
হামজা চৌধুরী ও সুনীল ছেত্রী
ফুটবলে সবসময়ই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ ও ভারত। ইদানীং অবশ্য ক্রিকেটেও দুদেশের লড়াইয়ে থাকে ¯œায়ুর লড়াই। ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আনলে ভারতের সঙ্গে যে কোনো বিষয়ে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা কিংবা টক্কর লক্ষ্য করা যায়। নিকট ভবিষ্যতে এমন আরেকটি লড়াই উপভোগ করতে চলেছে দুদেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা।
কেননা প্রতিবেশী দুই দেশ আরও একবার মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষায়। এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ম্যাচে আগামী ২৫ মার্চ মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ ও ভারত। ম্যাচটি সামনে রেখে দুই দেশের দুই বড় তারকা হামজা চৌধুরী ও সুনীল ছেত্রীর শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইও সামনে চলে এসেছে।
অনেক অপেক্ষার পর ইংলিশ ফুটবলের অপরিহার্য তারকা হামজার ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক হবে। আর তারকা এ ফুটবলারের আগমনে কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে ভারতের। যে কারণে তারা তাদের অবসরে যাওয়া ‘বুড়ো’ তারকা সুনীল ছেত্রীকে অবসর ভেঙে ফের দলে ভিড়িয়েছে। আর তাই শিলংয়ে হতে যাওয়া ম্যাচে নিশ্চিত করেই হামজা ও সুনীলের দিকেও বাড়তি নজর থাকবে ফুটবল দুনিয়ার।
নিঃসন্দেহে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। বাংলাদেশের খেলাপাগল মানুষও এ খেলাটাকে ভীষণ ভালোবাসেন, পছন্দ করেন। আশি-নব্বইয়ের দশকে ঢাকা ও মিরপুর স্টেডিয়ামে দর্শক ঢলের কথা এখনো রোমান্থন করেন অনেকে। কালের বিবর্তনে নানা অব্যবস্থাপনা আর খেলার পড়তি মানের কারণে ফুটবল থেকে অনেক মুখ ফিরিয়েছে নিয়েছেন!
কিন্তু তারা মনেপ্রাণে চান, দেশে আমজনতার এ খেলার ধার আবার বাড়ুক। দেশের নারী ফুটবলাররা চোখ ধাঁধানো ধারাবাহিক সাফল্য পেলেও পুরুষ দলের অবস্থা রুগ্ন। জামাল-তপুদের অবস্থা অনেকটা তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠা-নামার মতো। দুই ধাপ এগিয়ে গেলে পরক্ষণেই পাঁচ ধাপ পিছিয়ে পড়ে।
এমন অবস্থায় দেশের ফুটবলের মান উন্নয়নে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) বিদেশী বংশোদ্ভূত ফুটবলারদের দিকে দৃষ্টি দিয়েছে। এ তালিকায় সবশেষ সংযোজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ তারকা হামজা দেওয়ান চৌধুরী। অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০২৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর ২৭ বছর বয়সী হামজার লাল-সবুজের জার্স গায়ে খেলা নিশ্চিত হয়েছে।
হামজাকে পেয়ে দেশের ফুটবলে কিছুটা সুবাতাস বইছে। ইংল্যান্ডের হয়ে ২০১৯ সালে অনূর্ধ্ব-২১ বিশ্বকাপে খেলা হামজা এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় তারকা। তার ছোঁয়ায় নতুন বাংলাদেশে ফুটবল বদলে যাবে বলে বিশ্বাস সংশ্লিষ্টদের। সব আনুষ্ঠানিকতা যদি যথাসময়েই শেষ করা যেত, তাহলে গত নভেম্বরেই ঢাকায় মালদ্বীপের বিরুদ্ধে দুটি আন্তর্জাতিক ফিফা প্রীতি ম্যাচে বাংলাদেশের জার্সিতে খেলতে পারতেন হামজা।
হামজার জন্ম নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট তৈরির পর ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ছাড়পত্রও পাওয়া গিয়েছিল তখন। কিন্তু ফিফার প্লেয়ার্স স্ট্যাটাস কমিটির অনুমোদন পেতেই দেরি হয়। ফিফা হামজার বিষয়ে অতিরিক্ত কিছু ডকুমেন্টস চেয়েছিল। হামজার মা বাংলাদেশী হলেও বাবা গ্রেনাডিয়ান। তার পরিবারের সদস্যরা সিলেটের বাসিন্দা।
১৯৯৭ সালের ১ অক্টোবর ইংল্যান্ডের লাউগবার্গে জন্ম নেওয়া এ ফুটবলার খেলেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে। তিনি ২০১৮ সালে ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-২১ দলে ডাক পান। পরের বছর ফ্রান্সের মাটিতে একটি টুর্নামেন্টে খেলেন। খেলেন ৭ ম্যাচ। যুব ইউরো বাছাইপর্বের ম্যাচেও খেলেছেন। ইতালিতে হওয়া মূলপর্বেও ছিলেন। সেই হামজা এখন বাংলাদেশের।
ডিফেন্সিভ এ মিডফিল্ডার বাংলাদেশের জার্সিতে খেলতে উন্মুখ হয়ে আছেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ ফুটবলপাগল। আশা করছি আরও বেশি বাংলাদেশী ফুটবলারের জন্য ইউরোপ বা এর শীর্ষ পাঁচ লিগে খেলার পথটা তৈরি করে দিতে পারব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বয়সভিত্তিক ফুটবল উন্নয়নের কাঠামো তৈরিতে স্থানীয় ফুটবল ক্লাবগুলোর সঙ্গে কাজ করতে পারব বলেও আশাকরি।
এটা হয়তো এক ধরনের ভুল ধারণা যে ক্রিকেটই বাংলাদেশের প্রধান খেলা। তবে ক্রিকেটে সাফল্য বেশি এসেছে। তবু আমার মনে হয়, সবার মূল খেলা ফুটবলই। যেটা ওরা দেখতে আর খেলতে পছন্দ করে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের ভক্তদের সঙ্গে আমার ভালো একটা সংযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিনই আমি তাদের কাছ থেকে বার্তা পাই, তারা চায় আমি দেশে এসে যেন খেলি। আমিও চাই ফুটবল বিশ্বে বাংলাদেশকে আরও ভালোভাবে তুলে ধরতে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের হয়ে খেলতে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি। আশা করছি শীঘ্রই দেখা হবে’।
হামজার বাংলাদেশের হয়ে খেলার বিষয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াও। ডেনমার্ক প্রবাসী এ ফুটবলার বলেন, ‘আমরা গত দেড় বছর হামজার জন্য অপেক্ষা করেছি। শেষ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের হয়ে খেলার অনুমতি পেয়েছেন। আমি মনে করি দলের সবার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে। সত্যি বলতে কী, হামজার মানের কোনো খেলোয়াড় বাংলাদেশে নেই। তিনি আসলে অবশ্যই এটা দলের জন্য ভালো।’
২০১৩ সালে প্রথম প্রবাসী ফুটবলার হিসেবে লাল-সবুজের জার্সিতে অভিষেক হয় জামালের। কয়েক বছর আগে ফিনল্যান্ড প্রবাসী তোরিক কাজীও গায়ে জড়িয়েছেন বাংলাদেশের জার্সি। হামজা চৌধুরী তৃতীয় প্রবাসী হিসেবে খেলার অপেক্ষায়। তাঁর মতো হাই-প্রোফাইল ফুটবলার নেই বাংলাদেশে। এ কারণেই হামজাকে নিয়ে বেশি রোমাঞ্চিত জামাল, ‘বাংলাদেশ দলের জন্য এটা ইতিবাচক বিষয় (হামজার ছাড়পত্র পাওয়া)।
কারণ বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা একজন ফুটবলার বাংলাদেশের হয়ে খেলবেন, এটা তো অনেক বড় ব্যাপার। আমি বলব, এ রকম আরও অনেক ফুটবলার দরকার আছে বাংলাদেশের। আপনি যদি দেখেন ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কার মতো দেশে প্রবাসীরা খেলছেন। তারা অনেক উন্নতি করেছে। আমি তো চাই, বাংলাদেশও উন্নতি করুক।
একজন ফুটবলার হিসেবে আমিও চাই, হামজার মতো ভালো খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলতে।’ হামজার খেলা নিশ্চিত হওয়ায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক পোস্টে হামজাকে স্বাগত জানিয়েছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা। সেখানে তিনি লিখেন, ‘লাল-সবুজ তোমার হয়ে চিৎকার করতে প্রস্তুত হামজা। বাংলাদেশে স্বাগতম, যেখানে ফুটবলের স্বপ্ন এখনো টিকে আছে।’
২৫ বছর ধরে ভারতের বিপক্ষে কোন জয় নেই বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের। ২৫ মার্চ দীর্ঘ সেই ২৫ বছরের আক্ষেপ দূর হতে পারে লাল-সবুজ বাহিনীর। কেননা তাদের আছে হামজা চৌধুরীর মতো তারকা ফুটবলার। তাকে ঘিরে এখন বাংলাদেশ বড় স্বপ্ন বুনছে। তবে বাংলাদেশকে থামিয়ে দেয়ার ছক কষছে ভারতও। এরই অংশ হিসেবে তারা আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর ঘোষণার মাত্র ৮ মাসের মধ্যে অবারও ফিরিয়ে এনেছে সুনীল ছেত্রীকে।
৪০ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ড ভারতীয় ফুটবল শুধু নন, দেশটির পুরো ক্রীড়াঙ্গনেরই কিংবদন্তি। অবসর ঘোষণার আগে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ১৯ বছরে ১৫০টি ম্যাচ খেলেছেন সুনীল। যেখানে তিনি ৯৪টি গোল করেছেন, যা ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ এবং জাতীয় দলের জার্সিতে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ গোল। আন্তর্জাতিক ফুটবল ছাড়লেও ক্লাবের হয়ে খেলছিলেন।
এর মধ্যেই আবারও ফিরছেন জাতীয় দলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশীদের অনেকেই দাবি করেছেন, হামজার আগমনে ভীত হয়ে দলের হার ঠেকাতেই সুনীলকে অবসর থেকে ফেরানো হয়েছে। যদিও ভারত বা সুনীল এমন অভিযোগ নিয়ে মুখ খোলেননি।
সুনীল ছেত্রী খেলা মানেই আতঙ্ক বাংলাদেশের জন্য। বাংলাদেশি ক্লাব ও জাতীয় দলের বিপক্ষে সব মিলিয়ে সুনীল ছেত্রী ১১টি ম্যাচে খেলেছেন। এর মধ্যে গোল করেছেন ৮টি। যেখানে জাতীয় দলের হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গোল করেছেন ৬টি। আরও আছে ৩টি অ্যাসিস্ট। এর মধ্যে ভারতের জয় ৫টিতে। শেষ মুহূর্তে ভারতের হয়ে গোল করে বাংলাদেশের কাছ থেকে জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন একাধিকবার। ২০০২ সালে মোহনবাগানের হয়ে খেলে পেশাদার ফুটবলজীবন শুরু হয়েছিল সুনীলের।
এখনো আইএসএলে খেলেন ব্যাঙ্গালুরু এফসির হয়ে। ২০০৭, ২০০৯ ও ২০১২ সালে ভারতের নেহেরু কাপ জয়ের অন্যতম কান্ডারি ছিলেন সুনীল। চার বার (২০১১, ২০১৫, ২০২১, ২০২৩) জিতেছেন সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। ২০০৮ সালে ভারতকে এফসি চ্যালেঞ্জ কাপও জিতিয়েছেন বিশ্বের অন্যতম চৌকষ এই ফরোয়ার্ড। বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচে তাই পার্থক্য গড়ে দিতে পারেন দুই দেশের দুই বড় তারকা হামজা ও সুনীল।