষগুলো বেশি কষ্ট পড়েছে। নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায় ২ ঘণ্টার মধ্যে ডায়রিয়া জরুরি বিভাগে ১৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।