
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে এত আলোচনা আগে কখনো হয়নি
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি নিয়ে এত আলোচনা আগে কখনো হয়নি। কারণ বিশ্বব্যাপী ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আর একের পর এক টুর্নামেন্টের চাপে ওয়ানডের শীর্ষ দলগুলোর এই আসরের ভবিষ্যৎ নিয়ে তৈরি হয়েছিল অনিশ্চয়তা। আসরটি মাঠে গড়াচ্ছে ৮ বছর পর। ১৯৯৮ সালে প্রবর্তিত টুর্নামেন্টটির মাত্র নবম আসর এটি। অথচ দুই বছরের পরপর হিসেবে ইতোমধ্যে ১২টি আসর হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। দ্বিতীয়ত পাকিস্তান।
১৯৯৬ বিশ্বকাপের পর, দীর্ঘ ২৯ বছরে আইসিসির কোনো বিগ আসর আয়োজনের সুযোগ পেল দেশটি। তৃতীয়ত, ভারতের কিছুতেই শত্রু দেশ পাকিস্তানে খেলতে না চাওয়া। অনেক আলোচনা, কথার আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের পর অবশেষে এশিয়া কাপের মতো ‘হাইব্রিড’ মডেলে আসে সমাধান। অর্থাৎ ভারত তাদের ম্যাচগুলো খেলবে সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
এমনকি রোহিত শর্মার দল সেমিফাইনাল বা ফাইনালে উঠলে ভেন্যু বদলে লাহোর থেকে দুবাইয়ে চলে যাবে! করাচিতে পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে পর্দা উঠছে আজ। এÑগ্রুপে আরও আছে বাংলাদেশ ও ভারত। বি-গ্রুপে আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ৯ মার্চ ফাইনাল পর্যন্ত ১৯ দিনে মোট ম্যাচ ১৫টি।
আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০২ সালে এই টুর্নামেন্টের নামকরণ করা হয় আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। এরপর ২০০৪, ২০০৬, ২০০৯, ২০১৩ সালে আরও চারটি আসর হয়। তার আগে আরও দুটি আসর হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে প্রথম আসর বসেছিল বাংলাদেশে। ২০০০ সালে দ্বিতীয় আসর কেনিয়ায়। মূলত নন টেস্ট প্লেয়িং দেশগুলোর ক্রিকেটের উন্নতির জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে এই টুর্নামেন্ট আয়োজনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল আইসিসি।
তৎকালীন আইসিসি সভাপতি, বাংলাদেশের ক্রিকেটের পরম বন্ধু- জাগমোহন ডালমিয়ার মাথা থেকেই এসেছিল এটির ধারণা। তখন অবশ্য এটার নাম আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ছিল না। তখন এই টুর্নামেন্টের নাম ছিল আইসিসি নকআউট ট্রফি। ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর সবচেয়ে বড় ক্রিকেট আসর ছিল এটি। যেটাকে ‘মিনি ওয়ার্ল্ড কাপ’ও বলা হতো। প্রথম দিকে শুধু টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলো খেলার সুযোগ পেত।
এরপর ১০টি পূর্ণ সদস্য দেশ ও আরো দুটি সহযোগী দেশ টুর্নামেন্টে অংশ নিত। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে নিয়ম পরিবর্তন করা হয়। টুর্নামেন্ট শুরুর ছয় মাস আগে শুধু ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা আটটি দল সুযোগ পাচ্ছে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার। শুরুতে প্রতি দুই বছর পরপর হলেও এখন প্রতি চার বছর পরপর হচ্ছে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি।
১৯৯৮ সালে নয় দল নিয়ে প্রথম আসর বসেছিল ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। যদিও নন-টেস্ট প্লেয়িং কান্ট্রি হওয়ায় ঘরের মাঠে ঐতিহাসিক সে আয়োজনে আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আকরাম খান, মোহাম্মদ রফিকদের মাঠে নামার সুযোগ হয়নি। তবে গ্যালারি ভরা দর্শক আর দেশব্যাপী ব্যাপক উন্মাদনার ফলে ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পায় বাংলাদেশ। নাম লেখায় এলিট শ্রেণিতে।
২০০২ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় আসরে খালেদ মাসুদ পাইলটের নেতৃত্বে প্রথমবার ওড়ে লাল-সবুজের পতাকা। উইলস ইন্টারন্যাশনাল ট্রফির পরিবর্তে তখন থেকেই এর নামকরণ হয় আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। ২০০৬ পর্যন্ত টানা তিনবার গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়া বাংলাদেশ র্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকায় পরের দুইবার খেলার সুযোগ পায়নি। ২০১৭ সালে সর্বশেষ আসরে কাঁপিয়ে দেয় টাইগাররা।
প্রথমবার আইসিসির কোনো বৈষয়িক টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে উঠে ভারতের কাছে হারে মাশরাফি বিন মুর্তজার বাংলাদেশ। ভারতে অনুষ্ঠিত ২০২৪ ওয়ানডে বিশ্বকাপে সার্বিক ফল ভালো না হলেও সেরা আটে থেকে এবার চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির টিকিট পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রিয় ফরম্যাট ওয়ানডেতে নিজেদের হারিয়ে খোঁজা নাজমুল হোসেন শান্তর দল কেমন করবে, ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় দেশের অগণিত ক্রিকেটপ্রেমী মানুষ।
সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ভারত বরাবরই শিরোপার শক্ত দাবিদার। তাদের ব্যাটিং গভীরতা, বোলিং বৈচিত্র্য আর তুখোড় ফিল্ডিং যে কোনো সময়েই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এবারের আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ভারত তাদের সব ম্যাচই খেলবে দুবাইয়ে। মরু শহরের উইকেট ও কন্ডিশন মাথায় রেখেই দলে নিয়েছেন পাঁচ জন স্পিনার।
লেগস্পিনার বরুণ চক্রবর্তী, বাহাতি চায়নাম্যান কুলদীপ যাদব আর সঙ্গে তিন বোলিং অলরাউন্ডার অক্ষর প্যাটেল, রবীন্দ্র জাদেজা এবং ওয়াশিংটন সুন্দর। পেস বিভাগে জসপ্রিত বুমরা না থাকায় ধারটা কমে গেছে ঠিকই, তবে আর্শদীপ সিং, হারশিত রানা ও মোহাম্মদ সামির সঙ্গে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়ার মিডিয়াম পেসও হতে পারে কার্যকর। বরাবরের মতোই ভারতের মূল শক্তি ব্যাটিং।
সম্প্রতি ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ ৩-০ তে জিতেছে ভারত। ৩০০ রান তাড়া করা ভারতের ব্যাটসম্যানদের কাছে রীতিমতো ছেলেখেলা। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডেতে তারা ২৪৮ রান তাড়া করে জিতেছে ৩৯ ওভারে, পরের ম্যাচে ৩০৪ রান তাড়া করে জিতেছে ৪৫ ওভারে। অধিনায়ক রোহিত শর্মা, শুভমান গিল, শ্রেয়াস আইয়ার; প্রত্যেকেই দারুণ ছন্দে।
তাদের পাশে বিরাট কোহলিকেই দেখাচ্ছে বেমানান, সবশেষ ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে সেঞ্চুরির পর ৭ ইনিংস ধরে যে বড় রান নেই তার ব্যাটে। তবে বড় ম্যাচের খেলোয়াড় কোহলি বড় মঞ্চে যে দেখিয়ে দেবেন নিজের সামর্থ্যটা, সেই ভরসা তার ওপর আছে টিম ম্যানেজমেন্টের।
অন্যদিকে ঘরের মাঠে ত্রিদেশীয় সিরিজে নিউজিল্যান্ডের কাছে তারা হেরে গেছে পাকিস্তান। তাদের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়েই শুরু হচ্ছে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি অভিযান। ব্যাটিংটা কমজোরি। বাবর আজমের ব্যাটে রান নেই। সাউদ শাকিল, আগা সালমান, তৌয়ব তাহিররা এখনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পায়ের নিচে শক্ত জমিন খুঁজে পাননি। তাদের পারফরম্যান্সও শেয়ার বাজারের মতোই ওঠানামা করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩৫২ রান তাড়া করে জেতার পরের ম্যাচেই তাই পাকিস্তান ২৪২ রানে অলআউট হয়ে যেতে পারে। বোলিংয়ে তাও ব্যাটসম্যানদের মনে ভয় ধরানোর মতো কিছু নাম আছে। শাহিন শাহ আফ্রিদি, নাসিম শাহ, হারিস রউফদের পেস আক্রমণকে সমীহ করতেই হয়। তবে হালফিলে তাদের বলে শুধু পেসই আছে, লাইন-লেন্থ উবে গেছে।
প্রচুর শর্ট অব লেন্থ বল করার প্রবণতা পাকিস্তানের বোলারদের, যা নির্বিষ উইকেটে কেবলই রানই বিলিয়ে দিচ্ছে। স্পিন বিভাগ সবচেয়ে দুর্বল। কোনো বিশেষজ্ঞ স্পিনার নেই; আবরার আহমেদ, সালমান আলি আগা আর খুশদিল শাহদের নিয়ে গড়া জোড়াতালির স্পিন আক্রমণে ধার নেই।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯৯৮ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। কেনিয়ায় ২০০০ সালে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জেতে নিউজিল্যান্ড। শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় ২০০২Ñএর ফাইনাল বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হলে যৌথ চ্যাম্পিয়ন হয় শ্রীলঙ্কা ও ভারত। ২০০৪ সালের ফাইানলে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
২০০৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত পঞ্চম আসরে উইন্ডিজকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ২০১৩ আসরে ইংলিশদের উড়িয়ে শিরোপা জয় করে ভারত। সর্বশেষ ইংল্যান্ডে ২০১৭ সালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে হারিয়ে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া পাকিস্তান এবার আয়োজক।