ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১৮ চৈত্র ১৪৩১

ফিরেই শেফিল্ডকে জেতালেন হামজা

ভালোবেসে পাশাপাশি হামজা-অলিভিয়া

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০০:৪৯, ৩০ মার্চ ২০২৫

ভালোবেসে পাশাপাশি হামজা-অলিভিয়া

হামজা ও অলিভিয়া

নাম তার অলিভিয়া ফাউন্টেন। হাসিখুশি, লাস্যময়ী, রূপবতী, প্রাণবন্ত এক তরুণী। তার বয়ফ্রেন্ড বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ইংলিশ, ধর্ম ইসলাম। দুজনের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে প্রেমিকের বাঙালি বাবা অলিভিয়াকে ডেকে পাঠান। উজ্জ্বল নীল নয়না মেয়টি তখনো জানত না সামনে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে। ব্রিটিশকন্যা অলিভিয়াকে জানানো হয় আমরা বাঙালি এবং মুসলমান, আমার ছেলেকে যদি পছন্দ কর, তাহলে তাকে বিয়ে করতে হবে।

আর বিয়ে করতে হলে তোমাকে মুসলিম হতে হবে। শর্তটা শুনেই যেন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে ব্রিটিশ তরুণীর। এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সবকিছু। কেননা তার নিজের পরিবারই তো এমনটা মেনে নেবে না কখনই! কাজেই আপত্তি জানালেন অলিভিয়া। মুসলমানদের প্রতি ভুল ধারণা ছিল তার। ছিল নানা ভয়ভীতি। 
তার তরুণ প্রেমিকের হামজা দেওয়ান চৌধুরী। বয়স তার মাত্র ১৮। ফুটবলে আজকের মতো তখনো এত খ্যাতি ছড়ায়নি তার। 
কঠিন শর্তে আটকে গেলেও হামজার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করেননি অলিভিয়া। হামজার পরিবারও হারায়নি ধৈর্য্য। হামজার বাবা দেওয়ান মোরশেদ চৌধুরী ও মা রাফিয়া চৌধুরী মুসলিম ধর্মের নিয়ম-কানুনগুলো ধীরে ধীরে সহজ করে বোঝান অলিভিয়াকে। বিশ্বাস ছড়ায় আলো। জট খুলতে শুরু করল অলিভিয়ার অন্তর থেকে। কাটতে লাগল দিন।

কিছুদিন পর, সবকিছু জেনে-শুনে-বুঝে নীরবে তার পরিবারের কাউকে না জানিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন অলিভিয়া। ২০২০ সালে মোরশেদ চৌধুরীর বাসায় ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সম্পন্ন হয় হামজা ও অলিভিয়ার বিয়ে। বিয়ে পড়ান লেস্টার সেন্ট্রাল মসজিদের ঈমাম। স্বাক্ষী ছিলেন শুধু কাছের মানুষরা। দুজনের বয়সই তখন মাত্র ১৮। 
অনেকেই তখন হামজার বাবাকে বলেছিলেন, ‘এত ছোট একটা ছেলেকে বিয়ে দিচ্ছ, মোরশেদ করছো কী!’
তবে মোরশেদ কারো কথা শোনেননি। বিয়ে করিয়ে দিলেন আদরের সন্তান ও পুত্রবধূকে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার পর অলিভিয়ার নামকরণ করা হয় অলিভিয়া চৌধুরী। বিয়ের এক বছর পর্যন্ত একসঙ্গে ছিলেন সবাই। তারপর হামজা ধীরে ধীরে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেন। পরিবার বড় হতে লাগল। এই দম্পতির এখন তিন সন্তান। আলাদা বাসায় উঠতে হলো হামজা-অলিভিয়াকে। আট বছর পেরিয়ে গেছে এতদিনে।

প্রশ্ন জাগতেই পরে, অলিভিয়া কি এখনো ইসলাম ধর্ম পালন করেন? এ প্রসঙ্গে হামজার বাবা গর্বের সঙ্গে বলেছেন, ‘অলিভিয়া নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, মিলাদ পড়ে। আমাদের বাসায় সপ্তাহে একদিন মিলাদ হয়। তখন অলিভিয়া আমাদের বাসায় আসে। পাশ্চাত্যের পোশাকও সে পরিবর্তন করেছে।’
পরবর্তী সময়ে অলিভিয়ার পরিবার তার বিয়ে ও ধর্মত্যাগের বিষয়টি মেনে নেয়। মোরশেদ আরও জানান, ‘অলিভিয়ার মাধ্যমে তার পরিবার এখন হালাল-হারাম খাবার সম্পর্কে জানে। এগুলো তারা মেনেও চলে। আলহামদুল্লিাহ।’ হামজার-দম্পতির এক মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়ে দেওয়ান এনায়া হোসেন চৌধুরী, ছেলে দেওয়ান ঈসা হোসেন চৌধুরী এবং দেওয়ান ইউনুস হোসেন চৌধুরী। হামজা নিজেই তার দুই ছেলের নাম নবীদের নামে রেখেছেন। 
বাংলাদেশের সিলেটর হবিগঞ্জে হামজার পৈত্রিক বাড়ির একতলার মসজিদের দেয়াল ঘেঁষে মোরশেদ চৌধুরীর বাবা দেওয়ান আবদুল খালেক চৌধুরী, দাদা আবদুল গণি চৌধুরী এবং মা কাজী শফিকুন নেছা চৌধুরীর কবর রয়েছে। নারীদের নামাজ পড়ার জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। ২০২২ সালে এখানে একটি এতিমখানা তৈরি করা হয় দেওয়ান ঈসা হোসেন চৌধুরী হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা।

হামজার স্ত্রী অলিভিয়া এই এতিমখানার জন্য ইংল্যান্ড থেকে নিয়মিত টাকা পাঠান। অলিভিয়া পেশায় একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। লেস্টার শহরে নিজের পেশাগত কাজে ব্যস্ত থাকেন বেশিরভাগ সময়। কিশোরী বয়সে ছবি আঁকার প্রতি ভালোবাসা জন্মে। সেখান থেকেই পেশাগত জীবনে ধাবিত হয়ে পথচলা। ষখের বসে অলিভিয়া কুকুরও পোষেণ। ব্রিটিশ গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে কুকুরের পেছনে তিনি খরচ করেন ৫০ হাজার পাউন্ড!  
সেই অলিভিয়া এবারই প্রথম হামজার সঙ্গে বাংলাদেশে আসেন। এই দেশে তার স্বামীর আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা দেখে যেমন বিস্মিত হয়েছেন, তেমনি হয়েছেন অভিভূত। হয়তো মনে মনে বলেছেন, ধর্মত্যাগ করে সেদিনের প্রেমিক কিশোরটাকে বিয়ে করে কোন ভুল করিনি আমি! 
স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের হয়ে অভিষেকেই দুর্দান্ত খেলে সবার মন জয় করেছেন হামজা চৌধুরী। দল না জিতলেও ভালো খেলে ড্র করেছে। হামজা ছিলেন অঘোষিতভাবে ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়। শিলয় থেকে দলের সঙ্গে ঢাকায় ফিরেই ইংল্যান্ডের প্লেন ধরেন হামজা। উদ্দেশ্য ছিল ঘরোয়া ক্লাব শেফিল্ড ইউনাইটেডের হয়ে খেলা এবং দলকে জেতাতে অবদান রাখা। সে লক্ষ্যে পুরোপুরি সফল হয়েছেন ২৭ বছর বয়সী এই ডিফেন্সিভ মিডফি-ার।
চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে কভেন্ট্রিকে ৩-১ গোলে হারিয়ে দলকে টেবিলের শীর্ষে তুলতে অবদান রেখেছেন। শেফিল্ডের পয়েন্ট এখন ৩৯ ম্যাচে ৮৩। এদিন মিডফিল্ডে যথারীতি আধিপত্য বিস্তার করে খেলেছেন হামজা। দেরি করে যখন মাঠ ছাড়ছিলেন, তার নৈপুণ্যে মুগ্ধ স্বাগতিক দর্শকরা দাঁড়িয়ে অভিবাদনও জানিয়েছেন। ৩০ হাজার ভক্তের সামনে ব্লেডসরা শুরু থেকেই আলো ছড়িয়ে খেলেছে। মিডফিল্ডে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল হামজার।

ডুয়েলগুলো তার আধিপত্যেই জেতা সম্ভব হয়েছে। ম্যাচের শুরুতেই তাকে নিয়ে ধারাভাষ্যকার মন্তব্য করে বলেছেন, ‘হামজা মিডফিল্ডে তার খেলা অব্যাহত রেখেছেন। অথচ আন্তর্জাতিক বিরতিতে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ খেলে দীর্ঘ ফ্লাইট শেষে ফিরেছেন তিনি। তার সংবর্ধনাটা হয়েছে নায়কের মতো।’

×