ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৯ মার্চ ২০২৫, ৫ চৈত্র ১৪৩১

ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি, সাফের শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধার ও প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সমীহ আদায় করার লক্ষ্য

প্রবাসীদের ঘিরে বড় স্বপ্ন বাংলাদেশের

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০০:৫১, ১৯ মার্চ ২০২৫

প্রবাসীদের ঘিরে বড় স্বপ্ন বাংলাদেশের

এএফসি এশিয়ান কাপে ভারত ম্যাচ সামনে রেখে কোচ জ্যাভিয়ের কাবরেরার কোচিংয়ে মনযোগী ছাত্র বাংলাদেশের ফুটবলাররা

‘পঞ্চপা-ব’ শব্দটি এসেছে “মহাভারত” থেকে। এই গ্রন্থে বর্ণিত পান্ডুর পাঁচ পুত্র। যথা : যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকূল এবং সহদেব। প্রথম তিনজন কুন্তীর সন্তান এবং শেষের দু’জন ১ মাদ্রীর সন্তান। এদের যথাক্রমে ধর্ম, পবন, ইন্দ্র ও অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সন্তান বলা হয়ে থাকে। এই পাঁচ পুত্রই বিশেষ শৌর্যশালী এবং দেববলে উৎপন্ন, কেউই পান্ডুর ঔরসজাত নয়।
বাংলা সাহিত্যেও আছে পঞ্চপা-ব। ত্রিশের দশকের বিশিষ্ট পাঁচ কবি রবীন্দ্র প্রভাবের বাইরে গিয়ে বাংলা ভাষায় আধুনিক কবিতা সৃষ্টি করেছিলেন। তাদের ৫ জনকে বাংলা সাহিত্যে পঞ্চপা-ব বলা হয়। তারা হলেন : অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-৮৭), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪), জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), বিষ্ণু দে (১৯০৯-৮২) এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬০)। 
বাংলাদেশের ক্রিকেটও আছে পঞ্চপা-ব, যারা প্রায় সমসাময়িক এবং খেলা ছেড়েছেন প্রায় কাছাকাছি সময়ে। এরা হলেন : মাশরাফি মর্তুজা, তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান এবং মাহমুদুল্লাহ। 
বাংলাদেশের ফুটবলে কোনকালেই পঞ্চপা-ব ছিল না। তবে যেভাবে প্রবাসী ফুটবলারদের নিয়ে জাতীয় দলকে শক্তিশালী করে সাফল্য অর্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে, তাতে করে জনাপাঁচেক প্রবাসী ফুটবলারও অদূর ভবিষ্যতে সফল পঞ্চপা-বে পরিণত হতে পারেন বলে অনেক ফুটবলপ্রেমীই বিশ্বাস করেন। এরা হলেন : জামাল ভুঁইয়া, তারিক রায়হান কাজী, হামজা দেওয়ান চৌধুরী, ফাহমিদুল ইসলাম এবং সৈয়দ শাহ কাজেম। আজকের লেখার বিষয়বস্তু তারাই। 
অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশের ফুটবলের উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। তাদের লক্ষ্য দেশের ফুটবলকে প্রথমে এশীয় মানে এবং পরে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়া। জাতীয় দলের শক্তি বাড়ানোর জন্য বিশ্বের অনেক দেশেই ভিনদেশী ফুটবলারদের দলভুক্ত করার নজির আছে। বাংলাদেশও একবার এ পথে হাঁটার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় তা আর হয়নি।

তবে এক্ষেত্রে তারা বিকল্প একটি পন্থা অবলম্বনও করেছিল জাতীয় দলের সাবেক দুই ডাচ্ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফ এবং রেনে কোস্টারের মাধ্যমে, সেই ২০১৩ সালে। সেটি হলো বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত দক্ষ ও কুশলী ফুটবলার দলে নেয়া। সেজন্য ইন্টারনেটে এ জাতীয় বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয় বাফুফের তরফ থেকে। এর প্রেক্ষাপটে চারজন ফুটবলার যোগাযোগ করেন। তারা ছিলেন : অস্ট্রেলিয়ার আনন্দ রহমান, ডেনমার্কের জামাল ভুঁইয়া, জার্মানির রিয়াসত খাতন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফারহান খান।

এদের কেউ প্রশিক্ষণের চাপ সামলাতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ক্যাম্প ছেড়ে চলে যান, কেউ ইনজুরি নিয়ে এসে বাদ পড়েন। টিকে যান জামাল ভুঁইয়া। জামাল এসেই আলোড়ন সৃষ্টি করেন। কুশলী এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ২০১৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপ ফুটবলের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার লাভ করেন। কয়েক বছর পরই বনে যান জাতীয় দলের অধিনায়কও। জামাল শেকড়ের টানে এসেছিলেন বাংলাদেশে। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে ফুটবল খেলার স্বপ্নপূরণ হয় তার।

সেটা ১ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সালের কথা। কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের উদ্বোধনী ম্যাচে নেপালের বিপক্ষে অভিষেক হয় জামালের। কিন্তু সেই ম্যাচে ০-২ গোলে হেরে যায় বাংলাদেশ। জামালের বাবার বাড়ি কিশোরগঞ্জ। পরিবারের সবাই ডেনমার্কে থাকেন। সেখানেই ছোট থেকে বড় হওয়া। পড়াশোনার বাইরে ফুটবলকে পেশা হিসেবে নিতে তৈরি করেন নিজেকে। এর আগে কোপারহেগেন ফুটবল ক্লাব ও ফিলিপাইনের স্ট্যালিয়ং ফুটবল ক্লাবেও খেলেছেন। আজ জামাল পরিণত হয়েছেন বাংলাদেশের জার্সিতে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলার খেলোয়াড়ে।

অনেকেই আক্ষেপ করেছিলেন জামালের মতো আরও কয়েক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ফুটবলার পাওয়া গেলে জাতীয় দলের শক্তি আরও কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেত। বাফুফে কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। অবশেষে একজনকে পাওয়া যায়। তবে বাফুফের মাধ্যমে নয়। দেশীয় ক্লাব বসুন্ধরা কিংসের মাধ্যমে। তিনি ফিনল্যান্ড প্রবাসী ফুটবলার তারিক রায়হান কাজী। রাইট ব্যাক পজিশনে খেলেন। তারিক তখনই খেলে ফেলেছেন ফিনল্যান্ডের অনূর্ধ্ব-১৭, ১৮ ও ১৯ দলে।

এবং ক্লাব পর্যায়ে তখন খেলেন নিজের জন্মস্থান ট্যাম্পেরে শহরের ক্লাব ইলভেস্ ট্যাম্পেরেতে। ফিনল্যান্ডের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবল ক্লাব এটি। এ ক্লাবের হয়ে ইউরোপা লিগের বাছাইপর্বে একটি ম্যাচও খেলেন। তারিকের বাবার দেশের বাড়ি নওগাঁয়। এই সূত্রে শৈশব থেকেই সেখানে যাতায়াত ছিল তারিকের। এই সুযোগেই তারিকের সন্ধান পায় কিংস। লাল-সবুজের জার্সিতে ২০২১ সালে অভিষেক ঘটে ফিনল্যান্ড প্রবাসী তারিক কাজীর।
গত বছর তৃতীয় প্রবাসী হিসেবে বাংলাদেশ দল সুযোগ মেলে কানাডিয়ান বংশোদ্ভূত সৈয়দ শাহ কাজেমের। তিনি হলেন সাবেক ক্রিকেটার হালিম শাহর ছেলে। কাজেমের জন্ম বাংলাদেশে হলেও বেড়ে উঠেছেন কানাডায়। তাকে নিবন্ধন করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি বাফুফেকে।

এর পেছনে বড় কারণ, কাজেমের জন্ম বাংলাদেশে আর কানাডার হয়ে যুব দলে না খেলা। ২০২৪ সালের ১১ জুন বিশ্বকাপ বাছাইয়ে লেবাননের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক ঘটে এ অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারের। কাতারের খলিফা স্টেডিয়ামে ৭৭ মিনিটে শেখ মোরসালিনের বদলি হিসেবে নেমেছিলেন ২৬ বছর বয়সী এ ফুটবলার।
তবে বাংলাদেশ দলে বড় চমক ইতালিয়ান প্রবাসী ফাহমিদুল ইসলাম। হামজাকে নিয়ে সবাই যখন আলোচনায়, তখনই ভারত ম্যাচের জন্য প্রাথমিক দলে ফাহমিদুলকে অন্তর্ভুক্ত করেন কোচ জাভিয়ের ক্যাবরেরা। ইতালির সিরি-ডি লিগের ক্লাব ওলবিয়া কালসিওর হয়ে লেফট ব্যাক এবং উইং ব্যাক পজিশনে খেলেন ফাহমিদুল। বর্তমানে সৌদি আরবে জাতীয় দলের সঙ্গে অনুশীলনও করেছেন তিনি। গত শুক্রবার অনুশীলনে একসঙ্গে তোলা চার প্রবাসীর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে জামাল ভুঁইয়া লিখেছেন, ‘ওয়েলকাম টু দ্য টিম ফাহমিদুল’।
পাঁচ প্রবাসীর মধ্যে সবার আকর্ষণ হামজাকে ঘিরে। ১৭ মার্চ ইংল্যান্ড থেকে সিলেট হয়ে হবিগঞ্জে ফেরেন শেফিল্ড ইউনাইটেডে খেলা এ ফুটবলার। আজ ঢাকায় ক্যাম্পে যোগ দেয়ার কথা তার। হামজার অপেক্ষায় থাকা পুরো দল সৌদি আরবের তায়েফে কঠোর অনুশীলন করেছে। 
হামজা ইংল্যান্ডে জন্ম ও বেড়ে উঠে হলেও তার মা রাফিয়া চৌধুরী বাংলাদেশী। বাবা গ্রেনাডিয়ান। পরে তার মা এক বাংলাদেশীকে বিয়ে করেন। তিনি পরে দেওয়ান মোরশেদ চৌধুরী। তখন হামজার এক বছর বয়স। হামজা ছাড়াও মোরশেদের আরো তিন সন্তান রয়েছে। বড় ছেলে হামজা, মেয়ে তাসনিম এবং পরে আরও দুই ছেলে মেহেদী ও মাহী। মুসলিম ধর্ম ভালো লেগেছে হামজার। মোরশেদ চৌধুরী ধর্মভীরু মানুষ। তার কাছ থেকেই ভালোমন্দ দেখে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন হামজা। 
ইংল্যান্ডেও বাঙালি আবহে বেড়ে উঠেছেন হামজা। সিলেটি অঞ্চলের কথা বলতে পারেন। হামজার পরিবারের সদস্যরা হবিগঞ্জের বাসিন্দা। ১৯৯৭ সালের ১ অক্টোবর ইংল্যান্ডের লাউগবার্গে জন্ম নেওয়া এ ফুটবলার খেলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। তিনি ২০১৮ সালে ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২১ দলে ডাক পান। ফ্রান্সের মাটিতে একটি টুর্নামেন্টে খেলেন। খেলেন ৭ ম্যাচ। যুব ইউরো বাছাইপর্বের ম্যাচেও অংশ নেই। ইতালিতে হওয়া মূলপর্বেও ছিলেন। লেস্টার সিটি থেকে বর্তমানে যোগ দিয়েছেন শেফিল্ড ইউনাইটেডে।
পাঁচ ফুটবলারই বেড়ে উঠেছেন বাংলাদেশের বাইরে। তবে সন্দেহতীতভাবে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ কেড়ে নিয়েছেন হামজা। যদিও এখনো জাতীয় দলের হয়ে অভিষিক্ত হননি। তারপরও অনেকের দৃষ্টিতেই তিনি নাকি দেশের ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে বড় নক্ষত্র! এতে পরিমস্কারÑবাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ইংল্যান্ড প্রবাসী হামজাকে নিয়ে সবার প্রত্যাশাটা কতটা উঁচুতে। 
এদের মধ্যে ফেনীতে জন্ম নেওয়া ফাহমিদুলকে নিয়েই আলোচনা হয়েছে সবচেয়ে কম। স্পেৎজিয়া-সাম্পদোরিয়ার একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেওয়া ১৮ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড বর্তমানে খেলছেন দেশটির চতুর্থ স্তরের ক্লাব ওলবিয়া কালসিওতে। দল ঘোষণার আগে খুব একটা আলোচনায় ছিলেন না তিনি। তবে ফুটেজ দেখে তাঁকে দলে রাখার উপযুক্ত মনে হয়েছে বাংলাদেশ কোচের, যা এক রহস্যই বটে। ইতোমধ্যেই সৌদি আরবে গিয়ে জাতীয় দলের ক্যাম্প করেছেন তিনি। কিন্তু তাকে আলোচনার বাইরে রাখার চেষ্টা করছেন কোচ।
এছাড়া হামজা-ফাহামিদুলের পথ ধরে আলোচনায় রয়েছেন কানাডিয়ান প্রবাসী সামিত সোম, আমেরিকান প্রবাসী কুইন সুলিভান, সুইডিশ প্রবাসী ম্যাক্স রহমানরা। ভবিষ্যতে হয়তো তাঁদের উপস্থিতি দেখা যেতে পারে।
গত বছরের ২০ ডিসেম্বর নিজ বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল জানিয়েছিলেন, হামজার মতো আরও প্রবাসী বাংলাদেশী ফুটবলারদের চান তারা, ‘সবকিছুরই একটা ধারাবাহিকতা থাকে। এক দশক আগে জামালের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। এর ফলে এখন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ফুটবলার বাংলাদেশ দলে। সামনে হয়তো বাংলাদেশের কেউ বড় কোনো লিগে খেলার সুযোগ পাবে।

আশা করছি হামজার মতো অন্য প্রবাসী যারা খেলছেন, তাদের আরও চিহ্নিত করে বাংলাদেশ দলে খেলার জন্য অনুপ্রাণিত করতে পারব। বাফুফে চেষ্টা করবে খেলোয়াড়দের নিয়ে নানান তথ্য দিতে। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের অনেক মেধা আছে। দেশের বাইরে, ইতালিয়ান, জার্মানি কিংবা দক্ষিণ আমেরিকান যারাই আছেন, আমি বিশ্বাস করি হামজা তাদের অনুপ্রেরণা জোগাবেন বাংলাদেশের জার্সি গায়ে খেলার জন্য।’
জানা গেছে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আরও ৩০ ফুটবলারের সঙ্গে কথা বলার কাজ করে যাচ্ছে বাফুফে।
২৫ মার্চ শিলংয়ে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে এই পাঁচ প্রবাসী একসঙ্গে খেলার সুযোগ পান বা না পান বাংলাদেশের ফুটবলে এখন বড় আলোচনায় তারা। তারাই কি হতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের ফুটবলের ‘আগামীর পঞ্চপা-ব’? এই প্রবাসী পঞ্চপা-ব ঘিরেই নতুন ও বড় স্বপ্ন দেখছেন ফুটবলপ্রেমীরা। সেই স্বপ্ন হচ্ছে র‌্যাঙ্কিংয়ে উন্নতি ও সাফ অঞ্চলে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন। সেই স্বপ্ন কতটা সফল হবে, সেটা সময়ই বলে দেবে।

×