নানা অব্যবস্থাপনা আর বিতর্কের কারণে বিপিএলে শেষ পর্যন্ত এমন হাসি ধরে রাখতে পারেননি তাসকিন-বিজয়রা
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) না হয়ে টুর্নামেন্টটির নাম বিতর্ক প্রিমিয়ার লিগ হলেই বুঝি ভালো হতো! ২০১২ সালে যে লক্ষ্য নিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি এ টি২০ আসর শুরু হয়েছিল এক যুগেও সেটি পূরণ হয়নি। উল্টো প্রতিবারই নতুন বিতর্ক ছাপিয়ে গেছে পুরনো বিতর্ককে। আগের সব বিতর্ককে টেক্কা দিয়েছে এবার! ঢাকায় প্রথম পর্বে ছিল টিকিট অব্যবস্থাপনা ও সমর্থকদের মিছিল-মিটিংয়ে উত্তাল।
সিলেটে চার-ছক্কার ফুলঝুড়িতে মাঠের খেলা জমে উঠলেও ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের দ্বন্দ্বের ইস্যুতে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন খোদ বিসিবি প্রধান ও এক পরিচালক। চট্টগ্রামপর্বে সামনে আসে সবচেয়ে বড় কলঙ্ক। হঠাৎ করে জানা যায়- দুর্বার রাজশাহীর বেশিরভাগ ক্রিকেটারই চুক্তি অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাননি। যে কারণে অনুশীলন বর্জন করেন তারা। এরপর ম্যাচ না খেলারও হুমকি দেন; ঢাকায় যা বাস্তব হয়ে ওঠে।
এরপর ম্যাচ ফিক্সিং ও স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠে। বোলারদের অস্বাভাবিক ডেলিভারি, ইচ্ছাকৃত নো বল এবং ওয়াইড বোলিংয়ের মতো ঘটনাগুলো ফিক্সিংয়ের সম্ভাবনা উসকে দেয়। আছে তামিম ইকবাল ও সাব্বির রহমানের অপেশাদার আচরণ, মাঠেই তর্কে জড়িয়ে পড়ার মতো ঘটনা।
তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের আচরণ। তারা বিদেশী ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ও মেন্টরদের জন্য অনেক টাকা ব্যয় করলেও স্থানীয় খেলোয়াড়দের প্রাপ্য অর্থ দিতে গড়িমসি করেন। পারভেজ হোসেন ইমনের মতো তরুণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের অর্থ আটকে রাখা এবং মালিকদের আত্মতৃপ্তির অজুহাত দেখানো পেশাদার ক্রিকেটের জন্য লজ্জাজনক। অথচ আসর শুরুর আগে আয়োজকরা ঘোষণা দিয়েছিলেন, এটি হবে সর্বকালের সেরা বিপিএল।
দেশের রাজনৈতিক পালাবদলের পর নতুন উদ্যমে টুর্নামেন্ট আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বলা হয়, নতুন ব্যবস্থাপনা, উন্নত আয়োজন এবং পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বিপিএলকে এবার সত্যিকার অর্থেই অন্য উচ্চতায় নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবতা হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। মাঠে কয়েকটা ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা ও ব্যাটিং উইকেটের প্রশংসা থাকলেও পুরো আয়োজনে অপেশাদারিত্ব, আর্থিক জটিলতা এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের দেউলিয়াপনা সেই প্রতিশ্রুতিকে ম্লান করে দিয়েছে।
বিপিএল ইতিহাসে বিতর্কের অসীমে প্রথমবারের মতো কোনো বিদেশী ক্রিকেটার ছাড়া মাঠে নেমেছে দুর্বার রাজশাহী। গত ২৬ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে টস হেরে ব্যাটিং করতে নামে রাজশাহী। টসের সময় অধিনায়ক তাসকিন আহমেদ জানিয়ে দেন, কোনো বিদেশী ছাড়াই এই ম্যাচে মাঠে নামছেন তারা! বাইলজ অনুযায়ী সর্বনিম্ন দুজন বিদেশী ক্রিকেটারকে খেলাতেই হবে প্রতি ম্যাচে। আর সর্বোচ্চ চারজন খেলান যাবে। তবে ‘বিশেষ ব্যবস্থায়’ সেটি পরিবর্তনের নিয়মও রেখেছে বিপিএল কর্তৃপক্ষ।
রাজশাহীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশী ছাড়াই রাজশাহীকে বিপিএলে ম্যাচ খেলার অনুমতি দেয় টেকনিক্যাল কমিটি। পরবর্তীতে সেটি ব্যাখ্যা দিয়ে স্পষ্ট করে জানায়, রাজশাহীর অনুরোধ বিবেচনা করার পর বিপিএল ২০২৪-২৫ এর ম্যাচ খেলার শর্তাবলির ধারা ১.২.৮ অনুযায়ী, টেকনিক্যাল কমিটি এই ম্যাচের জন্য দুর্বার রাজশাহীকে শুধু বাংলাদেশী খেলোয়াড়দের নিয়ে দল গঠনের অনুমতি দিয়েছে।
এর আগে চট্টগ্রামে অনুশীলন বয়কট করেছিল রাজশাহীর খেলোয়াড়রা। তখন বিসিবির প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপে তড়িঘড়ি টাকা পরিশোধ করায় সংকটের সাময়িক সমাধান হয়। তবে ঢাকায় এসেও ঘটতে থাকে একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা। বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ক্রিকেটারদের পাওনা পরিশোধ করেনি নতুন মালিকানার এই ফ্র্যাঞ্চাইজিটি। অন্যরা আংশিক পেলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মার্ক দয়াল নাকি কানাকড়িও পাননি!
প্রাপ্তির আশায় স্থানীয় ক্রিকেটাররা হোটেলে অপেক্ষায় ছিলেন। তবে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে কোনো লাভ হয়নি খেলোয়াড়দের। উল্টো খবর ছড়িয়ে পড়ে, প্রায় সাত লাখ টাকা বাকি রাখায় ক্রিকেটারদের কিটব্যাগ আটকে রাখে দলটিকে বহনকারী বাস। পরে জানা যায়, কিটব্যাগ নিয়েই বাসায় ফিরেছেন ক্রিকেটাররা। কিভাবে যে এরা মালিকানা পেল, সেই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে সামনে আসবে।
এর আগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার পর এক ম্যাচে বিদেশীরা থেকে যান হোটেলে। এর মধ্যে হোটেল বিল বকেয়া থাকায় চট্টগ্রামে মালিকের কক্ষের সামনে নিরাপত্তারক্ষীর উপস্থিতি কিংবা ঢাকায় হোটেল বদলের মতো ঘটনাও ঘটে। শুধু পারিশ্রমিক নয়, খেলোয়াড়দের দৈনিক ভাতা ঠিকঠাক দেয়নি মালিকপক্ষ। সর্বশেষ ১১ দিনের ভাতা বাকি আছে। যাকে বলে একেবারে জেরবার অবস্থা।
এমন পরিস্থিতিতে দেশে ফেরার টিকিটকেই ‘বর’ মনে হয়েছে দলটির বিদেশীদের! চলতি বিপিএলে মাঠের ক্রিকেট যতই উত্তেজনা ছড়াক না কেন, মাঠের বাইরের এ ধরনের অপেশাদার আচরণ বিপিএলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তুলেছে বড় প্রশ্ন। পেশাদারিত্বহীনতা, দুর্নীতি আর ব্যবস্থাপনার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে কেন অন্য ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের চেয়ে পিছিয়ে বিপিএল। দেশীয় ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক মানে তুলে ধরা এবং দেশের ক্রিকেটের প্রসার-দুটো মিশনেই ব্যর্থ বিসিবি।
মাঠের বাইরের অগোছালোতা, ফিক্সিংয়ের অভিযোগ এবং খেলোয়াড়দের প্রতি ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের উদাসীন আচরণের পর অনেকেই বলছেন বিপিএল মানে হলো-বিতর্ক প্রিমিয়ার লিগ! অথচ এবারের বিপিএল শুরুর আগে আয়োজকরা ঘোষণা দিয়েছিলেন, এটি হবে সর্বকালের সেরা বিপিএল। রাজনৈতিক পালাবদলের পর নতুন উদ্যমে টুর্নামেন্ট আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। বলা হয়, নতুন ব্যবস্থাপনা, উন্নত আয়োজন এবং পেশাদারিত্বের মাধ্যমে বিপিএলকে এবার সত্যিকার অর্থেই অন্য উচ্চতায় নেওয়া হবে। যেখানে প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে ক্রীড়া উপদেষ্টা সবারই মেধার ছাপ থাকবে।
কিন্তু বাস্তবে হয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। মাঠে কয়েকটা ম্যাচে দুর্দান্ত খেলা ও ব্যাটিং উইকেটের প্রশংসা থাকলেও, পুরো আয়োজনে অপেশাদারিত্ব, আর্থিক জটিলতা এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকদের দেউলিয়াপনা সেই প্রতিশ্রুতিকে ম্লান করে দিয়েছে। মাঠের বাইরের বিতর্ক, খেলোয়াড়দের অর্থ না দেওয়া এবং ফিক্সিংয়ের অভিযোগ প্রমাণ করে দিয়েছে যে, বিপিএলকে সেরা করার প্রতিশ্রুতি শুধুই ছিল মুখের কথা।
নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কিংবা নতুন ব্যবস্থাপনা- কোনো কিছুই বিপিএলের গুণগত মান উন্নত করতে পারেনি। বরং বিপিএল আরও বিতর্কিত হয়ে উঠেছে এবার। প্রশ্ন হলো- বিসিবি কি এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেবে? ভবিষ্যতে কি এমন ত্রুটিপূর্ণ আয়োজন এড়িয়ে পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে ব্যবস্থা নেবে? প্রশ্নের উত্তর জানেন শুধুই বিসিবি কর্তারা। তবে আপাতত আশার আলো নেই!