বেড়েছে তাপমাত্রা, ফিরেছে স্বস্তি
হিম শীতল বাতাসে তাপমাত্রা কমছিল ক্রমাগত। মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বইছিল দেশের অন্তত ১৩টি জেলায়। ঠান্ডায় জবুথবু অবস্থা। কুয়াশায় কয়েকদিন ঢাকা থাকার পর দেশের কোথাও কোথাও দেখা মিলেছে সূর্যের। ফলে, ওইসব অঞ্চলে তাপমাত্রা কিছুটা বেড়ে ফিরেছে স্বস্তি। আবার যেসব জেলায় সূর্যের আলো কুয়াশা ভেদ করতে পারেনি সেখানে শীতের প্রকোপ অনুভূত হচ্ছে বেশি। খবর স্টাফ রিপোর্টার ও নিজস্ব সংবাদদাতাদের।
দুইদিন ধরে নীলফামারী জেলায় সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সূর্যের দেখা মিলছে। তবে, উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে বয়ে আসা কনকনে হিমশীতল ঠান্ডা বাতাসের কারণে সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে ওঠা-নামা করছে। দিনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় শীত কমেছে উত্তরাঞ্চলে। তবে, সন্ধ্যা নামতেই ফিরে আসে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে।
শনিবার নীলফামারীর দুটি আবহাওয়া অফিস জানায়, সৈয়দপুর উপজেলায় সর্বনি¤œ ১১.৮ ও সর্বোচ্চ ২৫.২ এবং ডিমলা উপজেলায় সর্বনি¤œ ১২ ও সর্বোচ্চ ২৫.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সৈয়দপুর আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লোকমান হাকিম।
এদিকে, পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে কনকনে ঠান্ডা ও হালকা কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে চারদিক। রোদের দেখা মিললেও তেমন উত্তাপ নেই। দিনমজুর, রিক্সাচালক ও নি¤œ আয়ের মানুষ শীতের তীব্রতায় কাজে যেতে পারছেন না। ফলে, আয় কমেছে তাদের। কিন্তু জীবিকার তাগিদে হাড় কাঁপা কনকনে শীতের মধ্যেই গায়ে শীতের কাপড় পড়ে কাজে বের হতে দেখা গেছে কর্মজীবী মানুষকে। যেখানে কৃষকরা ভোর থেকে মাঠে কাজ করতে নেমে পড়তেন, সেখানে সকাল ৯ টারও পর কাজে নামছেন তারা।
পঞ্চগড় ॥ ঝলমলে রোদেও কনকনে ঠান্ডা। তাপমাত্রার পারদ ৮ থেকে ৯ ডিগ্রির ঘরে ওঠানামা করছে। টানা দুদিন ধরে পঞ্চগড়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। শনিবার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুক্রবার সর্বনি¤œ তাপমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে, সকাল থেকে কুয়াশা থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা মিলছে সূর্যের। ঝলমলে রোদ ওঠায় শীতের তীব্রতা কিছুটা কমলেও দুপুরের পর রোদ থাকলেও শুরু হচ্ছে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ। এরপর রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ঠান্ডা বাতাস অব্যাহত থাকায় কনকনে শীত অনুভূত হচ্ছে।
আবহাওয়া অফিস বলছে, বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় জেলার তেঁতুলিয়ায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শুক্রবার রেকর্ড করা হয় ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং শনিবার কিছুটা তাপমাত্রা বাড়লে ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিতেন্দ্রনাথ রায় বলেন, টানা দুদিন ধরে জেলার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বইছে। আকাশে মেঘ না থাকায় শনিবার কুয়াশার পরিমাণ ছিল কম। দেখা মিলেছে সূর্যেরও। জানুয়ারি মাস জুড়ে আরও তিনটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকার পাশাপাশি শীতের তীব্রতা বাড়বে বলেও জানান তিনি।
কুড়িগ্রাম ॥ উত্তরের সীমান্ত ঘেঁষা জেলা কুড়িগ্রামে ঘনকুয়াশার সঙ্গে হাড় কাঁপানো শীতে কাহিল হয়ে পড়েছে এ জনপদের মানুষ। হিমালয়ের ঠান্ডা বাতাস বইছে। কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে জনপদ। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত শীতে কাবু গ্রামীণ জীবন। চরম বিপাকে পড়েছেন খেটে-খাওয়া ও নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ। এছাড়া কুয়াশায় দুর্ঘটনা এড়াতে যানবাহনগুলোকে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলতে হচ্ছে সড়ক পথে।
শনিবার জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস- জানিয়েছেন রাজারহাট আবহাওয়া অফিস কর্তৃপক্ষ। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ঠান্ডা বাতাস বইছে। ভ্যাানচালক মো. দারগ আলী বলেন, সকালে কুয়াশার কারণে কাজে যেতে পারি না। ঠান্ডায় অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। অটোরিক্সাচালক আবদুস সাত্তার বলেন, হেডলাইট জ্বালিয়ে রাস্তায় সাবধানে চলাচল করতে হচ্ছে। কুয়াশায় বেশি দূর দেখা যায় না।
সদরের ধরলারপাড় এলাকার শিক্ষক আব্দুল হাই জানান, কনকনে ঠান্ডা কাঁপছে চরাঞ্চলের মানুষ। অনেকেই শীত নিবারণ করছেন খড়কুটো জ্বালিয়ে। জীবিকার তাগিদে শীত উপেক্ষা করে ক্ষেতমজুররা জমিতে ধান লাগানোর কাজ করছেন।
যাত্রাপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল গফুর জানান, তার ইউনিয়নে অধিকাংশ মানুষই খেটে-খাওয়া দিনমজুর। অনেকেরই শীতবস্ত্র কেনার সামর্থ্য নেই। কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা নি¤œগামী হওয়ায় কাবু হয়ে পড়েছে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় বসবাসকারী মানুষ।
আবহাওয়া কর্মকর্তা সুবল চন্দ্র সরকার জানান, কয়েকদিন ধরে তাপমাত্রা নি¤œগামী। জেলা জুড়ে দুই-তিনটি শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। শনিবার জেলায় ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।
টাঙ্গাইল ॥ টাঙ্গাইলে বেড়েছে শীতের তীব্রতা। সঙ্গে উত্তরের কনকনে হিমেল হাওয়ায় জবুথবু হয়ে পড়েছে জনজীবন। চারদিন ধরে জেলায় সূর্যের দেখা নেই। ফলে, নি¤œ আয়ের ও গৃহহীন ভাসমান মানুষ ও কৃষকরা সমস্যায় পড়েছেন। জেলার পশ্চিমের চরাঞ্চলে খুব সকালে কৃষকদের সবজির খেতে গিয়ে সবজি তুলে শহরের বিভিন্ন পাইকারি বাজারে নিতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। এছাড়া, জেলার পাহাড়ি এলাকায় ঘন কুয়াশা ও হিমেল হাওয়ায় সন্ধ্যার পর স্থানীয় মানুষ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
টাঙ্গাইল আবহাওয়া অফিস জানায়, জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় তাপমাত্রা কমেছে দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শনিবার সকাল ৯টা জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রার পতন অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে জেলা আবহাওয়া অফিস।
স্থানীয়রা জানান, শীতের দাপটে গ্রামাঞ্চলের অনেকেই আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন। তীব্র শীত উপেক্ষা করে কাজের সন্ধানে বের হয়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। তাপমাত্রা কমার চেয়েও বেশি অসুবিধা হচ্ছে হিমশীতল বাতাস। পাশাপাশি ঘন কুয়াশা থাকায় বাতাসে তা গায়ে কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। গত কয়েকদিন থেকে শীতের তীব্রতা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন জেলার নি¤œ আয়ের মানুষজন। খড়-কুঠো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন তারা। সন্ধ্যার পর শহর খালি হয়ে যাচ্ছে। প্রচ- শীত থেকে বাঁচতে সন্ধ্যার পর ঘরে থাকছে শহরের মানুষ। যার প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যেও।
শুকুর আলী টাঙ্গাইল পৌর এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। গ্রামের বাড়ি জেলার মধুপুর উপজেলায় হলেও টাঙ্গাইল শহরের পশ্চিম আকুর-টাকুর পাড়ায় পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন। তিনি জানান, প্রচ- শীতে শহরে মানুষজন বের হয় না। বিশেষ প্রয়োজনে যারা বের হচ্ছেন তারাও শহরে বেশি সময় থাকছে না। ফলে, গত তিন দিনে তার রোজগার প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে। শীতে রিক্সা চালাতেও সমস্যা হচ্ছে। সন্ধ্যার পর রিক্সা না চালিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। কোনো সংগঠনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের শীতের কাপড় কিংবা আর্থিক সহযোগিতা পাননি বলে জানান তিনি।
জেলায় অসহায়, দুস্থ ও দরিদ্র মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণের তথ্য জানতে টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক শরিফা হকের মুঠোফোনে বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ ॥ উপজেলায় বেড়েছে শীতের তীব্রতা। কয়েকদিন ধরে ঘন কুয়াশা আর হিমেল বাতাসে শীত জেঁকে বসেছে। শীতে চরম বিপাকে পড়েছেন খেটে খাওয়া নি¤œ আয়ের মানুষ। বিপণি বিতান থেকে শুরু করে ফুটপাতের গরম কাপড়ের দোকানে ভিড় করছেন ক্রেতারা। স্বল্প আয়ের মানুষ ফুটপাতের পুরাতন কাপড়ের দোকান থেকে সাধ্যমতো কিনছেন শীতবস্ত্র। নাজেহাল অবস্থায় পড়েছেন ছিন্নমূল মানুষ। বিভিন্ন স্থানে মানুষকে রাতের বেলায় খড়, পলিথিন আর লতাপাতায় আগুন জ¦ালিয়ে তাপ নিতে দেখা গেছে।
উপজেলার বেশ কয়েকটি মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, শীত নিবারণের জন্য গরম কাপড় কিনতে দোকানে ভিড় জমিয়েছেন শ্রমজীবীরা। নি¤œ আয়ের মানুষের ভাষ্য, নতুন কাপড়ের অনেক দাম, তা কেনার সামর্থ্য তাদের নেই। এজন্য এসব পুরাতন শীতবস্ত্র কিনছেন।
উল্লাপাড়া গুলিস্তান মার্কেটে শীতবস্ত্র কিনতে আসা রিক্সাচালক ফয়সাল বলেন, আমরা গরীব মানুষ। নতুন কাপড় কেনার মতো টাকা নাই। তাই পুরাতন কাপড়ের দোকান থেকে শীতের পোশাক কিনছি। এখানে ৩০০-৫০০ টাকার মধ্যে ভালো মানের শীতের কাপড় পাওয়া যায়। পুরাতন শীতবস্ত্র বিক্রেতা হেলাল উদ্দিন বলেন, শীত বাড়ায় বিক্রি অনেক বেড়েছে। আমাদের এসব শীতের পোশাকগুলো পুরাতন হলেও মান ভালো। এখানে শুধু গরীব মানুষই আসে না, অনেক ধনী লোকজনও আমাদের কাছ থেকে শীতবস্ত্র কেনেন। স্বল্পমূল্যে ভালো মানের শীতবস্ত্র সরবরাহ করছি আমরা।
বাঁশখালী, চট্টগ্রাম ॥ পৌষের শেষে শীত জেঁকে বসেছে। দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীসহ সাত উপজেলা এর ব্যতিক্রম নয়। ৭২ ঘণ্টা দেখা মেলেনি সূর্যের। ফলে, প্রাত্যহিক কর্মচঞ্চলতায় নেমে এসেছে স্থবিরতা। এদিকে, চট্টগ্রামে শীতের তীব্রতা শুধু প্রকৃতিতে নয়, মানুষের জীবনেও প্রভাব ফেলছে। দরিদ্র মানুষদের জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য সেবায় শীতজনিত বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই অবস্থা আনোয়ারা, চন্দনাইশের।
শনিবার সকাল থেকে উপজলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল ঘুরে ও শীতার্ত মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ এবং চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। কর্মক্ষেত্রে নেমে এসেছে স্থবিরতা। হিমেল হাওয়া ও তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় দিন দিন শীতের অনুভূতি ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে বলে স্থানীয় লোকজন জানায়।
অন্যদিকে, পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, শীতের এমন প্রকোপ আরও ৪-৫ দিন অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া, শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। চট্টগ্রামের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামার সম্ভাবনা রয়েছে।
বাঁশখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের সরকারি হাসপাতালগুলোতে শিশু ওয়ার্ডে চলতি সপ্তাহে রোগীর সংখ্যা শয্যার তুলনায় কয়েকগুণ বেশি হয়ে গেছে। শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগই একদিন থেকে চার বছরের মধ্যে। চিকিৎসার বলছেন, শীতের প্রকোপ থেকে শিশুদের রক্ষা করতে গরম পোশাক পরিধান করতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং প্রয়োজন হলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন তিনি।