ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ৩০ চৈত্র ১৪৩১

বিলুপ্তির পথে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প

প্রকাশিত: ০০:১৮, ১৩ এপ্রিল ২০২৫

বিলুপ্তির পথে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প

.

বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মৃৎশিল্পের সম্পর্ক সুগভীর থাকলেও বংশানুক্রমে গড়ে ওঠা এই শিল্পটি আজ বিলুপ্তির পথে। পালপাড়ায় মেয়েদের ব্যস্ততা আর আগের মতো নেই। কাঁচামাটির গন্ধ তেমন পাওয়া যায় না। হাটবাজারে আর মাটির তৈজসপত্রের পসরা বসতে দেখা যায় না। তবে, বাস্তবতার সঙ্গে যুদ্ধ করে এখনো কিছু কুমার পরিবার ধরে রেখেছে বাপ-দাদার এই আদি ব্যবসা।
আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে আজ মাটি দিয়ে প্রস্তুত অনেক কিছুই হারিয়ে যেতে বসেছে। তারপরও অনেক সংগ্রাম করে পোড়ামাটির গৃহস্থালির নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি, পুতুল, খেলনা, প্রতিকৃতি, শো-পিসসহ অসংখ্য জিনিস কুমারশালায় তৈরি হচ্ছে। পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া পেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। এ সম্প্রদায়ের লোকজনরা মাটির তৈরি করা পাতিল, ঠিলা, কলসি, পুতুল, কুয়ার পাট, খেলনা সামগ্রী, ফুলের টব, মাটির ব্যাংক ইত্যাদি হাটবাজারে বা গ্রামে গ্রামে বড় ঝাঁকা বোঝাই করে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন। ছয় মাস তারা মৃৎশিল্প তৈরি করে ছয় মাস বিভিন্ন কায়দায় বিক্রি করতেন।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার সবচেয়ে বড় পালপাড়া হলো পুটিজানা ইউনিয়নের শিবগঞ্জ পালপাড়া। এ গ্রামে প্রায় ২০০ পাল পরিবার বসবাস করে। তাদের সবার পেশা মাটি দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করা। সম্প্রতি শিবগঞ্জ পালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি পাল পরিবারের উঠানে তৈরি হচ্ছে প্রয়োজন মতো জিনিসপত্র। মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরিতে ব্যস্ত নারীরা। পুরুষরা করছেন অন্য কাজ। মাটির বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে উঠানে কিংবা পাকা সড়কের পাশে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। প্রতি বাড়িতেই মাটির তৈরি জিনিস পোড়ানোর জন্য রয়েছে চুল্লি। সেখান থেকে মাটির তৈরি জিনিস নামাতেও দেখা গেছে। পুড়ে লালবর্ণ ধারণ করা মাটির এসব জিনিসের এক সময় সর্বত্র চাহিদা থাকলেও দিন দিন এসবের ব্যবহার কমছে। প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম ও স্টিলের জিনিসপত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকতে পারছে না মাটির জিনিসপত্র। ফলে, অনেকে পেশা পাল্টে অন্য পেশায় যুক্ত হয়েছেন।
বাড়ির একপাশে বসে রিনা রানী পাল (৪০) ও তার শাশুড়ি বীনা রানী পাল (৬০), অঞ্জনী রানী পাল (৬৫) তৈরি করছিলেন দই রাখার পাত্র। গরম আসায় দইয়ের পাত্রের চাহিদা বেড়েছে। দইয়ের পাত্র তৈরির পর তারা তা পাকা সড়কের পাশে রোদে শুকাতে দেন। রিনা বলেন, দুই দশক আগেও বহু ধরনের জিনিস তৈরি হতো। কিন্তু দিন দিন চাহিদা কমছে। গরম এলে দইয়ের পাত্রের চাহিদা বাড়ে মিষ্টির দোকানগুলোতে। সাধারণত, বাড়ির নারীরা এগুলো বানান। পুরুষরা ভ্যান গাড়িতে করে বাজারে নিয়ে দোকানে দোকানে সরবরাহ করেন। শুভাষ চন্দ্র পাল (৬৬), রাম চন্দ্র পাল (৮২), কালী পদ চন্দ্র পাল (৪৮), সন্তুষ চন্দ্র পাল (৫৮) বাপ-দাদার আদি এই পেশা মাটি আঁকড়ে আছেন এখনো। তারা জান, এখন এ পেশা আগের মতো চালাতে পারেন না। তাই, এই পেশা ছেড়ে অনেকেই অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে অনেকে। প্লাস্টিক, এ্যালমোনিয়াম ও সিলভারের দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে মৃৎশিল্প।
জানা যায়, চীনের বিখ্যাত শহর থাংশানে মৃৎশিল্পের জন্ম। আর এ কারণেই এ শহরটিকে মৃৎশিল্পের শহর বলা হয়। চীনের অন্যতম প্রাচীন শহর পেইচিং থেকে ১৫০ কিলোমিটার উত্তরপূর্বে অবস্থিত শহরটি। শহরের পথে-প্রান্তরে, বিনোদন কেন্দ্র বা পার্কগুলোতে মৃৎশিল্পের বিভিন্ন শিল্পকর্ম দেখতে পাওয়া যায়। থাংশানের মৃৎশিল্পের উৎপত্তি ও বিকাশের সূত্রপাত মিং রাজবংশের ইয়ুং লে-এর সময়কালে। এ শহরের রয়েছে প্রায় ৬০০ বছরের ইতিহাস। এখানে নানা ধরনের চীনামাটির ৫০০টিরও বেশি মৃৎশিল্প রয়েছে। এখানকার বিভিন্ন রকম মাটির মধ্যে প্রাচীন স্থাপত্য চীনামাটি, স্বাস্থ্যসম্মত চীনামাটি, শিল্পায়ন চীনামাটি, হাইটেক চীনামাটি, শিল্পকলা চীনামাটি ইত্যাদি অন্যতম।
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোর অন্যতম হচ্ছে মৃৎশিল্প। এটি শুধু শিল্প নয়, আবহমান গ্রামবাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য। মাটির নান্দনিক কারুকার্য ও বাহারি নকশার কারণে এই শিল্পের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে, যাতে বাইরের রাষ্ট্রে রপ্তানি করা যায়, তার জন্য আরও বেশি করে উদ্যোগ নিতে হবে। মৃৎশিল্পের সঙ্গে জড়িত কুমার এবং পালদের সহজ শর্তে ঋণ এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধা প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্নমুখী উৎপাদন বাড়াতে হবে। এই দেশীয় শিল্পের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 

প্যানেল

×