ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩ ফাল্গুন ১৪৩১

‘আমার আজন্ম স্বপ্ন এসএ গেমসে স্বর্ণপদক জয়’

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০০:৩১, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

‘আমার আজন্ম স্বপ্ন এসএ গেমসে স্বর্ণপদক জয়’

বাংলাদেশের দুই তারকা অ্যাথলেট জহির রায়হান ও শিরিন আক্তার

বাংলাদেশ অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনের ব্যবস্থাপনায় জাতীয় অ্যাথলেটিক্সের ৪৮তম আসরের পর্দা নেমেছিল গত ১৯ ফেব্রুয়ারি। জাতীয় স্টেডিয়াম, ঢাকায় অনুষ্ঠিত এই প্রতিযোগিতায় তিন দিনে অনুষ্ঠিত হয় মোট ৪০টি ইভেন্ট। এবার সেরা হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনী। নৌবহিনীকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আরোহণ করতে যে দুই অ্যাথলেটের অবদান অনস্বীকার্য, তারা হলেন শিরিন আক্তার ও জহির রায়হান। তাদের মধ্যে একটি মিল হচ্ছে, দুজনেই একসময় বিকেএসপির শিক্ষার্থী ও অ্যাথলেট ছিলেন। 
যদি কোনো অ্যাথলেট নির্দিষ্ট একটি ইভেন্টে একাই দশবার স্বর্ণপদক লাভ করেন, তাহলে ব্যাপারটাকে নিঃসন্দেহে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই। চলচ্চিত্রকার ও সাহিত্যিক জহির রায়হান নন, তিনি তারকা অ্যাথলেট জহির রায়হান। জহির রায়হানের বেলায় সেটাই ঘটেছে এবারের জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে। ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে বাকি প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে কাক্সিক্ষত স্বর্ণপদকটা একান্তই নিজের করে নেন। পরে জেতেন ৪ গুণিতক ৪০০ মিটার রিলেতেও। যদিও ২০০ মিটার স্প্রিন্টে শ্রেষ্ঠত্ব হারান রৌপ্যপদক পেয়ে।
কোন ইভেন্টটা বেশি প্রিয় এবং কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জহির জনকণ্ঠকে বলেন, ‘অনেকগুলো ইভেন্টেই খেলি। তবে সবচেয়ে বেশি প্রিয় ৪০০ মিটার স্প্রিন্ট। এটা আমাকে ছোটবেলা থেকেই আকর্ষণ করত। বিকেএসপিতে থাকার সময়ই এটার প্রতি মমতা। আন্তর্জাতিক ও জুনিয়র আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাতেও এই ইভেন্টে ভালো রেজাল্ট করেছি।

জাতীয় প্রতিযোগিতায়ও এই ডিসিপ্লিনে অনেক রেকর্ড আছে আমার। তাই এটার প্রতি ফোকাসও বেশি। ২০০ মিটারও খেলি। ২০০ মিটারের চেয়ে ৪০০ মিটারে দৌড়ানো বেশি কষ্ট। কিন্তু কষ্ট ও অর্জনের পর যে আনন্দটা পাই, তার কোনো তুলনা নেই। এতে বেশি কষ্ট, বেশি আনন্দ। এই ইভেন্টে সবকিছুতেই পারফেক্ট হতে হয়, এতে আকর্ষণও তাই অনেক বেশি।’
শেরপুরের ছেলে জহির সারা বছর সাভারের জিরানির বিকেএসপিতে অনুশীলন করেন সাবেক প্রখ্যাত স্প্রিন্টার এবং বর্তমানে কোচ আবদুল্লাহ হেল কাফির কাছে। তার অধীনেই অনুশীলন করেই যত সাফল্য। কিন্তু বিদেশে গিয়ে বিদেশী কোচের অধীনে ট্রেনিং করলে কি রেজাল্ট আরও ভালো হতো না? এ প্রসঙ্গে জহিরের ভাষ্য, ‘অবশ্যই। বিদেশে ট্রেনিং করার কোনো বিকল্প নেই। এখানে এনভায়রনমেন্টের একটা ব্যাপার আছে।

বিদেশে অনুশীলন করলে প্রপার গাইডলাইন থেকে শুরু করে সব ধরনের ট্রেনিং ফ্যাসিলিটিস পাওয়া যায়, যা আমাদের দেশে নেই।’ জহির আরও বলেন, ‘অ্যাথলেটরা হচ্ছে আসলে কুরবানির গরুর মতো, যতটা যতœ করা হবে, মাংসও তত বেশি পাওয়া যাবে!’ আক্ষেপ করে জহির বলেন, ‘অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন সবসময়ই আমাদের জন্য মুলা ঝুলিয়ে এসেছে! তবে এখন যেহেতু নতুন কমিটি এসেছে, তাই আশা করব তারা আমাদের বিদেশে ট্রেনিং করানোর ব্যাপারে ভালো কিছু একটা নিশ্চয়ই করবে।’
কোনো ইভেন্টে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কেমন? জহিরের জবাব, ‘আমার আজন্ম স্বপ্ন এসএ গেমসে ৪০০ মিটার স্বর্ণপদক জয় করার। এজন্য উন্নতমানের ও হার্ড ট্রেনিং দরকার। এর আগে জুনিয়র লেভেলে ভারত ও শ্রীলঙ্কার যেসব প্রতিযোগীকে হারিয়েছি, তারা এখন সিনিয়র পর্যায়ে সাফল্য পাচ্ছে। ফেডারেশন যদি আমাকে অন্তত এক বছরের জন্য বিদেশে ট্রেনিং করাতে পাঠাত, তাহলে খুবই ভালো হতো।’

২০১৭ সাল থেকে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে এ পর্যন্ত দু’বার সেরা অ্যাথলেট হওয়া জহির (২০১৯ ও ২০২১ সালে) যদি অ্যাথলেট না হতেন, তাহলে ফুটবলার হতেন, ‘ছোটবেলায় অনেক ভালো ফুটবল খেলতাম। খেলতাম মিডফিল্ডার পজিশনে। আমার প্রিয় ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো।’ আর প্রিয় অ্যাথলেট? ‘অবশ্যই উসাইন বোল্ট। তার মতো আর কেউ নেই।’ সহাস্য জবাব ৫ ফুট সাড়ে ১০ ইঞ্চি উচ্চতার অধিকারী ও ২৩ বছর বয়সী টগবগে তরুণ জহিরের।

সামনেই বিশ্ব ইনডোর অ্যাথলেটিক্স রয়েছে। মার্চের এই আসরে জহিরও অংশ নিতে চান, ‘বিশ্ব আসরে কে না অংশ নিতে চায়। তবে ফেডারেশন যাকে মনোনীত করবে সেই যাবে। আমি এ নিয়ে আর কী বলব...।’  জহিরের সেরা আন্তর্জাতিক সাফল্য হচ্ছে ২০২৪ সালে ইরানের তেহরানে ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে ৪৮.১০ সেকেন্ড টাইমিং করে এশিয়ান ইনডোর চ্যাম্পিয়নশিপে রৌপ্যপদক জেতা। 
জাতীয়, সামার ও বাংলাদেশ গেমসÑএই তিন আসর মিলিয়ে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে ১৬ বারের চ্যাম্পিয়ন শিরিন আক্তার। এজন্যই ফেসবুকে নিজের কোন ছবি পোস্ট করলে সেখানে নাম দেন ‘এসএ সিক্সটিন’। কিন্তু এত বছর হয়ে গেল, এখনো শিরিনকে হারানোর মতো প্রতিযোগী উঠে আসছে না কেন? এটা অবশ্য শিরিনের জন্য ভালো হলেও সার্বিকভাবে দেশের জন্য ভালো সমাচার নয়।

এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে শিরিন বলেন, ‘খেয়াল করলে দেখবেন, ১০০ মিটার স্প্রিন্টটা খুবই কম্পিটিটিভ হয়। দৌড়টা খুবই ক্লোজ হয়। ফিনিশিং লাইনটা চেক করলেই সেটা বোঝা যায়। এমন নয়, আমি অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে থাকি। কাজেই এটা বলা যায় যে, অন্যরাও নিশ্চয়ই উঠে আসছে। সেই সামর্থ্য অবশ্যই তাদের মধ্যে আছে।

তাছাড়া আগের চেয়েও তাদের টাইমিংয়ের উন্নতি হচ্ছে। তবে চূড়ান্ত সাফল্য পাওয়া জন্য তাদের আরও বেশি পরিচর্যা করতে হবে, তেমনি তাদেরও বেশি করে পরিশ্রম করতে হবে। এ ছাড়া তাদের প্রমোট করার জন্য মিডিয়াকেও এগিয়ে আসতে হবে।’
১০০ মিটার স্প্রিন্টে এত সাফল্য পেলেও আগের মতো বেটার টাইমিং হচ্ছে নাÑ এমন প্রশ্নের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন সাতক্ষীরার কন্যা শিরিন বলেন, ‘না, আমি একমত নই। ১০০ মিটারে খুব বেশি উন্নতি না হলেও একেবারে টাইমিংয়ের অবনতিও হচ্ছে না। আগেরবার ২০০ মিটার জাতীয় রেকর্ড করেছি। এবার ৪০০ মিটার রিলেতে রেকর্ড গড়েছি (ভেঙেছেন ৩১ বছরের পুরনো জাতীয় রেকর্ড।

শিরিন আক্তার, সাবিহা আল সোহা, নুসরাত জাহান রুনা ও নাথেরা খাতুন সময় নেন ৩ মিনিট ৫১.৬২ সেকেন্ড। পূর্বে এই ইভেন্টে ১৯৯৩ সালে বিজেএমসির নাছিমা, সুবনা, মনিয়া ও সুমিতার রেকর্ড ছিল ৩ মিনিট ৫৫.৫৫ সে.)। সবচেয়ে বড় কথা, টাইমিংয়ে উন্নতি না হলে এসব রেকর্ডগুলো তো হতো না।’
অ্যাথলেট না হলে কি হতেন? ‘পড়াশোনায় ভালো ছিলাম না। কাজেই অ্যাথলেট না হলেও অন্য কোন পেশায় যে যাব, সেই স্বপ্নও ছিল না। খেলাধুলায় ভালো ছিলাম বলে রক্ষা। তবে যদি অ্যাথলেট না হতাম, তাহলে হয়তো ভালো একজন গৃহিণীই হতাম। আর কোনো অপশন ছিল না আর কি!’ শিরিনের সোজা-সাপটা জবাব। ৩০ বছর বয়সী শিরিন আর কতদিন দৌড়াবেন, মানে খেলবেন? খেলা ছাড়ার পর কি করবেন?

শিরিনের চটজলদি উত্তর, ‘কতদিন খেলব, তা নিয়ে মোটেই ভাবছি না। বর্তমান নিয়েই ভাবছি। সবচেয়ে বড় কথা, সাফল্যের জন্য ক্ষুধাবোধ দরকার, সেটা আমার মধ্যে এখনো আছে। আপকামিং টুর্নামেন্টগুলো নিয়ে ভাবনা ও প্রস্তুতি আমার। আর খেলা ছাড়ার পর খেলাধুলার অঙ্গনেই থাকতে চাই। সেটা কোচ, সংগঠক, প্রশাসক ... যে কোনো ভূমিকাতেই হতে পারে।

আসলে সময়ই বলে দেবে খেলা ছাড়ার পর আগামীতে কি করব।’ অবসর নেওয়ার পরেই কি বিয়ের পিঁড়িতে বসার পরিকল্পনা? লাজুক কণ্ঠে শিরিনের উত্তর, ‘এ বিষয়ে খুব দ্রুই জানতে পারবেন। সবই জানাব। সবার জন্য সারপ্রাইজ থাকবে।’ লাভ ম্যারেঞ্জ, না অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ? ‘এখনই বলব না। পরে বলব সময় হলে।’ হাসতে হাসতে জবাব শিরিনের।

×