
স্মরণীয় সাফল্যের উচ্ছ্বাস আফগানিস্তানের তারকা ক্রিকেটার মোহাম্মদ নবী-রশিদ খানদের
অদম্য আফগানিস্তানের জন্য কোনো বিশেষণই যথেষ্ট নয়। বিনোদনের নির্মল মাধ্যম ক্রীড়াঙ্গন। সেখানে ক্রিকেট দিয়ে তারা জয় করে নিয়েছে গোটা দুনিয়ার মানুষের হৃদয়। নানা কারণে বিধ্বস্ত দেশটি কয়েক বছর ধরেই অসাধারণ ক্রিকেট উপহার দিয়ে চলেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালে টি২০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলে আফগানরা। এবার পাকিস্তান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলমান আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও চমক দেখিয়েছেন মোহাম্মদ নবী-রশিদ খানরা।
আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এবারই প্রথম অংশ নিয়েছে আফগানিস্তান। আর অভিষেকেই নিজেদের দারুণভাবে মেলে ধরেন দেশটির তারকারা। তিন ম্যাচের একটিতে জয়, একটিতে হার ও বৃষ্টির কারণে অন্যটিতে পয়েন্ট ভাগাভাগি করে তারা। এর ফলে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে ওঠার জন্য আফগানিস্তানের সামনে ছিল প্রায় অসম্ভব সমীকরণ। সেটাও নিজেদের হাতে ছিল না। তাদেরকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছিল ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার ম্যাচের দিকে।
সেই ম্যাচে হিসাব তাদের পক্ষে থাকেনি। যে কারণে সেমির সম্ভাবনা জাগিয়েও বিদায় নিতে হয়েছে। কিন্তু গ্রুপ পর্বে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে নিজেদের সাফল্যের গ্রাফটা ঠিকই ঊর্ধ্বমুখী করেছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি। গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলেও এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আফগানিস্তানের খেলা সবার নজর কেড়েছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে লড়াকু পুঁজি গড়ার আগে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩২৫ রান তুলে ম্যাচ জয় করে তারা।
এর আগে ২০২৩ বিশ্বকাপেও একই দলকে হারিয়েছিল তারা। জাগিয়েছিল সেমিফাইনালের সম্ভাবনা। ২০২৪ সালে টি২০ বিশ্বকাপে তো নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে সেমিফাইনালেও খেলেছে দলটি। সেবার বাংলাদেশকেও হারিয়েছিল তারা।
এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিলেও দলটির ধারাবাহিক সাফল্যে ভবিষ্যতে ভালো কিছুই দেখছেন দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি পেসার ডেল স্টেইন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আগের দিনে অনেকে (ইংল্যান্ডে) কাউন্টি খেলতে যেতেন। কিংবা দক্ষতা ও ধৈর্য বাড়াতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলতেন। আমার মনে হয়, আমরা এমন এক সময়ে বসবাস করছি, যখন মানুষের ধৈর্য নেই।
ইনস্টাগ্রামে দুই সেকেন্ডের স্টোরিও আমরা বড় কষ্টে দেখি। ব্যাপারটা ঠিক আফগানিস্তানের ক্রিকেটারদের মতোই, যখন তারা ক্রিকেট খেলে।’ উন্নতির সোপানে উঠে পরের ধাপে যেতে কী করতে হবে, সে বিষয়ে কথা বলেছেন ৪১ বছর বয়সী কিংবদন্তি পেসার, ‘তাদের অনেকেই বিশ্বজুড়ে টি২০ ক্রিকেট খেলে, যেটা খুব ভালো বিষয়। শেখার পাশাপাশি পকেটের জন্যও ভালো। তবে চারদিনের ম্যাচ থেকেও শেখার আছে।
ওয়ানডে তো আসলে টেস্টেরই সংক্ষিপ্ত রূপ। ধৈর্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আফগানিস্তানের খেলোয়াড়দের শিখতে হবে। একবার তারা ধৈর্য ধরা শিখতে পারলে সত্যি বলতে, পরের দশকে আইসিসি টুর্নামেন্ট জিততে পারে।’
১৭ বছর আগেও যে দেশটি আইসিসি ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড ডিভিশন ফাইভ-এ খেলত, সেই দলটিই এখন শিরোপা জয়ের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে। আফগানদের অতিমানবীয় পারফরমেন্সকে কোনো বিশেষণ দিয়েই শেষ করা যাবে না। দুর্দান্ত, দুর্দমনীয়, ঐতিহাসিকÑএমন অনেক কথাই আসছে। কিন্তু সবকিছুই যেন তাদের প্রশংসার জন্য কম হয়ে যাচ্ছে! গত টি২০ বিশ্বকাপে তারা এমন এক গ্রুপ থেকে সেমিতে উঠে আসে যেখানে ভারত-অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রতিপক্ষ ছিল।
ভারত তিন ম্যাচ জিতে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছিল। লড়াইটা ছিল অস্ট্রেলিয়া আর আফগানিস্তানের মধ্যে। বাংলাদেশও ছিল। সমীকরণের প্যাঁচে টাইগারদেরও দারুণ সুযোগ এসেছিল। কিন্তু নেতিবাচক মানসিকতার কারণে বাংলাদেশ লক্ষ্যপূরণ তো দূরে থাক; জিততেও পারেনি। সেবার শান্ত-সাকিবদের হারিয়ে ইতিহাস গড়েন নবী-রশিদরা।
অথচ এমন পথচলার পেছনে কতই না সংগ্রামের গল্প লেখা আছে। অসুস্থ মাকে ঘরে রেখে আসা রহমানউল্লাহ গুরবাজ, শরণার্থী শিবির থেকে উঠে আসা গুলবাদিন নাইব, একটা দেশের ক্রিকেটকে একাকী নাবিকের মতো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মোহাম্মদ নবী। রাজনৈতিক অস্থিরতা আর বৈদেশিক সামরিক আগ্রাসন যাদের বিধ্বস্ত করে রেখেছিল দুই দশকের বেশি সময়, তারাই এখন বিশ্ব ক্রিকেটের মঞ্চে পতাকা উঁচিয়ে ধরেছে সগৌরবে।
দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে অস্ট্রিয়া কিংবা মঙ্গোলিয়ার মতো দেশের বিরুদ্ধেও ক্রিকেট খেলেছেন মোহাম্মদ নবী। দফায় দফায় অধিনায়ক হয়েছেন, সমসাময়িক সবাই ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু নবী যেন এক প্রাচীন বটবৃক্ষ। নওরোজ মঙ্গল, দৌলত জাদরান কিংবা শাপুর জাদরানদের সঙ্গে ক্রিকেট শুরু করেছেন। এখন খেলছেন রশিদ খান, মুজিব উর রহমানদের সঙ্গে।
মোহাম্মদ নবীর এই গল্পটা ক্রিকেট ছাড়া আর কে এত পূর্ণতা দিতে পারত! নিজেদের বাড়ি নেই, জীবন নেই, বাতাসে বুলেট আর বোমার তীব্র গন্ধ, সেই ধ্বংসস্তূপ থেকেই আফগান ক্রিকেটের পোস্টারবয় হয়ে ছুটেছেন সারাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। একের পর এক ফ্র্যাঞ্চাইজ ক্রিকেট খেলেছেন। আফগানিস্তান ক্রিকেটকে যেন নিজের কাঁধে নিয়ে ছুটেছেন সারাবিশ্বে।
শত বাঁধা বিপত্তি পেরিয়ে আফগান বীরেরা তাদের দেশকে স্বর্ণালী সাফল্য উপহার দিয়ে চলেছেন। অথচ পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়েও দেশকে তেমন কিছুই দিতে পারছেন না বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। কাড়ি কাড়ি আর্থিক সুবিধা, অনুশীলসহ সবকিছুর সুবিধা থাকা সত্ত্বেও শান্ত, মুশফিক, তাসকিনরা কেন সাফল্য এনে দিতে পারছেন না সেটা এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।
সাম্প্রতিক সময়ে ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শান্তদের নিয়ে নেতিবাচক ট্রল করা হয়। চলমান চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যাওয়ার আগে টাইগার অধিনায়ক নাজমুল হেসেন শান্ত বলেন, ‘আমরা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্যেই খেলবো’। কিন্তু শিরোপা দূরে থাক, গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচের দুটিতেই অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হয়েছে।
অপর ম্যাচটি বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত হয়। কথা আর কাজে এক হতে পারছেন না বাংলার ক্রিকেটাররা। বাংলাদেশের অগণিত ক্রিকেটপ্রেমী আপসোস করে বলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানরা যারা নিজেদের দেশে খেলার সুযোগ পান না তারা যদি বিশ্ব কাঁপাতে পারেন তাহলে অবারিত সুযোগ সুবিধা পাওয়ার পরও আমাদের ক্রিকেটাররা কেন পারেন না! তাদের ঘাটতি বা সমস্যা কোথায়? তাদের কি দেশাত্মবোধ নেই!
২০২৩ সালের বিশ^কাপ থেকেই বাংলাদেশের চরম বাজে পারফর্ম্যান্সের শুরু। সেবার ভারতের মাটিতে হওয়া বিশ^কাপে রানের বন্যা হয়েছে প্রতিটি ম্যাচে। কিন্তু বাংলাদেশী ব্যাটাররা সেই ছন্দে তাল মেলাতে পারেননি। এটি শুধুই পেশি শক্তিতে ঘাটতি নয়, বরং টেকনিক ও ব্যাটারদের ইন্টেন্ট, স্কিলের সমস্যা বলেই চিহ্নিত করেছেন সবাই।
এজন্য ২০২২ সালের টি২০ বিশ^কাপের আগে ভারতের খ্যাতিমান কোচ শ্রীধরন শ্রীরাম ব্যাটিং ইন্টেন্ট ও যতক্ষণ কোনো ব্যাটার ক্রিজে থাকবেন তার ইমপ্যাক্ট নিয়েই কাজ করেছেন। যাতে রান কম হওয়ার সমস্যায় না ভোগে বাংলাদেশ। অথচ এখন প্রায় প্রতিটি ম্যাচ হারের পর অধিনায়ক ও ক্রিকেটাররা আক্ষেপের সুরে বলেন ২০/৩০ রান কম হয়েছে।
সেটি ২০২৩ বিশ^কাপে প্রকটভাবেই দেখা গেছে। আধুনিক ক্রিকেটে টেস্টেও ‘বাজ বল’ ছন্দে ধুন্ধুমার ব্যাটিং করছে সব দল। বর্তমান সময়ে ২৮০-৩০০ রানের নিচে ওয়ানডে স্কোর দেখাটাই বিরল হয়ে গেছে। কিন্তু সেখান থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ নেই ব্যাটারদের অতিমাত্রায় ‘ডট বল’ খেলার কারণে। ব্যাটিংয়ের বেহাল অবস্থা আর ‘ডট বলই’ বাংলাদেশের সাফল্যে অন্তরায় হয়েছে। সেই সঙ্গে নেতিবাচক মানসিকতার কারণেও প্রত্যাশিত সাফল্য আসছে না বলে মনে করেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা।