মিরপুর শেরেবাংলায় ভক্তদের সঙ্গে এক ফ্রেমে তাসকিন-বিজয়রা
সময় এখন তাসকিনের- বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি২০, আন্তর্জাতিক কিংবা ঘরোয়া, দুর্দান্ত প্রতাপে ছুটছেন ‘ঢাকা এক্সপ্রেস’। ২০২৪ সালে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে তার উইকেট ৬৩টি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যা তৃতীয় সর্বোচ্চ, বাংলাদেশের হয়ে রেকর্ড সর্বোচ্চ। এর মধ্যে টি২০তে নিয়েছেন ৩০ উইকেট, দেশের ইতিহাসে যা রেকর্ড দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
বছরের একেবারে শেষভাগে প্রথমবারের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে টেস্ট জিতে ১-১এ সিরিজ ড্র করে ইতিহাসে গড়ে বাংলাদেশ। ১১ উইকেট নিয়ে জীবনে প্রথমবার সাদা পোশাকে হয়েছেন সিরিজসেরা। পুরস্কার হাতে সেদিন বলেছিলেন, ‘মেনি মোর টু কাম।’ এরপর অবিস্মরণীয় সেই টি২০ সিরিজ জয়ে শিকার ৭ উইকেট। ছন্দটা নতুন বছরেও ধরে রেখেছেন।
দুর্বার রাজশাহীর জার্সিতে চলতি বিপিএলে রেকর্ড বই তছনছ করে দিচ্ছেন ২৯ বছর বয়সী ডানহাতি পেসার। এক ম্যাচে ৭ উইকেটÑ বাংলাদেশের টি২০ ইতিহাসে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডগড়া তাসকিন আহমেদ এখন বিপিএলের এক আসরে সর্বোচ্চ ২৫ উইকেটের মালিক।
পরিসংখ্যানটা গত সোমবার পর্যন্ত। মিরপুরে আসরের চূড়ান্ত ও শেষ পর্বে সিলেট স্ট্রাইকার্সের বিপক্ষে ১ উইকেট নেন তাসকিন। আগেরদিনই রংপুর রাইডার্সের বিপক্ষে বহুল আলোচিত সেই ম্যাচে ২ উইকেট নিয়ে সাকিব আল হাসানকে ছাড়িয়ে বিপিএলের এক আসরে সর্বোচ্চ ২৪ উইকেটের রেকর্ড গড়েন। স্টিভেন টেইলরের উইকেট নিয়ে রেকর্ডটি স্পর্শ করেন। পরে রকিবুল হাসানকে এলবিডব্লিউ করে পা রাখেন নতুন উচ্চতায়।
এবারের বিপিএলে ১২ ম্যাচে ১২.০৪ গড়ে তার উইকেট এখন ২৫টি। ২০১৯ আসরে ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে ১৫ ম্যাচ খেলে ২৩ উইকেট নিয়েছিলেন সাকিব। তাকে ছাড়িয়ে যেতে তাসকিনের লাগল কেবল ১১ ম্যাচ। ফরচুন বরিশালের বিপক্ষে ৩ উইকে নিয়ে এই আসর শুরু করেন তাসকিন। পরের ম্যাচে ঢাকা ক্যাপিটালসের বিপক্ষে ১৯ রানে ৭ উইকেট নিয়ে তিনি তোলপাড় ফেলে দেন। পরের চার ম্যাচের দুটিতে তিনি দুটি করে উইকেটের দেখা পান, দুই ম্যাচে পাননি একটিও।
এরপর টানা চার ম্যাচের প্রতিটিতে উইকেট নেন দুটি করে। এবার রংপুরের বিপক্ষে আলোচিত ম্যাচে ১১৯ রানের পুঁজি নিয়েও আবার তার প্রাপ্তি দুটি উইকেট। টেবিল-টপার রংপুরকে ‘ব্যাক টু ব্যাক হারের’ স্বাদ দেয় রাজশাহী। শুধু এই ম্যাচই নয়, গোটা আসরের চিত্রই এটি। রাজশাহীর পারফরম্যান্স অধারাবাহিক। মাঠের বাইরে পারিশ্রমিক নিয়ে বিতর্কে দলটি খবরের শিরোনামে থাকছে নিয়মিতই। কিন্তু তাসকিন বল হাতে দুর্দান্ত ধারাবাহিক। আট ম্যাচের পর থেকে এনামুল হকের জায়গায় দলকে নেতৃত্বও দিচ্ছেন সামনে থেকে।
বিপিএলের এক আসরে ২২ উইকেট নেওয়ার নজির আছে ছয়টি। সেখানে আছেন তাসকিনও। ২০১৯ বিপিএলে ১২ ম্যাচে ২২ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি সিলেট সিক্সার্সের হয়ে। এই কৃতিত্ব প্রথম দেখিয়েছিলেন কেভন কুপার। ক্যারিবিয়ান এই পেসার ২০১৫ বিপিএলে বরিশাল বুলসের হয়ে ২২ উইকেট নিয়েছিলেন মাত্র ৯ ম্যাচ খেলেই।
পরে ২০১৭ বিপিএলে ঢাকা ডায়নামাইটসের হয়ে ১৩ ম্যাচে ২২ উইকেট নেন সাকিব, ২০১৯ আসরে রংপুর রাইডার্সের হয়ে ১৪ ম্যাচে ২২টি নেন মাশরাফি বিন মুর্তজা, একই আসরে ঢাকা ডায়নামাইটসের রুবেল হোসেন ২২ উইকেট নেন ১৫ ম্যাচে। সবশেষ গত বিপিএলে দুর্দান্ত ঢাকার হয়ে ১২ ম্যাচে ২২ উইকেটের দেখা পান শরিফুল ইসলাম। বিতর্ক-বিসংবাদ পেছনে ফেলে রাজশাহী প্লে-অফে উঠে গেলে বিশ্ব রেকর্ড গড় স্বপ্ন দেখাও শুরু করে দিতে পারেন। তবে কাজটি কঠিন।
স্বীকৃত টি২০তে এক টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ডটি ৩৩। সেই রেকর্ড ভাগাভাগি করছেন দুজন। ২০১০ সালে ইংল্যান্ডের ফ্রেন্ডস প্রভিডেন্ট টি২০তে আলফনসো টমাস ও ২০২৪ সালে ইংল্যান্ডেরই ভাইটালিটি ব্লাস্টে ডেভিড পেইন নিয়েছিলেন ৩৩টি করে উইকেট। যদিও টমাস ম্যাচ খেলেছিলেন ১৯টি, পেইন ১৭টি। এবারের বিপিএলে রাজশাহী মানেই একের পর এক বিতর্ক। সর্বশেষ টাকা না পেয়ে কাল তাদের বিদেশী ক্রিকেটাররা মাঠেই আসেননি, ম্যাচের আগে বদলাতে হয়েছে হোটেল।
‘দিনের (রংপুুর ম্যাচের আগের দিন) শুরু থেকেই অনেক ড্রামা দেখেছি আমরা সব খেলোয়াড়। আমি যতটুকু শুনেছি, টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে নাকি টাকা নিয়েও রুমে নক করেছে, কিন্তু বিদেশীদের কেউ দরজা খোলেনি!’
তাসকিনের জীবনে এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম, ‘আমার জীবনেও নতুন অভিজ্ঞতা হলো...ম্যাচের দিন হোটেল বদলানো। আমাদের যেটা বলা হয়েছে, আমাদের রুম বুকিং দেওয়া ছিল শেরাটনে, পরে ওয়েস্টিনে ছিলাম। ওয়েস্টিনে নাকি সব রুম বুক হয়ে গেছে। সে জন্য হোটেল বদলালাম। বোর্ড থেকেও আমাদের ফোন দিয়ে বলল, ‘আসো, খেলো।’ বিদেশিদের বলেছে, ‘পেমেন্ট সমস্যা নয়, তোমরা আসো।’
বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ তাঁদের আশ্বস্ত করেছেন, ফ্রাঞ্চাইজি টাকা না দিলে বোর্ড সেটা মিটিয়ে দেবে। তবু যেন ক্রিকেটাররা খেলেন। অবশ্য স্থানীয় খেলোয়াড়দের দ্বিতীয় ২৫ শতাংশের চেক এরই মধ্যে বিসিবিকে দিয়েছে দুর্বার রাজশাহী কর্তৃপক্ষ। যদিও বিপিএলের বলগুলোর মতো চেকও বাউন্স করে কি না, সে সংশয় আছে, ‘আশা করি হবে না, উইকেটের মতো বাউন্স করবে না (চেক)!’ হাসতে হাসতেই বলছিলেন তিনি।
জাতীয় দলে অধিনায়কত্ব করার ইচ্ছের কথা নানা সময়েই টুকটাক বলেছেন তাসকিন। এবার সুযোগটা তার সত্যিই আসতে পারে সামনে, ‘এসব তো দেরি আছে... কালকে (সোমবার) একটা ম্যাচ আছে। প্রক্রিয়াতেই থাকি। যখন সময় হবে, সবকিছু সময়ের সঙ্গেই হবে। তকদির বলেও কিছু ব্যাপার আছে। সামনে অনেক ক্রিকেট খেলা আছে। একজন ক্রিকেটার হিসেবে স্রেফ উপভোগ করতে চাই আর উন্নতির ধারা ধরে রাখতে চাই।
আল্লাহ যেন আমাকে সুস্থ রাখেন, এটাই চাওয়া। আসলে ওগুলো (অধিনায়কত্ব) নিয়ে চিন্তা করছি না। যদি সময় আসে, কখনো এলে দেখা যাবে...।’