ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১

টাইগারদের মিশন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:১৪, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

টাইগারদের মিশন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি

আসন্ন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি সামনে রেখে মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে টাইগারদের তালিম দিচ্ছেন কোচ ফিল সিমন্স

বাংলাদেশের ক্রিকেটে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি ‘অন্যরকম’ নষ্টালজিক এক টুর্নামেন্ট। ক্রিকেটের বৈশায়নের লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালে নয় দল নিয়ে ‘মিনি বিশ্বকাপ’খ্যাত এ টুর্নামেন্টের প্রথম আসর বসেছিল বাংলাদেশে, ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। যদিও নন-টেস্ট প্লেয়িং কান্ট্রি হওয়ায় ঘরের মাঠে ঐতিহাসিক সে আয়োজনে আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আকরাম খান, মোহাম্মদ রফিকদের মাঠের খেলায় সুযোগ হয়নি! তবে ঠিকই ফল পেয়েছিল বাংলাদেশ।

গ্যালারি ভরা দর্শক আর দেশব্যাপী ব্যাপক উন্মাদনার ফলে ২০০০ সালে আসে টেস্ট স্ট্যাটাস, নাম লেখায় এলিট শ্রেণিতে। ২০০২ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত তৃতীয় আসরে খালেদ মাসুদ পাইলটের নেতৃত্বে প্রথমবার ওড়ে লাল-সবুজের পতাকা। উইলস ইন্টারন্যাশনাল ট্রফির পরিবর্তে তখন থেকেই এর নামকরণ হয় আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি।

২০০৬ পর্যন্ত টানা তিনবার গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়া বাংলাদেশ র‌্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে থাকায় পরের দুইবার খেলার সুযোগ পায়নি। ২০১৭ সালে সর্বশেষ আসরে ফিরেই কাঁপিয়ে দেয় টাইগাররা। প্রথমবার আইসিসির কোনো বৈষয়িক টুর্নামেন্টের সেমিফাইনালে উঠে ভারতের কাছে হারে মাশরাফি বিন মুর্তজার দল। 
সাকিব-তামিম দ্বন্দ্ব, ব্যাপক সমালোচনা-নাটকীয়তার পর ভারতে অনুষ্ঠিত ২০২৪ ওয়ানডে বিশ্বকাপে সার্বিক ফল ভালো না হলেও সেরা আটে থেকে এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির টিকটি পায় সাকিব আল হাসানের দল। ১৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান ও আমিরাতে শুরু হতে যাওয়া আসন্ন নবম আসরে বড় দুই তারকার কেউই নেই।

প্রিয় ফরম্যাট ওয়ানডেতে নিজেদের হারিয়ে খোঁজা নাজমুল হোসেন শান্তর দল কেমন করবে, ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় দেশের অগণিত ক্রিকেটপ্রেমী মানুষ। গত ২২ জানুয়ারি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য বেঁধে দেওয়া সময়ের শেষ দিনে দল ঘোষণার পর থেকেই অবশ্য আলোচনা তুঙ্গে। অফ-ফর্মের জায়গা হয়নি লিটন দাসের। গত বছর মার্চে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে চট্টগ্রামে প্রথম দুই ম্যাচেই শূন্য রানে আউট হওয়ার পর তৃতীয় ম্যাচ থেকে বাদ পড়েন এ তারকা।

অধিনায়ক শান্তও ছন্দে নেই। ব্যাটিংয়ে অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ, সৌম্য সরকার ও তরুণ তাওহীদ হৃদয়ের ওপর অনেক দায়িত্ব। বড় ভরসা অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজ। দলে পেসার আছেন চারজনÑতাসকিন আহমেদ, মুস্তাফিজুর রহমান, নাহিদ রানা ও তানজিম হাসান সাকিব। বাদ পড়েছেন শরীফুল ইসলাম ও হাসান মাহমুদ। এই দুজনই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সর্বশেষ ওয়ানডে সিরিজে দলে ছিলেন।

সেই দল থেকে লিটন ছাড়া আরও বাদ পড়েছেন আফিফ হোসেন। দলে স্লো বোলার তিনজনÑ অফস্পিনার মিরাজ, বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদ ও লেগস্পিনার রিশাদ হোসেন। তামিমকে পেতে নির্বাচকরা খুব চেষ্টা করলেও অবসরের সিদ্ধান্ত নেন দেশসেরা এ ওপেনার। আলোচনা ছিল সাকিবকে নিয়েও। দল ঘোষণার পর প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু জানিয়েছেন, বোলিংয়ে নিষিদ্ধ অলরাউন্ডারকে নিলে শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে নিতে হতো। 
বিপিএল শেষে মিরপুরে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক অনুশীলন ক্যাম্প। প্রথম দুই দিন অবশ্য চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির স্কোয়াডে থাকা সবাই যোগ দেননি। গত শনিবার ক্যাম্পে যোগ দেন তানজিদ হাসান, তানজিম হাসান, জাকের আলি, মুস্তাফিজুর রহমান ও সৌম্য সরকার। রবিবার দ্বিতীয় দিন যোগ দেন তাসকিন, নাহিদ ও নাসুম। ছুটি কাটিয়ে তাদের সঙ্গী হন শান্ত, মাহমুদুল্লাহ, মুশফিক, মিরাজ, হৃদয়, রিশাদ ও ইমন।

প্রায় দেড় মাস ধরে বিপিএল, এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেও সবশেষে টি২০ খেলে বাংলাদেশ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে তাই ওয়ানডে সংস্করণে মনোযোগ ফেরানোর চ্যালেঞ্জ। দলের জন্য দুর্ভাবনার কারণ হতে পারে শান্তর ফর্মহীনতা ও ম্যাচ অনুশীলনের ঘাটতি। পুরো বিপিএলে বরিশালের হয়ে পাঁচ ম্যাচের বেশি খেলা হয়নি বাংলাদেশ অধিনায়কের। সবশেষটি ছিল সেই ১৬ জানুয়ারি। দলের পক্ষ থেকে কম্বিনেশনের কথা বলা হয়েছে, তবে পারফরম্যান্সও ছিল না শান্তর পক্ষে।

সুযোগ পাওয়া পাঁচ ম্যাচের চারটিতেই দুই অঙ্ক ছুঁতে পারেননি শান্ত। ম্যাচ অনুশীলনের বড় একটা ঘাটতি তাই থাকছে। জাতীয় দলের জার্সিতে ওয়ানডেতে অবশ্য নিজের সর্বশেষ সিরিজগুলোয় ভালো ফর্মে ছিলেন তিনি। আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুই ম্যাচে করেন ১২৩ রান। নিউ জিল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও পান রানের দেখা। 
টপ-অর্ডারের আরেক ব্যাটসম্যান পারভেজের ফর্ম নিয়েও ছিল শঙ্কা। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দল ঘোষণার পর বিপিএলে কয়েক ম্যাচে রান করতে পারেননি তিনি। তবে সবশেষ চার ম্যাচের দুটিতে ৭০ ছোঁয়া ইনিংস খেলে ফর্মে ফেরার আভাস দিয়েছেন তরুণ ওপেনার। ফাইনালে তার ৭৮ রানের সৌজন্যে দুইশ ছুঁইছুঁই পুঁজি পেয়েছিল চিটাগং। বাঁহাতি ওপেনার তানজিদের বিপিএল ছিল দুর্দান্ত। ১২ ম্যাচে এক সেঞ্চুরি ও তিন ফিফটিতে তিনি করেন আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৮৫ রান।

সব মিলিয়ে ৩৬টি ছক্কা মেরে গড়েন এক আসরে বাংলাদেশীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ছয়ের রেকর্ড। চোট কাটিয়ে বিপিএলের শেষ দিকে ফেরা সৌম্য সরকার ছন্দে ফেরার বার্তা দেন খুলনা টাইগার্সের বিপক্ষে ৪৮ বলে ৭৪ রানের ইনিংস খেলে। মিডল-অর্ডার নিয়েও কিছুটা চিন্তার কারণ আছে। বরিশালের হয়ে টানা দুই শিরোপার আনন্দে মাতলেও ব্যাট হাতে নিজেদের সেরা ফর্মে ছিলেন না মাহমুদুল্লাহ, মুশফিক, হৃদয়রা।

ফাইনালের আগে ৮২ রানের ইনিংসে ছন্দে ফেরার আভাস দেন হৃদয়। কিন্তু শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে ৩২ রান করতে খেলে ফেলেন ২৮ বল। বিপিএলে তিনি বেশিরভাগ ম্যাচ ওপেনিংয়ে খেলেছেন। জাতীয় দলে দেখা যাবে মিডল-অর্ডারে। টুর্নামেন্টের শুরুর দিকে কিছু ক্যামিও ইনিংস খেলেন মাহমুদুল্লাহ। কিন্তু পরের দিকে সেই ছন্দ ধরে রাখতে পারেননি অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান। একই অবস্থা মুশফিকের।

দুজনই অবশ্য পুরো আসরে খুব বেশি সময় পাননি ব্যাটিংয়ের। বোলিংয়ে তাসকিন ছিলেন অনবদ্য। ১২ ম্যাচে ২৫ উইকেট নিয়ে গড়েছেন এক আসরে সর্বোচ্চ উইকেটের রেকর্ড। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন একই ছন্দে। এ ছাড়া নাহিদ, তানজিম, মুস্তাফিজরাও ছিলেন উজ্জ্বল।
স্পিনে নাসুম, রিশাদরাও ছিলেন ভালো ছন্দে। অলরাউন্ড নৈপুণ্যে বিপিএলের আসর সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার জেতেন মিরাজ। চিটাগংয়ের বিপক্ষে ফাইনাল ম্যাচে মারা দুই ছক্কায় রিশাদও জানিয়ে দেন, চাপের মধ্যে ব্যাট হাতে দলের জন্য নিজেকে মেলে ধরতে তিনি প্রস্তুত। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি পাকিস্তানের জন্য ঐতিহাসিক। দেশটিতে সর্বশেষ আইসিসিসির কোন ইভেন্ট হয়েছিল সেই ১৯৯৬ সালে, ওয়ানডে বিশ্বকাপ।

২০০৯ সালে লাহোরে সফরকারী শ্রীলঙ্কান টিম বাসে ভয়াবহ বন্দুক হামলার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে কার্যত একঘরে হয়ে পড়েছিল পাকিস্তান। দীর্ঘ প্রায় এক যুগ কাঠখড় পুরিয়ে ২০২০ সালে দেশটিতে ফের দ্বিপক্ষীয় সিরিজ ফিরলেও বাদ সাধে মোড়ল ভারত। ফলে হাইব্রিড পদ্ধাতিতে ২০২৩ এশিয়া কাপে তাদের ম্যাচগুলো হয় শ্রীলঙ্কায়। একই ভাবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারতের ম্যাচগুলো হবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে।

আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে শুরু ‘মিনি বিশ্বকাপ’ খ্যাত ৮ দেশের এই ওয়ানডে টুর্নামেন্ট। ভারত সর্বশক্তি প্রয়োগ করে পাকিস্তান থেকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সরকার ও দেশটির ক্রিকেট বোর্ডের (পিসিবি) দৃঢ়তায় সেটি সম্ভব হয়নি। লাহোরে সংস্কারকৃত গাদ্দাফী স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ বলেছেন, ‘আমরা বিশ্বকে দেখিয়ে দেবো যে আমরা কতটা ভালো আয়োজক।’
ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯৯৮ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। কেনিয়ায় ২০০০ সালে ভারতকে হারিয়ে শিরোপা জেতে নিউজিল্যান্ড। শ্রীলঙ্কার কলম্বোয় ২০০২Ñএর ফাইনাল বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হলে যৌথ চ্যাম্পিয়ন হয় শ্রীলঙ্কা ও ভারত। ২০০৪ সালের ফাইানলে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০০৬ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত পঞ্চম আসরে উইন্ডিজকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় অস্ট্রেলিয়া।

ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে ২০১৩ আসরে ইংলিশদের উড়িয়ে শিরোপা জয় করে ভারত। সর্বশেষ ইংল্যান্ডে ২০১৭ সালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে হারিয়ে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া পাকিস্তান এবার আয়োজক।  চ্যাম্পিয়নস ট্রফি শুরু হবে ১৯ ফেব্রুয়ারি। হাইব্রিড মডেলের এই টুর্নামেন্ট হবে পাকিস্তান ও দুবাইয়ে।

বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের বিপক্ষে দুবাইয়ে। সেখান থেকে বাংলাদেশ দল যাবে পাকিস্তানে। রাওয়ালপিন্ডিতে পরের দুটি ম্যাচ ২৪ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি। প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড ও স্বাগতিক পাকিস্তান।

×