সাম্প্রতিক সংকটে এখন বেশ চাপে আছেন সাবিনা-সুমাইয়ারা
বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল সাফ ওমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে দু’বার এবং সেটা টানা (২০২২ ও ২০২৪)। প্রথম শিরোপাটি তারা জিতেছিল বেশ দাপটের সঙ্গেই, অপরাজিতভাবে। কিন্তু পরেরটি জেতা ছিল বেশ বিস্ময়করই। কেননা, এই দলে ছিল বেশ কিছু সমস্যা। ২০২২ আসরের দলের আট জনই ছিলেন না। কৃষ্ণা চোট কাটিয়ে দলে ফিরলেও পুরো ফিট ছিলেন না। অধিনায়ক সাবিনা খাতুন ছিলেন অফ ফর্মে।
দলে নতুন মুখ ৯ জন। দলের সবচেয়ে সফল ও কিংবদন্তি কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের না থাকা। নতুন কোচ পিটার বাটলার এসে দলের খেলার স্টাইল বদলে ফেলেন অনেকটাই। ফলে নতুন কোচের ধরনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পুরোপুরি পারেনি দল। টুর্নামেন্ট চলাকালেই তার সঙ্গে সিনিয়র খেলোয়াড়দের মানসিক দ্বন্দ্ব ... সবচেয়ে বড় কথা-কোনো অফিসিয়াল আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলে যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি।
এ রকম আক্ষেপ আর ঘাটতি নিয়েই হিমালয়ের দেশ নেপালে উড়াল দিয়েছিল বাংলার বাঘিনীরা। প্রথম ম্যাচেই পাকিস্তানের সঙ্গে হারতে হারতে বেঁচে যায় ড্র করে। এর পরই ঘুরে দাঁড়িয়ে একের পর এক ম্যাচ জিতে শিরোপা অক্ষুণœ রাখে লাল সবুজ বাহিনী।
এই দুই আসরেই দলের অধিনায়ক ছিলেন সাবিনা। প্রথম আসরে ফর্মের তুঙ্গে থাকলেও পরের আসরে নিজের ছায়া হয়েই ছিলেন। বেশ লম্বা সময় ধরেই অফ ফর্মে আছেন। বয়সও হয়েছে। ফলে সাফের আগে থেকেই তিনি আর বাটলারের শুরুর একাদশে জায়গা পেতেন না। বিষয়টা তাকে যেমন ক্ষুব্ধ করেছে তেমনি শঙ্কিতও করেছে বৈকি।
কেননা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেহেতু নারী ফুটবলের অবকাঠামো বলতে কিছুই নেই এবং অনিয়মিত লিগ (টুর্নামেন্ট তো হয়ই না) হয়, সেহেতু একবার কারোর দল থেকে বাদ পড়ে আবারও লিগ খেলে নিজেকে প্রমাণ করে আবারও জাতীয় দলে ফেরার নজির নেই বললেই চলে। কাজেই বাটলারের কাছে ধীরে ধীরে ‘অপাঙক্তেয়’ হয়ে যাচ্ছেন, এটা উপলব্ধি করতে সময় নেননি তিনি।
তখন থেকেই কি ‘বিদ্রোহ’ করার পরিকল্পনা মাথায় আসে তার? এ নিয়ে মতামত জানতে চাইলে সাবিনার মোবাইলে কল করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। গত সাফ চলাকালে বাটলাররের উদ্দেশে ব্যঙ্গ করে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস (সতীর্থদের রোজ টিকটক করতে) দিয়ে পরে বিতর্কের কারণে সেটি মুছে দেন।
অবশ্য এর আগেও সাবিনার নেতৃত্বে বিদ্রোহ করেছিলেন অন্য নারী ফুটবলাররা। সেটা ২০২৩ সালের জুলাইয়ে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে। দু’দিন অনুশীলন বয়কট করেছিলেন তারা। এছাড়া আরেকটা বিতর্কিত কাজও করেছিলেন সাবিনা। ছুটি নিয়ে তিনিসহ অন্যরা নিজ নিজ গ্রামে চলে যান। কথা ছিল ছুটিতে নিজেদের বাড়িতে গিয়ে পরিবার-পরিজনকে সময় দেবেন এবং নিজের শরীরের যতœ নেবেন।
কিন্তু সেটা পুরোপুরি মানেননি সাবিনারা। তিনিসহ ছয় ফুটবলার নিজেদের বাড়িতে না গিয়ে অন্য এলাকায় গিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে ‘খেপ’ খেলেন! অথচ এর এক মাস পরই তাদের এশিয়ান গেমসের ফুটবল ইভেন্টে খেলতে যাওয়ার কথা ছিল চীনে। খেপ খেলতে গিয়ে যদি তারা চোট পেতেন, তাহলে নিশ্চয়ই এর দায়ভার বাফুফে নিত না। কারণ তাদের অনুমতি নিয়ে খেপ খেলেননি তারা। যাহোক, খেপ খেলা শেষে মেয়েরা বাফুফের ক্যাম্পে ফিরলেও সাবিনা ফেরেননি।
ওই সময় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাফুফের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানিয়েছিলেন, সাবিনা নিজেও নষ্ট হচ্ছে, বাকি মেয়েদেরও নষ্ট করছে। ছুটিতে যাবার আগে তারই নেতৃত্বে ফুটবলাররা বিদ্রোহ ঘোষণা করে তারপর বাড়িতে গেছে। (বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান সংক্রান্ত)। এর আগেও সে এমনটা করেছে, মেয়েদের অনুশীলন বর্জন করাতে উৎসাহ যুগিয়েছে।
বাফুফে যদি এখনই তাকে কন্ট্রোল না করে, তাহলে আগামীতে দলে আরও অনেক সমস্যা তৈরি হতে পারে। মঙ্গলবার বাফুফের নারী উইং প্রধান সুমাইয়ার বাবাকে ফোন করে বলেছেন, তার মেয়ের ব্রেনওয়াশ করেছে সাবিনা। সুমাইয়া যেন সাবিনার সঙ্গ ত্যাগ করে।
প্রায় বছর দেড়েক পর আবারও নতুন ঝামেলা পাকিয়েছেন সাবিনা। তার নেতৃত্বে মোট ১৮ সিনিয়র ফুটবলার কোচ বাটলারের অপসারণ করে বিদ্রোহ-আন্দোলন শুরু করেছেন। যা নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয় ক্রীড়াঙ্গনে।
বুধবার ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি পেয়েছেন দাবি করে মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের সদস্য মাতসুশিমা সুমাইয়া।
জিডি করার সময় সুমাইয়ার সঙ্গে ছিলেন বাফুফে মিডিয়া ম্যানেজার খালিদ মাহমুদ নওমী। আগেরদিনই সুমাইয়াকে হত্যা-ধর্ষণের হুমকির প্রতিবাদে তার পাশে থেকে সব রকম সহায়তা করার আশ্বাস দিয়ে একটি প্রেস রিলিজ দেয় বাফুফে।
বুধবার ছিল তদন্ত কমিটির শেষ কার্যদিবস। এদিন তারা অন্য কোচিং স্টাফ ও নারী ফুটবল উইং প্রধান মাহফুজা আক্তার কিরণের জবানবন্দি নেন। আজ বৃহস্পতিবার তদন্ত প্রতিবদেন জমা দেবেন তারা বাফুফে সভাপতির কাছে। তার আগেই কোচ বাটলার গণমাধ্যমের সামনে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন, কোনো সমঝোতা নয়। হয় ওই ফুটবলাররা থাকবে, না হয় আমি।
মেয়েরা যা করেছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। ওরা সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করছে। এটা বোকামি। এসব বন্ধ হওয়া উচিত। আমি সাত ফুটবলারকে দলে আর চাই না (সাবিনা, মাসুরা, মারিয়া, সানজিদা, নীলা, শামসুন্নাহার সিনিয়র ও কৃষ্ণা)।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ১৮ খেলোয়াড় ফেসবুকে ট্রলের শিকার হচ্ছেন। একজন তো হত্যা-ধর্ষণের হুমকিই পেয়েছেন। এহেন পরিস্থিতিতে স্বাভাবকিভাবেই মানসিকভাবে বিপর্যন্ত তারা। এজন্য তাদের সহায়তা করতে বাফুফে বুধবার থেকে নারী খেলোয়াড়দের নিয়ে মনোবিদের শরণাপন্ন হয়েছে।