ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৮ মার্চ ২০২৫, ৩ চৈত্র ১৪৩১

বাংলাদেশের বুকে হামজা, ভালোবাসায় বরণ

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০০:৪২, ১৮ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশের বুকে হামজা, ভালোবাসায় বরণ

হামজা চৌধুরীর বাংলাদেশে আসার দৃশ্য

তাকে নিয়ে শুরুতে কৌতূহল ছিল। পরে যতদিন গেছে, ততটা তা ডালপালা মেলে রূপ নিয়েছে তীব্র আগ্রহে। সবশেষে সোমবার তা পরিণত হয়েছে উন্মাদনায়। তিনি এলেন এবং দেখলেন। এবার বাকি আছে ‘জয়’ করাটা। সেটাও যে করতে পারবেন, তা উড়ালঙ্খী থেকে নেমেই একবুক আত্মবিশ্বাস নিয়ে উচ্চারণ করেছেন।

যাকে নিয়ে এত কথার অবতারণা, তিনি আর কেউ নন, হামজা দেওয়ান চৌধুরী। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের অতি পরিচিত মুখ। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। বয়স ২৭। বিচিত্র চুলের স্টাইলের অধিকারী। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশের পাসপোর্ট পাওয়ার পর ফিফা থেকে অনুমতিও পেয়েছেন প্রিয় বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার জন্য। ব্রিটিশ প্রবাসী এই ফুটবলারের স্বপ্নপূরণ হতে যাচ্ছে আগামী ২৫ মার্চ।

এএফসি এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে ভারতের বিরুদ্ধে এদিন তিনি লাল-সবুজের জার্সিতে অভিষিক্ত হবেন শিলংয়ের মাটিতে। আর সে উপলক্ষেই সোমবার পা রেখেছেন প্রিয় শিকড়ে। এর ফলে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের অপেক্ষার অবসান হয়েছে। ইংল্যান্ড থেকে বিমানযোগে প্রথম অবতরণ করেন সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। তারপর সেখান থেকে সপরিবারে সড়কপথে (ছাদখোলা গাড়িতে) চলে যান নিজ গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের বাহুবল থানার স্নানঘাটে।

তার বাবা মোরশেদ দেওয়ান চৌধুরী জানিয়েছেন, স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে সময় কাটাবেন হামজা। ইফতার বিতরণ করবেন গরিবদের মধ্যে। হামজা নিজে একটি এতিমখানা চালান। সেই এতিমখানায় ইফতারি বিতরণ করে ফিরবেন বাড়িতে। বাফুফে সিলেট ও হবিগঞ্জ উভয় জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে হামজার নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করে। সিলেট থেকে এই গাড়িতে তার হবিগঞ্জের বাড়িতে যেতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লাগে।
হামজাকে যেভাবে বরণ করল বাফুফে ॥ এর আগেও সিলেট এসেছেন হামজা চৌধুরী। তখন মাতামাতি হয়নি তেমন। তবে এবার হামজার দেশে আসার পর থেকে যেটা হয়েছে, তা হলো ¯্রফে ‘উন্মাদনা’। কারণটা সহজেই অনুমেয়। সোমবার বেলা পৌনে ১২টায় বিমানবন্দরে অবতরণ করে হামজাকে বহনকারী বিমান।

বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার পর তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন বাফুফের কর্মকর্তারা। তাকে উষ্ণ ভালোবাসায় বরণ করে নিতে সকাল থেকেই ভিড় করেন বিপুলসংখ্যক ফুটবলপ্রেমী, গণমাধ্যমকর্মী ও ইউটিউবার। তাকে দেখে স্লোগানে মাতিয়ে তোলেন ভক্তরা। হামজার সঙ্গে আসেন তার স্ত্রী, সন্তান ও মা।
বাফুফে হামজার জন্য ভিআইপির ব্যবস্থা রেখেছিল। সিলেট বিমানবন্দরে হামজাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশ বিমানের স্টেশন ম্যানেজার শাকিল আহমেদ। ভিআইপি এরিয়ার মধ্যেও বেশ জমায়েত হয়। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত সকল গণমাধ্যমের প্রতিনিধিই সিলেট বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে কাজ করা অনেকেও ছিলেন।

ফলে হামজার মিডিয়া সেশন পরিচালনা করতে বাফুফে সদস্যদের বেশ গলদঘর্ম হয়। তারা ছিলেন ৭ নির্বাহী সদস্য- সাখাওয়াত হোসেন ভুইয়া শাহীন, কামরুল ইসলাম হিল্টন, গোলাম গাউস, ইকবাল হোসেন, সত্যজিৎ দাশ রুপু, ইমতিয়াজ হামিদ সবুজ ও মঞ্জুরুল করিম। তারা হামজাকে ফুল দিয়ে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। তখন হামজার সঙ্গে ছিলেন তার বাবা মোরশেদ দেওয়ান চৌধুরী।
হামজাকে একনজর দেখতে বিমানবন্দরে ভক্তদের উপচেপড়া ভিড় ॥ বহুল আলোচিত ফুটবলার হামজাকে এক নজর দেখতে সিলেট বিমানবন্দরের বাইরে প্রচুর সমর্থক-ফুটবলপ্রেমীর উপচেপড়া ঢল ছিল লক্ষ্যণীয়। কেউ কেউ ব্যানার নিয়ে দাঁড়ান। তাদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা-রোমাঞ্চ। দেন ‘হামজা, হামজা’ স্লোগান।  
শেফিল্ডকে জিতিয়েই প্লেনে চাপেন হামজা ॥ ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার থেকে বাংলাদেশের সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হন হামজা। বাফুফে বাংলাদেশ সময় বরিবার দিবাগত রাত তিনটার দিকে তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে হামজার দেশে আসার একটি ছবি পোস্ট করে। ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে রবিবার দুপুরে লিডস ও শেফিল্ড ইউনাইটেডের মধ্যে ম্যাচ ছিল। সেই ম্যাচে হামজার শেফিল্ড ১-০ গোলে জয়লাভ করে। ওই ম্যাচে হামজা পুরো ৯০ মিনিটই খেলেন। সেই ম্যাচ খেলার কয়েক ঘণ্টা পরই হামজা সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হন বিমানযোগে (বিজনেস ক্লাসে)।

হামজার কারণেই চুক্তি স্বাক্ষর ॥ বাফুফের চাওয়া ছিল ১৮ মার্চ রাতে ঢাকায় ক্যাম্পে যোগদান করুক হামজা। কিন্তু হামজার মায়ের চাওয়া আরও একটি রাত হবিগঞ্জে নিজের বাড়িতে কাটাক হামজা। বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়াল এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন।

প্রবাসী ফুটবলারদের বাংলাদেশের জার্সিতে খেলানোর পেছনে ফেডারেশনের ব্যয়ও রয়েছে। হামজার এই সফরে ইউসিবি ব্যাংকের সহায়তা পেয়েছে বাফুফে, এটা তারা নিশ্চিত করেছে। মোট কথা হামজা আসার কারণেই বাফুফের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরে রাজি হয় ইউসিবি।
হবিগঞ্জে জনসমুদ্র; হামজার নিজ বাড়িতে সংবর্ধনা ॥ হামজার জন্য না হলেও তার স্ত্রী, সন্তানদের জন্য এটাই প্রথম বাংলাদেশ সফর। হামজার বিদেশী বধূকে বরণে ব্যাপক আয়োজন করেন তার স্বজনরা। হামজার বাড়িকে সাজানো হয় বর্ণিল সাজে। বাড়ির প্রবেশপথসহ পথে পথে তোরণ নির্মাণ করা হয়। পোস্টার, ফেস্টুন, লাইটিং ... সবই ছিল।

আগত অতিথিদের ইফতারও করানো হয়। বাড়ির পাশে খালি জায়গায় ছোট একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়। সেখানে ছোট্ট পরিসরে তিনি আগত অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। ২০১৪ সালে সর্বশেষ দেশে এসেছিলেন হামজা। ২০২২ সালে তিনি বিয়ে করেন। এরপর আর তার দেশে আসা হয়নি।

এবার হামজা আগমনে শুধু তার গ্রামের বাড়ি নয়, পুরো জেলাজুড়ে মানুষের মাঝে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। এক ফাঁকে সবার আগ্রহ মিটিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে এসে হামজা বলেন, ‘আমার খুব ভাল লাগছে। আফনারা সবাই আসছেন আমাকে দেখবার লাগি। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।’
ক্লান্তিতে সংবর্ধনার আয়োজন বাতিল ॥ হামজার বাবা মোরশেদের আপত্তিতে হামজাকে হবিগঞ্জে সংবর্ধনার অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়। কারণ হিসেবে রমজান মাসের কথা উল্লেখ করা হয়। তাছাড়া হামজা দীর্ঘ বিমানযাত্রা করে আসায় ছিলেন স্বভাবতই ক্লান্ত। এর পরিবর্তে স্বল্প পরিসরে মঞ্চে উঠে আগত অতিথিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন হামজা। 
ক্রীড়া উপদেষ্টা, ক্রিকেটারসহ ক্রীড়াঙ্গনের তারকাদের শুভকামনা ॥ হামজার আগমনে উচ্ছ্বসিত দেশের ক্রীড়াঙ্গনও। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বলেছেন, বাংলাদেশের ফুটবলের উন্মোচিত হোক নতুন দুয়ার। লাল-সবুজ জার্সিতে হামজা চৌধুরীকে স্বাগত।

ক্রিকেটার রিশাদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে আপনাকে স্বাগতম। অনেক অনেক শুভ কামনা। এগিয়ে যাক বাংলাদেশের ফুটবল। জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক সাবিনা খাতুন বলেন, ওয়েলকাম হোম, ম্যান। জাতীয় দলের ফুটবলার ঋতুপর্না চাকমা বলেন, ওয়েলকাম টু বাংলাদেশ হামজা চৌধুরী। 
কে এই হামজা ॥ হামজা ইংল্যান্ডে জন্ম ও বেড়ে ওঠা হলেও তার মা রাফিয়া চৌধুরী বাংলাদেশী। বাবা গ্রেনাডিয়ান। পরে তার মা এক বাংলাদেশীকে বিয়ে করেন। তিনি পরে দেওয়ান মোরশেদ চৌধুরী। তখন হামজার এক বছর বয়স। হামজা ছাড়াও মোরশেদের আরও তিন সন্তান রয়েছে।

বড় ছেলে হামজা, মেয়ে তাসনিম এবং পরে আরও দুই ছেলে মেহেদী ও মাহী। মুসলিম ধর্ম ভালো লেগেছে হামজার। মোরশেদ চৌধুরী ধর্মভীরু মানুষ। তার কাছ থেকেই ভালোমন্দ দেখে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন হামজা। 
ইংল্যান্ডেও বাঙালি আবহে বেড়ে উঠেছেন হামজা। সিলেটী অঞ্চলের কথা বলতে পারেন। হামজার পরিবারের সদস্যরা হবিগঞ্জের বাসিন্দা। ১৯৯৭ সালের ১ অক্টোবর ইংল্যান্ডের লাউগবার্গে জন্ম নেওয়া এ ফুটবলার খেলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। তিনি ২০১৮ সালে ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২১ দলে ডাক পান। ফ্রান্সের মাটিতে একটি টুর্নামেন্টে খেলেন। খেলেন ৭ ম্যাচ। যুব ইউরো বাছাইপর্বের ম্যাচেও অংশ নেন। ইতালিতে হওয়া মূলপর্বেও ছিলেন।

×