
.
ঘরোয়া ক্রিকেটে দুর্নীতি, ফিক্সিং, অনিয়মের খবর নতুন কিছু নয়। বদলে যাওয়া বাংলাদেশে সর্বশেষ বিপিএলের আগে তাই কঠোর অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ও টুর্নামেন্টের আয়োজক কমিটি। কিন্তু এরপরও বিতর্ক এড়ানো যায়নি। বহুল আলোচিত বিপিএলের পর এবার ডিপিএলেও (ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ) স্পট ফিক্সিংসহ অভিযোগ উঠল। কিছু ম্যাচে টেবিলের নিচের দিকে থাকা দলগুলো মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা দলের বিরুদ্ধে জিতছে, যা অনেকের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করে। ৯ম রাউন্ডে গাজী গ্রুপ ও রূপগঞ্জ টাইগার্সের ম্যাচে রূপগঞ্জের ব্যাটিং কৌশল নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয় এবং এমনটি মনে হয়েছিল, যে গাজীকে জেতানোর জন্য ম্যাচের নিয়ন্ত্রণে ছাড় দেওয়া হয়েছে। ৯ এপ্রিল মিরপুরে গুলশান ক্রিকেট ক্লাব ও শাইনপুকুর ক্রিকেট ক্লাবের ম্যাচেও অস্বাভাবিক দৃশ্য দেখা গেছে। যেমন রহিম আহমেদ উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে স্টাম্পড হন এবং মিনহাজুল আবেদিন সাব্বিরও অবাঁক করে স্টাম্পড হন। এই দুই আউটের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ওই আউটের ভিডিও শেয়ার করে মজার ছলে বিসিবির দুর্নীতি দমন ইউনিটের প্রধান মেজর (অব.) রায়ান আজাদ লিখেছেন, ‘চা পানের দাওয়াত রইল’। কোচ রাজিন সালেহ লিখেছেন, ‘শেম, ডিপিএল’। ক্রিকেটার শামসুর রহমান শুভ লিখেছেন, ‘সিরিয়াসলি শেম।’ স্বেচ্ছা এই দুই আউটে শাইনপুকুর ৫ রানে ম্যাচ হারে গুলশান ক্রিকেট ক্লাবের কাছে। দুটি ক্লাবই বেক্সিমকো গ্রুপের। উভয় ক্লাব লিগে খেলার আর্থিক সংস্থান করেছে কাউন্সিলরশিপ বিক্রি করে। গুলশান ও শাইনপুকুরের কোচিং স্টাফ ভিন্ন হলেও পেছন থেকে দল দুটির নিয়ন্ত্রক খালেদ মাহমুদ সুজন। এ কারণেই গুলশানকে সুপার লিগে কোয়ালিফাই করাতে শাইনপুকুরের বিরুদ্ধে ম্যাচ ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে প্রথমবার খেলতে নামা দুই ক্রিকেটারের সন্দেহজনক আউটের ভিডিও ছড়িয়ে পড়া, ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠা এবং জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটারদের ফেসবুকে নিন্দনীয়ভাবে সমালোচনামূলক স্ট্যাটাস দেওয়ায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তদন্তের বিষয়টি নিশ্চিত করে বিসিবি। দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থার দুর্নীতি দমন বিভাগ (এসিইউ) মিনহাজুল ও রহিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। একাডেমি মাঠে প্রকটিক্যাল পরীক্ষাও নেওয়া হয় দু’জনের। যদিও জিজ্ঞাসাবাদে উভয় ক্রিকেটার ফিক্সিংয়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
মেজর রায়ানের নেতৃত্বে পুরো দল দুই ক্রিকেটারের জিজ্ঞাসাবাদে অংশ নেয়। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় প্রতিপক্ষ বা নিজ দলের ম্যানেজমেন্টের দিক থেকে কোনো চাপ ছিল কিনা? গুলশানের কোচ সুজনের রাজশাহীর একাডেমি বাংলা ট্র?্যাকের ক্রিকেটার রহিম। তিনি কোনো নির্দেশনা দিয়েছিলেন কিনা এ নিয়েও জানতে চাওয়া হয়। আর্থিক লেনদেনের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে উভয় ক্রিকেটার আপত্তি তুলে বলেন, ‘ক্লাব তো চুক্তির টাকাই দেয়নি।’ বিসিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘তদন্ত শেষে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এর আগে এবারের বিপিএল (৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) খেলা সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ এতটাই বেশি ছিল যে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড অ্যান্টি-করাপশন ইউনিটকে সাহায্য করার জন্য একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে। বিশাল বড় ওয়াইড বল, মোহাম্মদ আমিরের কথা মনে করিয়ে দেয়া ‘নো বল’ ছিল, সঙ্গে ছিল ক্রিকেটারদের মান নিয়েও প্রশ্ন। যেমন অস্ট্রেলিয়ার উইলিয়াম বোশিস্ট তিনি গত চার বছর স্বীকৃত ক্রিকেট খেলেননি, আফগানিস্তানের ফরমানুল্লাহ, আফগান ‘এ’ দলের হয়ে খেলা ছাড়া তিনি কখনো বিদেশের লিগে খেলেননি।
নতুন ধারার বিপিএল আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হতাশ করে বিসিবির নতুন নেতৃত্ব। এবারের আসরকে ঘিরে ভক্তদের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকলেও সেই অনুযায়ী কিছুই দেখা যায়নি। উল্টো অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিতে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে এবারের বিপিএল। বিপিএলের অতীত সব আসরের মতো এবারও পারিশ্রমিক জটিলতা লক্ষ্য করা গেছে। তবে শুধু পারিশ্রমিক ইস্যুই নয়, এবারের আসরে এমন ফ্রঞ্চাইজিও এসেছে যাদের হোটেল ভাড়া দিতেও হিমশিম খেতে হয়েছে। মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে দেখা দিয়েছে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ। বিপিএলের ইতিহাসে এত খেলোয়াড় এবং ফ্রঞ্চাইজিকে নিয়ে অভিযোগ এর আগে কখনোই ওঠেনি। চারটি ফ্রঞ্চাইজির আটটি ম্যাচকে ঘিরে এবারের বিপিএলে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠে। সবচেয়ে বেশি ১২টি করে অভিযোগ ঢাকা ক্যাপিটালস এবং দুর্বার রাজশাহীর খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে। চিটাগং কিংসের খেলোয়াড়দের নিয়ে অভিযোগ ২টি আর সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিরুদ্ধে অভিযোগের সংখ্যা ৬। মজার বিষয় হলো, এই চার দলের তিনটিই এবারের টুর্নামেন্টে সবার আগে বাদ পড়েছে। যে আটটি ম্যাচ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে সেগুলো হলো- ফরচুন বরিশাল-দুর্বার রাজশাহী (৬ জানুয়ারি), রংপুর রাইডার্স-ঢাকা ক্যাপিটালস (৭ জানুয়ারি), ঢাকা ক্যাপিটালস- দুর্বার রাজশাহী (১২ জানুয়ারি), চিটাগং কিংস-সিলেট স্ট্রাইকার্স (১৩ জানুয়ারি), ফরচুন বরিশাল-খুলনা টাইগার্স (২২ জানুয়ারি) এবং চিটাগং কিংস-সিলেট স্ট্রাইকার্স। ফিক্সিংয়ের এ অভিযোগ নিয়ে কাজ শুরু করেছে আকসু। তাদের রাডারে আছেন মোট ১০ ক্রিকেটার। এদের মধ্যে ৬ জন ক্রিকেটার বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়েও প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বাকি ৪ জনের ২ জন উদীয়মান ক্রিকেটার আর ২ জন বিদেশী ক্রিকেটার।
বিপিএলে ফিক্সিংয়ের বিষয়ে কোনো ছাড় দেবেন না বলে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ, ‘যদি তদন্তে কিছু বেরিয়ে আসে, তাহলে খুবই খারাপ শাস্তি আসতে যাচ্ছে। যদি আমরা এমন কিছু (ফিক্সিং) খুঁজে পাই, তাদের জীবন অন্যরকম হয়ে যাবে কারণ আমি দোষীদের কোনো সুযোগ দেই না। এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হবে যা মানুষ মনে রাখবে অনেকদিন।’ বাংলাদেশের ক্রিকেটে ফিক্সিংয়ের ইতিহাস বেশ পুরনো।
প্যানেল