
এবারের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে অংশগ্রহণকারী সব দলকে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও পাকিস্তানে ছোটাছুটি করতে হয়েছে
ক্রিকেটে ভারতের এমন আচরণকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে তুলনা করা যায়! গাজাবাসীর অধিকার ও শান্তির জন্য নয়, গাজা যুদ্ধ বন্ধ করে সেখানে প্রমোদের জন্য পর্যটন জোন গড়ে তুলতে চান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ইউক্রেন যুদ্ধ থামিয়ে সেখান থেকে তুলে আনতে চান মূল্যবান খনিজ সম্পদ।
বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইন্টারন্যাশানল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি) যতই বিশ্বব্যাপী খেলাটি ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করুক, তার নেপথ্যে থাকছে ভারতের সুবিধা। দিনের পর দিন মোড়ল দেশটির ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) আচরণ এবং আইসিসির ওপর তাদের নির্লজ্জ প্রভাব রীতিমতো ‘অনৈতিক’ পরিস্থিতিতে রূপ নিয়েছে। এবারের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে।
অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দীর্ঘ ২৯ বছর পর আইসিসির কোনো বৈষয়িক টুর্নামেন্টে আয়োজক হওয়ার সুযোগ পেয়েছে পাকিস্তান। বিভিন্ন দেশের ক্রিকেটারদের জন্য অনেক অর্থ খরচ করে, বিদেশী রাষ্ট্র প্রধানদের যেমন নিরাপত্তা দেওয়া হয় ঠিক তেমন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে পাকিস্তান সরকার। এরপরও ভারত সেখানে না গিয়ে অভিনব ‘হাইব্রিড’ মডেলে তাদের ম্যাচগুলো খেলছে দুবাইয়ে। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা সেমিতে উঠেও জানতে পারেনি তাদের ম্যাচ কোথায়! ফলে দুটি দলকেই দুবাইয়ে এসে বসে থাকতে হয়!
একদিন অনুশীলন করেই দক্ষিণ আফ্রিকাকে আবার লাহোরে ফিরে যেতে হয়েছে। গত রবিবারের দৃশ্যপটে ফেরা যাক: চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল সামনে রেখে দুই সেমিফাইনালিস্ট অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সম্মুখীন। দু’দলই দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে উড়াল দেয়, তবে নিশ্চিত নয় সেখানেই ম্যাচ খেলা হবে কিনা!
ভারতের পাকিস্তানে না খেলার সিদ্ধান্তের কারণে সেমিফাইনালের ভেন্যু নিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, যার ফলে এই দুই দলকে এক অনিশ্চিত যাত্রার মুখে পড়তে হয়েছে। আইসিসির সূচি অনুযায়ী, প্রথম সেমিফাইনাল ছিল মঙ্গলবার দুবাইয়ে এবং দ্বিতীয়টি আজ (বুধবার) লাহোরে। কিন্তু ভারতের গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ফলাফলের ওপর নির্ভর করছিল ফিক্সার। ফলে, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে আগেভাগেই দুবাইয়ে উড়িয়ে আন হয়েছিল।
অথচ ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রোটিয়াদের আবার পাকিস্তানে ফেরত আসতে হয়েছে! গত শনিবার লাহোর থেকে তিন ঘণ্টার ফ্লাইটে দুবাই আসে অস্ট্রেলিয়া, তবে তারা যদি ভারতের মুখোমুখি না হতো, তাহলে সোমবারই আবার পাকিস্তানে ফিরতে হতো। যেভাবে দক্ষিণ আফ্রিকাও রবিবার দুবাই উড়ে আসে, কিন্তু একদিনের মধ্যেই তাদের লাহোরে ফিরতে হয়েছে। এই সূচির বিশৃঙ্খলা নিয়ে সমালোচনা ঝড় উঠেছে, বিশেষ করে যখন দেখা যাচ্ছে ভারত সব ম্যাচ দুবাইতে খেলে সুবিধা পাচ্ছে, অথচ অন্য দলগুলো অনিশ্চিত ভ্রমণে ব্যস্ত।
এর আগে ২০২৩ এশিয়া কাপেও ঠিক এভাবে ভারত তাদের ম্যাচগুলো শ্রীলঙ্কায় খেলেছিল। বৃষ্টির কারণে তাদের একটি ম্যাচে তো অনির্ধারিত ‘রিজার্ভ ডে’র ব্যবস্থাও করা হয়েছিল! একটা দেশকে একক সুবিধা দেওয়ার কথা ফুটবলে কল্পনাই করা যায় না। চুন থেকে পান খসলে পড়তে হয় শাস্তির মুখে। সেখানে আইসিসির ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপে বিশ্বব্যাপী খেলাটির গ্রহণযোগ্যতাকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে ইন্ডিয়ান বোর্ড (বিসিসিআই)।
সব দলকেই ভারতের বিপক্ষে খেলতে পাকিস্তান থেকে দুবাইয়ে যেতে হয়েছে। একমাত্র দেশ হিসেবে ভারত নিজেদের সব ম্যাচ খেলছে একই মাঠে। সমালোচনায় মুখর হয়েছেন ইংল্যান্ডের দুই সাবেক অধিনায়ক নাসের হুসেইন ও মাইক আথারটন। এক্সÑএ এক পোস্ট নাসের লিখেছেন, ‘এটা বাড়তি সুবিধা।
সেরা দলটির জন্য টুর্নামেন্টে এমন সুবিধা...আমি আগের দিন একটি টুইট দেখলাম, ‘পাকিস্তান স্বাগতিক, কিন্তু ঘরের মাঠের সুবিধাটা পাচ্ছে ভারত।’ এটুকুতেই আসলে সবকিছু বোঝা যায়। ‘অন্য সব দলকেই (দল) সাজাতে হয়েছে কয়েকটি ভেন্যু মাথায় রেখেÑকরাচি, লাহোর, রাউয়ালপিন্ডি দুবাই।
তাদের ভ্রমণ করতে হচ্ছে আর এসব কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে।’ অসহায় নাসের, ‘এটা একটা বাড়তি সুবিধা, কিন্তু আপনি আর কী করতে পারবেন? যখন একবার ভারত বলবে, ‘আমরা পাকিস্তানে যাব না’, তখন আইসিসির কী করার থাকে? ভারত-পাকিস্তান ছাড়া আপনি এ ধরনের টুর্নামেন্ট করতে পারবেন না। তারা খুশি মনে ও স্বাচ্ছন্দ্যে দুবাইয়ে বসে থাকবে যে ছয় ম্যাচই এখানে হবে, যদি তারা জিতে যায়, তাহলে আরও একটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট জিতে যাবে!’
আথারটনও মনে করেন, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে ভারত, ‘শুধু দুবাইয়ে খেলার যে সুবিধা পাচ্ছে ভারত, যেটা আমার চোখে পরিমাপ করা কঠিন হলেও তা অনস্বীকার্য সুবিধা।’ এরপর তিনি বলেন, ‘তারা শুধু একটি ভেন্যুতেই খেলছে। অন্য কোনো ভেন্যু কিংবা দেশে তাদের ভ্রমণ করতে হচ্ছে না, যেটা অন্য দলগুলো করছে।
অর্থাৎ শুধু দুবাইয়ের কন্ডিশন নিয়েই ভাবতে পারছে (ভারতের) নির্বাচকরা। তারা সেখানে সেমিফাইনাল খেলবে আর সেটা পার হলে, তা আমার কাছে অনস্বীকার্য সুবিধাই।’ এমন তেতো সত্য গিলতে পারেননি সুনীল গাভাস্কার। ভারতীয় লিজেন্ড তো রীতিমতো ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসেছেন। রাজস্ব আয়ের দিক থেকে বিশ্ব ক্রিকেটে ভারতের অবদান তুলে ধরে সাবেক ক্রিকেটার-বিশেষজ্ঞদের উদ্দেশ্যে বলেন, তাদের বেতনের একটি বড় অংশ নির্ভর করে ভারতের আয়ের ওপর, ‘আমি আগেই বলেছি, এটা মন্তব্য করার মতোও বিষয় নয়। আসলেই তা নয়। তারা সবসময় হা হুতাশ করে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ভারত এখন মানের দিক থেকে, আয়ের দিক থেকে, প্রতিভার দিক থেকে, বিশেষ করে অর্থ আয়ের দিক থেকে কোন জায়গায় আছে, সেটা তারা বুঝতে পারে না। টেলিভিশনের সম্প্রচার স্বত্ব ও মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত আয়ের মাধ্যমে বৈশ্বিক ক্রিকেটে ভারতের বড় অবদান রয়েছে। তাদের বুঝতে হবে, বিশ্ব ক্রিকেটে ভারতের যে অবদান, তার ওপর তাদের বেতন নির্ভর করে।’
গাভাস্কার সেখানেই থামেননি বললেন, তাদের নিজেদের দল নিয়ে ভাবা উচিত, ‘আমার মনে হয়, তারা সবাই জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ। আপনাদের দল ইংল্যান্ড (সেমি-ফাইনালে) উঠতে পারল না কেন, সে দিকে নজর দিচ্ছেন না কেন? আপনাদের এই প্রশ্নটাই করছি, স্যার। প্রতিনিয়ত ভারতের দিয়ে মনোযোগ কথা না দিয়ে আপনারা কি নিজেদের (দলের) দিকে তাকাচ্ছেন?
আপনার খেলোয়াড়রা এতটা ভঙ্গুর মানসিক অবস্থার মধ্যে রয়েছে- কোনো নির্দিষ্ট প্রত্যাশা পূরণ করার আগ পর্যন্ত তারা ফলাফলের বিষয়ে চিন্তা করে বলে মনে হয় না। আপনাদের ফলাফল নিয়ে ভাবতে হবে। আপনাদের নিজেদের দেশের ক্রিকেট নিয়ে ভাবতে হবে, যে দলের জন্য খেলছেন, তাদের নিয়ে ভাবতে হবে। যদি দেশের জন্য খেলেন, তাহলে দায়িত্বটা আরও বড়।
সবসময়ই দেখি তারা হা হুতাশ করে- ‘ভারত এটা করেছে, ভারত ওটা করেছে, ’প্রতিনিয়ত চলতে থাকে। আমাদের এখন এসব অগ্রাহ্য করার সময় এসেছে। তারা হা হুতাশ করুক। আমাদের মনোযোগ দেওয়ার আরও ভালো বিষয় আছে, এ ধরনের মনোভাব থাকা উচিত।’
শুধু সাবেকরাই নন, দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটর ভ্যান ডার ডুসেনও বলছেন, ‘এটা নিশ্চিতভাবেই সুবিধা। আমি দেখেছি পাকিস্তান এ নিয়ে মন্তব্য করছে। এটা অবশ্যই একটা সুবিধা। আপনি যদি একটা জায়গায় থাকেন, একই হোটেলে অবস্থান করেন, একই সুবিধা নিয়ে অনুশীলন করেন, একই স্টেডিয়ামে এবং একই উইকেটে খেলেন, সেটা তো অবশ্যই সুবিধা। আমার মনে হয় না এটা বোঝার জন্য রকেটবিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন আছে।’ এর আগে ভারতের সুবিধা পাওয়া নিয়ে কথা বলেছেন পাকিস্তান কোচ আকিব জাভেদও।