
.
ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সমর্থকদের দিন কাটছে সুখস্মৃতির অবগাহনে। একটা সময় যে কোনো ঘরোয়া আসরে মোহামেডানের শিরোপা না পাওয়া ছিল ব্যর্থতার শামিল। অথচ সেই মোহামেডানের ২০০৯ সাল থেকে প্রবর্তিত বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলে কোনো শিরোপা নেই! বিগত এক দশকে অর্জন কেবল ২০২২-২৩ মৌসুমের ফেডারেশন ট্রফি। এসন পরিস্থিতিতে সাফল্যের প্রত্যাশায় চাতক পাখির মতো তৃষ্ণার্ত সাদাকালো ভক্তদের স্মৃতি রোমন্থন ছাড়া উপায় কি!
সুখের কথা হচ্ছে, মোহামেডান ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। স্বপ্ন দেখছে প্রথমবারের মতো পেশাদার লিগ জয়ের। ১২ মার্চ মোহামেডান ২-১ গোলে হারিয়েছে অভিষেকের পর টানা পাঁচটি পেশাদার লিগ জয়ের ইতিহাস গড়া বসুন্ধরা কিংসকে। ডিসেম্বরেও স্টেডিয়ামে লিগের প্রথম দেখায় মোহামেডান হারিয়েছিল বসুন্ধরা কিংসকে। কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়ামে একমাত্র জয়সূচক গোলটি করেছিলেন সোলেমান দিয়াবাতে। কিংস অ্যারেনাতেও জোড়া গোল হাঁকিয়েছেন দিয়াবাতে।
মালের ফুটবলার দিয়াবাতে বর্তমান মোহামেডানের মূল চালিকাশক্তি। ২০১৯ সাল থেকে মোহামেডানের হয়ে খেলা দিয়াবাতে দলের অধিনায়কও। অতীতে মোহামেডানের জার্সিতে এমেকা ইউজেগো, নালজেগার, রহিমভ, কাজাকভ, ওলেগ জিভৎনিকভ আর ভিজেন তাহিরিদের মতো উঁচুমানের বিদেশী ফুটবলার কাঁপিয়ে গেছেন ঢাকার। তখন ছিল মোহামেডানের সোনালি সময়। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে এশিয়ান ক্লাব টুর্নামেন্টেও মোহামেডান খেলতো দাপটের সঙ্গে। আর দিয়াবাতের মোহামেডান প্রায় ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে প্রথম বিদেশী ফুটবলার হিসেবে শতাধিক গোলের মাইলস্টোন পেরিয়েছেন তিনি। ২০২৩ সালে ফেডারেশন কাপের ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনীর বিপক্ষে একাই চার গোল করে গড়েছেন ইতিহাস। ২০২১-২২ পেশাদার লিগের সেরা গোলদাতা দিয়াবাতে চলতি মৌসুমেও ১১ ম্যাচে ৯ গোল করেছেন।
১৯৯১ সালের ২৩ মার্চ জন্ম নেয়া সোলেমান দিয়াবাতে মোহামেডানের দুঃসময়ের কান্ডারি। মোহামেডানের ‘পারফেক্ট টেন’। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, দিয়াবাতে ফ্লপ মানেই মোহামেডান ফ্লপ। অন্তত বসুন্ধরা কিংস আর আবাহনীর মতো বড় দলের বিপক্ষে জয়ে দিয়াবাতের গোল রীতিমতো ‘নিয়ম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২২-২৩ মৌসুম থেকে দিয়াবাতের যোগ্য সহচর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন মুজাফফর মুজাফফরভ। ১৯৯২ সালে টানা তিনটি হ্যাট্রিকসহ মোহামেডানের জার্সিতে ১১ ম্যাচে ১৭ গোল করে তাক লাগিয়েছিলেন আজামত আব্দু রহিমভ। উজবেকিস্তান জাতীয় দলের জার্সি গায়ে চাপানো রহিভমের দেশের ফুটবলার মুজাফফরভ। মধ্যমাঠের মুজাফফরভের দূরপাল্লার শটে রয়েছে আগুনের ফুল্কির গতি। মাঝমাঠের রাশ নিজের হাতে রাখতে পারেন নিখুঁতভাবে। দিয়াবাতের পর মোহামেডানের অন্যতম ভরসা মুজাফফরভ দারুণ সাহসী। মৌসুমের শুরু থেকে তিনিই একমাত্র বলে আসছেন, ‘মোহামেডান লিগ চ্যাম্পিয়ন হবে ইনশাআল্লাহ।’ সম্প্রতি খেলোয়াড়দের ‘বেতন’ নিয়ে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে মোহামেডান শিবিরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে তুমুল আলোচনাও হয়। কিন্তু কিংসের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে মুজাফফরভ সমর্থকদের আশ্বস্ত করেছিলেন, ‘ক্লাব কর্মকর্তাদের ওপর আমরা বিশ্বাস রাখছি। শুধু কিংস নয়, বাকি মৌসুমে আমরা আমাদের সেরাটা দেয়ায় বদ্ধপরিকর। মোহামেডানকে লিগ শিরোপা জেতাতে মুখিয়ে আছি আমরা।’
দিয়াবাতে, মুজাফফরভ, নাইজেরিয়ার ইমানুয়েল সানডে আর টনিদের সঙ্গে দেশীয় ফুটবলারদের বোঝাপড়াটাও এখন দারুণ। গোলপোস্টের নিচে সুজন কিংবা সাকিব আল হাসানরা সুযোগ পেলেই নিজেদের মেলে ধরছেন। মেহেদি হাসান মিঠু দুর্দান্ত পারফর্মেন্সে লিগের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডারে পরিণত হয়েছেন। সম্প্রতি ভারতের বিপক্ষে জাতীয় দলের স্কোয়াড থেকে মিঠুকে বাদ দিয়ে তোপের মুখে পড়েছেন খোদ জ্যাভিয়ের ক্যাবরেরা। এছাড়া মিনহাজুল আবেদিন বাল্লু, আরিফ হোসেনরা বুক চিতিয়ে লড়ছেন। অথচ বসুন্ধরা কিংস আর ঢাকা আবাহনীর তুলনায় মোহামেডানে দেশীয় তারকা খেলোয়াড় নেই বললেই চলে। উল্টো বিগত মৌসুমে তিন আসরের রানার-আপদের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছেন শাহরিয়ার ইমন, কামরুল আর জাফর ইকবালের মতো প্রতিশ্রুতিশীল ফুটবলার। তাতে মৌসুমের শুরুতে সমর্থকরা আশংকায় ছিলেন মোহামেডান নিয়ে। কিন্তু কোচ আলফাজ আহমেদ গোটা স্কোয়াডকে এক সুতোয় গাঁথতে পেরেছেন। সাবেক দেশসেরা স্ট্রাইকারের অধীনে ৯ বছর পর ট্রফি জিতেছিল মোহামেডান। পেশাদার লিগের শিরোপার স্বপ্নটা ক্রমশ উজ্জ্বল হচ্ছে। যদিও আলফাজের বক্তব্য, ‘লিগের এখনো অনেক পথ বাকি। সমর্থকদের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থন আর দোয়া অব্যাহত থাকলে ইনশাআল্লাহ মোহামেডান পেশাদার লিগের শিরোপা জেতার সামর্থ্য রাখে।’
মোহামেডান ও জাতীয় দলের সাবেক গোলরক্ষক এবং বর্তমানে দলের গোলকিপিং কোচ সাইদ হাসান কাননও মোহামেডানের লিগ শিরোপা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি জানান, ‘মোহামেডানের হয়ে খেলোয়াড়ি জীবনে কতবার লিগ জিতেছি। এখন জিততে চাই কোচিং প্যানেলের অংশ হিসেবে।’ মোহামেডানের ফুটবলার আলমগীর কবির রানা জানান, ‘২০০৯ সালে মোহামেডানের হয়ে ফেডারেশন কাপ আর সুপার কাপ জিতেছিলাম। ২০২৩ সালের মে মাসে টাইব্রেকারে গোল করে মোহামেডানের ফেডারেশন জয়েও অবদান রাখতে পেরেছিলাম। এখন চাওয়া একটাই, মোহামেডানকে পেশাদার লিগ জেতানো। ভাগ্য সহায় হলে লিগ আমরাই জিতব ইনশাআল্লাহ।’
১০ দলের লিগ টেবিলে ১১ রাউন্ড শেষে ৩০ পয়েন্ট পাওয়া মোহামেডানের অবস্থান শীর্ষে। ২৬ পয়েন্ট পাওয়া ঢাকা আবাহনীর সঙ্গে মোহামেডানের শিরোপা লড়াই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে বলা যায়। যেহেতু ২০ পয়েন্ট পাওয়া বসুন্ধরা কিংস প্রায় ছিটকে গেছে লিগ রেস থেকে।
প্যানেল