ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ এপ্রিল ২০২৫, ৪ বৈশাখ ১৪৩২

দেশের ফুটবলে পরিবর্তনের হাওয়া

আহসান হাবীব সুমন

প্রকাশিত: ০১:৩৩, ৯ এপ্রিল ২০২৫

দেশের ফুটবলে পরিবর্তনের হাওয়া

শিলংয়ে ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচে অপ্রতিরোধ্য ছিলেন বাংলাদেশের হামজা চৌধুরী

হামজা চৌধুরী কঠিন চ্যালেঞ্জে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশের ফুটবলকে। সমর্থকদের পক্ষ থেকে চাপ বাড়ছে জাতীয় দলে বেশি বেশি প্রবাসী ফুটবলারদের অন্তর্ভুক্ত করার। অন্যদিকে প্রমাদ গুণছেন দেশীয় ফুটবলাররা। জাতীয় দলে যত বেশি প্রবাসী আসবে, তত কমে যাবে দেশীয়দের সুযোগ। 
এটা সত্যি, হামজা লেভেলের প্রবাসী ফুটবলারের অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশ দলকে উজ্জীবিত করবে। শুধু মাঠের খেলায় নয়, মাঠের বাইরেও। যার প্রমাণ মিলেছে ভারতের বিপক্ষে শিলংয়ে  ২৫ মার্চ। বহুদিন পর বিদেশের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে দাপুটে ফুটবল খেলেছে বাংলাদেশ। যদিও ফরোয়ার্ডদের ব্যর্থতায় জয় আসেনি।

অবশ্য ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশ দলে ফরোয়ার্ড বলতে কেউ ছিল কিনা সেটাও প্রশ্ন!   ইতোমধ্যে কুইন সুলিভান আর কাভান সুলিভানকে বাংলাদেশ দলে দেখার প্রত্যাশা করছে ফুটবল অনুরাগীরা। সামিত সোমকে নিয়েও স্বপ্ন দেখছে অনেকে। তবে তাদের পাওয়া কঠিন। তারা আমেরিকা আর কানাডার জাতীয় দলে খেলার স্বপ্নে বিভোর। যেমনটা হামজা চেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের হয়ে খেলতে। এটা দোষের কিছু না।

বাংলাদেশ ফুটবল বিশ্ব লেভেল তো বটেই, এশিয়ান পর্যায় থেকেও যোজন পিছিয়ে। তুলনায় আমেরিকা, কানাডা আর ইংল্যান্ড বিশ্ব ফুটবলে মাঝারি থেকে শীর্ষ শক্তি। তাই সুযোগ থাকলে যে কেউ এই দলগুলোতে খেলে আন্তর্জাতিক সাফল্যের আশা করবে।
শোনা যাচ্ছে, আগামী জুনে কয়েক ডজন প্রবাসী ফুটবলার নিয়ে বাফুফে ট্রায়াল করবে। মূলত বয়সভিত্তিক আর জাতীয় দলের জন্য প্রবাসীদের পরীক্ষা করতেই ট্রায়াল। আসন্ন ট্রায়াল থেকে বাংলাদেশ মানসম্মত ফুটবলার খুঁজে পাক এমন আশা করছেন সবাই। তাতে দেশের ফুটবলেরই লাভ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফের চলে আসছে হামজা প্রসঙ্গ।

শেফিল্ড ইউনাইটেডের ফুটবলার এক ম্যাচ খেলেই নিজের জাত চিনিয়েছেন বাংলাদেশের জার্সিতে। কথাটা অন্যভাবে বলা যায়, নিজের মান বজায় রেখেছেন হামজা। আসলে তো হামজার প্রমাণ করার কিছু নেই। অন্তত বাংলাদেশে খেলে। তিনি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ আর উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগেই খেলেই নিজের সামর্থ্য আর যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন গোটা বিশ্বকে।

শুধু দেখার ছিল, বাংলাদেশের গতিহীন ফুটবলের সঙ্গে তিনি মানিয়ে নিতে পারেন কিনা সেটারও তিনি সফলতার সঙ্গে পেরেছেন। আগামীতে হামজা বাংলাদেশ দলে আরও বেশি ইমপ্যাক্ট রাখবেন এবং তার ছোঁয়ায় আমাদের ফুটবলাররা আরও ক্ষুরধার হবেন এমন আশা করছেন সবাই। 
এটা তো সত্যি, বাংলাদেশের ফুটবলারদের সামনে হামজার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কঠিন চ্যালেঞ্জ আছে। ভারতের বিপক্ষেই দেখা গেছে, হামজার অনেক ‘সাইন’ বাংলাদেশের ফুটবলাররা ধরতে পারেনি। হামজা চাইলেও সঠিক জায়গায় বলের জোগান পাননি। অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশের লোকালরা ইচ্ছাকৃতভাবে হামজাকে সহযোগিতা করেনি! তবে বেশিরভাগের ধারণা, হামজার সঙ্গে বোঝাপড়াটা ঠিকমতো  গড়ে ওঠেনি। কয়েক ম্যাচ গেলেই এই সমস্যা কেটে যাবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ দলে প্রবাসী খেলোয়াড়দের সত্যিই প্রয়োজন আছে কিনা? অনেক সাবেক ফুটবলার প্রবাসীদের আমদানিকে কিছুটা নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। তারা দেশের ঘরোয়া ফুটবল সচল করে ফুটবলার তুলে আনার পক্ষে। এটা অযৌক্তিক না। দেশের পাইপলাইনে প্রতিভাবান ফুটবলার না থাকলে শুধু প্রবাসীদের দিয়ে ফুটবল চলবে না।

আবার এটাও ঠিক, গত প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশে মানসম্মত ফুটবলার খুব বেশি উঠে আসেনি। এই সময়ে বাংলাদেশের সেরা তারকা জামাল ভূঁইয়া। তিনিও প্রবাসী। বিগত বছরগুলোতে জেলা পর্যায়ের লিগ অনিয়মিত। নতুন ফুটবলার উঠে আসার পথ প্রায় বন্ধ। রাকিব, আল-আমিনের মতো কিছু প্রতিভা আমরা পেয়েছি। রাকিব পরীক্ষিত।

আল-আমিন সুযোগ পাচ্ছেন না জাতীয় দলে। আবার দারুণ প্রতিভা থাকার পরও শেখ মোরসালিন চুপসে গেছেন বেশ। শাহরিয়ার ইমনরা কতদূর যাবেন দেখার বিষয়।   
বর্তমানে দেশের ফুটবলের যা অবস্থা তাতে প্রবাসীদের উপর নির্ভরশীল না হয়ে উপায় নেই। এখন থেকে যদি ধরেও নেয়া যায়, দেশের ঘরোয়া আর জেলা ফুটবল সেরা পর্যায়ে থাকবে। তবু জাতীয় দলে প্রতিনিধিত্ব করার মতো মানসম্মত ফুটবলার পেতে কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় পর যদি ঝাঁকেঝাঁকে ফুটবলার মিলে যায়, তখন না হয়  শুধু দেশীয়দের নিয়ে জাতীয় দল গঠন করা যাবে!  

আবার জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া প্রবাসীদের কয়েকগুণ এগিয়ে থাকতে হবে লোকাল ফুটবলারদের চেয়ে। এমন ফুটবলার খুঁজে পাওয়া আর তাদের বাংলাদেশের হয়ে খেলতে রাজি করানোটাও বাফুফের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে। ইতোমধ্যে তরুণ ফুটবল সমর্থকরা একাট্টা হয়েছেন বাংলাদেশ দলে প্রবাসী ফুটবলারদের অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর দাবীতে। আবার সাবেক ফুটবলারদের অনেকেই প্রবাসী ফুটবলারদের অবাধ আমদানির বিপক্ষে মত দিয়েছেন।

প্রখ্যাত ফুটবলার গোলাম সারোয়ার টিপু এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রবাসী ফুটবলারদের উপর নির্ভরতা হচ্ছে সাফল্যের শর্টকাট পথ। হামজা চৌধুরীর বিষয়টা আলাদা। তিনি অনেক উঁচুমানের ফুটবলার। হামজা মানের ফুটবলার সব সময় পাওয়া যাবে না। তাই আমাদের উচিৎ ঘরোয়া আর জেলা লিগ সচল করা। এতে করে দেশেই প্রতিভাবান ফুটবলার উঠে আসবে।’ 
টিপু চীনের উদাহরণ টেনে বলেন, ‘সাফল্যের নেশায় চীন বিদেশী ফুটবলারদের জাতীয় দলে খেলার সুযোগ করে দিয়েছে। ব্রাজিলের সার্জিনহো ও ইংল্যান্ড যুব দলে খেলা টাইয়াস ব্রাউনিং ও নিকো ইয়োনারিস  চীনের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাতেও চীনের ফিফা বিশ্বকাপে খেলার লক্ষ্যপূরণ হচ্ছে না।’ বিদেশীদের নাগরিকত্ব দেয়া চীনা ফুটবল দল প্রত্যাশিত সাফল্য পাচ্ছেনা।

কিন্তু একই পথে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড রয়েছে ফ্রান্স ও জার্মানির। তাই বাফুফে’র সামনে চ্যালেঞ্জটা কঠিন। শুধুমাত্র দেশীয়দের নিয়ে বাংলাদেশ খাবি খাচ্ছে। তাই প্রবাসীদের উপর নির্ভর করতেই হচ্ছে। সেই সঙ্গে সারা দেশের জেলা পর্যায়ে ঘরোয়া ফুটবলের নিয়মিত আয়োজনের চ্যালেঞ্জটাও বাফুফে’কে নিতে হবে। অন্তত দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে নিজেদের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে বাফুফে’র কার্যকরী ভূমিকা দেখতে মুখিয়ে আছে সবাই।      
সাধারণ ফুটবল দর্শকরা খুব বেশি কিছু চান না। তারা শুধু ফুটবল মাঠে সফল বাংলাদেশকে দেখতে চাই। ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়া ইউনিভারসিটি দলকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ লাল দল। ওই সময়  রাস্তায় রঙ খেলায় মেতেছিলেন বাংলার খেলাপগাল মানুষ।

মিয়ানমারে চার জাতি ফুটবল, এসএ গেমসে গোল্ড আর সাফ ফুটবল শিরোপা জিতেও উল্লাসে মেতেছিল গোটা দেশ। সেই উল্লাসটা আবারও দেখতে চাই দেশবাসী। সেটা প্রবাসী ফুটবলারদের কল্যাণে এলেও ক্ষতি নেই। যে কারণে হামজার মতো প্রবাসীদের সঙ্গে নিয়েই ফুটবলকে এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে মত সাধারণ ক্রীড়ামোদিদের।

×