তামিম ইকবালের নেতৃত্বে মুশফিকুর রহিম-মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ-তাওহিদ হৃদয়রা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন চ্যাম্পিয়ন ফরচুন বরিশালকে
এবারের বিপিএল যেন একই অঙ্গে এত রূপ! পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যাত্রার শুরুটা হয়েছিল ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে। গত ৩০ ডিসেম্বর ব্যাট-বলের দ্বৈরথ মাঠে গড়ানোর সপ্তাহ খানেক আগে থেকেই শুরু হয়েছিল সে আয়োজন। নতুন থিম সং, নতুন মাসকট, দেশী-বিদেশী সংগীত তারকাদের নিয়ে একের পর এক কনসার্ট। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রংপুরে ট্রফি প্রদর্শনী। তবে সবচেয়ে আকর্ষণ হয়ে হাজির হয় ব্যাটিং-ট্র্যাক।
অবশ্য অব্যবস্থাপনা আর বিতর্কও কম নেই। মিরপুরে শুরুতেই টিকিট নিয়ে বিশৃঙ্খলা রীতিমতো বিক্ষোভে রূপ নিয়েছিল। অনলাইনে জ্যাম, কাউন্টার সংকট আরও কত কী। আরেক বড় বিতর্ক তৈরি হয় দুর্বার রাজশাহীর ক্রিকেটারদের আর্থিক পাওনা নিয়ে। নিয়ম অনুযায়ী অগ্রিম অংশ না পাওয়ায় ম্যাচ বয়কটের ঘোষণা দিয়েছিলেন তাসকিন আহমেদ, এনামুল হক বিজয়রা।
পরে বিসিবি প্রধান ফারুক আহমেদের হস্তক্ষেপে জরুরি অর্থ পরিশোধ করা হয়। আসরে ফরচুন বরিশাল অধিনায়ক তামিম ইকবাল ও রংপুর রাইডার্সের ইংলিশ রিক্রুটার অ্যালেক্স হেলসের দ্বন্দও বেশ আলোচিত। চিরায়ত বদনাম ঘুচিয়ে মিরপুরে যে চার-ছক্কার ফুলঝুড়ি ছুটেছিল সিলেট সেটি রীতিমতো রান-বন্যার ঢেউয়ে রুপ নেয়। সেঞ্চুরিতে, রানে হয় নতুন নতুন সব রেকর্ড। চট্টগ্রাম পর্বেও সে ধারা অব্যাহত থাকে।
যেখানে রীতিমতো উড়ছে দেশের ইতিহাসে প্রথম ফ্র্যাঞ্চাইজি হিসেবে গায়ানা থেকে গ্লোবাল টি২০ লিগের (জিএসএল) শিরোপা জিতে আসা রংপুর রাইডার্স। টানা আট ম্যাচের সবকটি জিতে সবার আগে প্লে-অফের টিকিট নিশ্চিত করেছে নুরুল হাসান সোহানের দল। দুদিন আগে চট্টগ্রাম থেকে জিএসএল ও বিপিএলের ট্রফি প্রদর্শনের জন্য হেলিকপ্টারে করে রংপুর শহরে উড়ে আসেন সৌম্য সরকার, নাহিদ রানারা।
রীতিমতো জনসমুদ্রের রূপ নেয় শহরের অলিগলি। বিপিএলে টানা আট ম্যাচ জিতে আসা দলটি উষ্ণ ভালোবাসায় সিক্ত হয় শহরটি। সোমবার (২০ জানুয়ারি) দুপুর ২টার দিকে হেলিকপ্টারে উড়ে আসেন রাইডার্সের খেলোয়াড়েরা। প্রিয় দলকে এক নজর দেখার অপেক্ষায় ভক্ত অনুরাগীসহ ক্রীড়ামোদিরা। এ যেন এক ভিন্ন আমেজ। প্রিয় খেলোয়াড়দের উষ্ণ অভ্যর্থনা দিতে হাজারো ক্রিকেটপ্রেমী আসেন রংপুর স্টেডিয়ামে। সকাল থেকে আসা দর্শকরা দুপুরে খেলোয়াড়দের পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন।
হেলিকপ্টার স্টেডিয়ামে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই তিস্তা পাড়ের মানুষের স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয় রংপুর স্টেডিয়াম। প্রায় আধাঘণ্টা অপেক্ষার পর সেনাবাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় সৌম্য, নাহিদ রানা, সাইফউদ্দিন ও নুরুল হাসান সোহানরা রাইডার্স ড্রেসিংরুমে প্রবেশ করেন। এ সময় দর্শকদের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারে কিছুটা লাঠিপেটা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিকেলে খোলা বাসে ট্রফি নিয়ে রংপুর শহর প্রদক্ষিণ করেন।
বিপিএল ট্রফি ট্যুরের অংশ হিসেবে বিপিএল ট্রফিও সঙ্গে নিয়ে আসে রংপুর রাইডার্স। এ সময় সড়কের পাশে থাকা হাজারো দর্শক হাত উঁচিয়ে অভিনন্দন জানান প্রিয় খেলোয়াড়দের। এমন আয়োজনে খুশি রংপুরবাসী। দাবি জানান রংপুরে আন্তর্জাতিকমানের স্টেডিয়ামের। বিকেল ৪ টার দিকে খোলা বাসে ট্রফি নিয়ে রংপুর শহর প্রদক্ষিণ করেন। সড়কের পাশে থাকা হাজারো দর্শক হাত উঁচিয়ে অভিনন্দন জানান প্রিয় খেলোয়াড়দের।
এদিকে এমন আয়োজনে খুশি রংপুরবাসী। আরাফাত ইসলাম নামে একজন দর্শক বলেন, এই প্রথম এমন আয়োজনে আমরা খুব খুশি। আমরা চাই রংপুর একটা আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম। যাতে আমরা ঘরে বসে বিপিএলের খেলা উপভোগ করতে পারি। এটা আমাদের প্রাণের দাবি। আমরা স্টেডিয়াম চাই। প্রিয় টিমের প্রিয় খেলোয়াড়দের কাছে পেয়ে আপ্লুত আশিক নামে এক ক্রিকেটপ্রেমী বলেন, আমাদের আজ আনন্দের দিন। ঈদের খুশি লাগছে। প্রিয় খেলোয়াড়দের কাজ থেকে দেখেছি। এ যেন এক ভিন্নরকম অনুভূতি।
উত্তরবঙ্গের মানুষের বাঁধ ভাঙ্গা উল্লাস মনে ধরেছে সাবেক ক্রিকেটের ও রংপুর রাইডার্স সহকারী কোচ মোহাম্মদ আশরাফুলের। তিনি জানান, রংপুর মানুষের এমন উপস্থিতি প্রমাণ করে রাইডার্স হোম গ্রাউন্ড হিসেবে রংপুরে আন্তর্জাতিকমানের স্টেডিয়াম সময়ের অপেক্ষা। মাঠে প্রবেশের পর মঞ্চে আসে রংপুর রাইডার্সের ক্রিকেটাররা। মঞ্চে এসে মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ হন সব ক্রিকেটার। একে একে দর্শকদের ধন্যবাদ দেন ক্রিকেটার ও কোচরা।
রংপুরের অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহান বলেন, ‘আপনাদের ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ। দোয়া করবেন যেনো বিপিএল ট্রফিটা নিয়ে আসতে পারি। বসুন্ধরা গ্রুপকেও ধন্যবাদ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আসলে ভাগ্যবান। এমন একটি দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছি যারা দল হিসেবে গড়ে উঠেছে। কতজন তারকা খেলোয়াড় আছে, সেটি বড় নয়। দল হিসেবে খেলাটাই গুরুত্বপূর্ণ। এটিই সাফল্যের মূলমন্ত্র। ব্যক্তিগত পারফর্ম্যান্সের চেয়ে একসঙ্গে খেলাকে আমি বেশি গুরুত্ব দেই। আমরা যদি এভাবে একতাবদ্ধ হয়ে থাকতে পারি, তাহলে অনেক দিক থেকেই উপকৃত হব।’
এদিকে বিপিলের শিরোপা জিতে আবারও রংপুরের মাটিতে পা রাখার প্রতিশ্রুতি দেন রাইডার্স অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহান। আর দলের টিম ডিরেক্টর শানিয়ান তানিম জানান, ‘বসুন্ধরা গ্রুপ এদেশের ক্রিকেট বদলে দিচ্ছে। রংপুর রাইডার্স এই মাঠে এসে বিপিএলের অনুশীলন করবে, ম্যাচ খেলবে সুযোগ থাকলে। আমরা ট্রফি নিয়ে আবার রংপুরে আসব।’ হেড কোচ মিকি আর্থার বলেন, ‘আসসালামু আলাইকুম। যদিও আমি অনেক বেশি বাংলা জানি না। তবে আপনাদের ভালোবাসায় আমি অবাক।’
পরে দেড় হাজার জার্সি বিতরণ, বিপিএল মাসকট ‘ডানা ৩৬’-এর উপস্থিতি এবং দেশবরেণ্য ব্যান্ড ‘এভোয়েড রাফা’র কনসার্ট মেতে উঠেন দর্শকরা। উল্লেখ্য, গত ৬ ডিসেম্বর গায়ানায় গ্লোবাল সুপার লিগের ট্রফি জিতেছিল রংপুর। যেখানে পাঁচ দলের এই টুর্নামেন্টে ভিন্ন পাঁচ দেশের সেরা পাঁচ দল অংশ নিয়েছিল। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটের শক্তিশালী ভিক্টোরিয়াকে ৫৬ রানে হারিয়ে ট্রফি জিতেছিল নুরুল হাসান সোহানের নেতৃত্বাধীন রংপুর রাইডার্স। ৫৪ বলে অপরাজিত ৮৬ রান করে ম্যাচসেরা হন সৌম্য সরকার। বিপিএলেও দুর্দান্ত ছন্দে আছে দলটি।
জয় পেয়েছে আসরের সব ম্যাচেই। বিপিএলেও অব্যাহত সাফল্যের সেই ধারা। আসরে এখনো পর্যন্ত ৮টি ম্যাচ খেলেছে রংপুর। যেখানে সবকটি ম্যাচেই শেষ হাসি হেসেছে তারা। ৮ জয়ে ১৬ পয়েন্ট নিয়ে সবার আগে প্লে অব নিশ্চিত করেছে তারা। পয়েন্ট টেবিলেও শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে রাইডার্সরা। মিরপুরে ঢাকা ক্যাপিটালসের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আসর শুরু করেছিল রংপুর। ঢাকার ঘরের মাঠে স্বাগতিকদের ৪০ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে শুরুতেই নিজেদের সামর্থ্যরে জানান দেয় তারা।
পরের ম্যাচে সিলেট স্ট্রাইকার্সকে হারায় ৩৯ রানে। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফরচুন বরিশালকে হারিয়ে জয়ের হ্যাটট্রিক পূর্ণ করে রংপুর। সেটাও ৩০ বল আর ৮ উইকেট হাতে রেখে দাপুটে এক জয়ে। এরপর ফিরতি ম্যাচেও যথাক্রমে সিলেট, ঢাকা ও বরিশালকে হারায় রংপুর। খুলনা টাইগার্সের সঙ্গে প্রথম দেখায় বেশ জমজমাট লড়াই হয়েছে রংপুরের। তবে শেষ হাসিটা রংপুরের মুখেই ছিল। শেষ পর্যন্ত ৮ রানের জয় পায় তারা।
আর সর্বশেষ চিটাগাং কিংসকে ৩৩ রানে হারিয়ে অপরাজিত থেকে প্লে-অফ নিশ্চিত করে সোহানের দল। রংপুরের সাফল্যে ব্যাট হাতে রানের ফোয়াড়া ছোটাচ্ছেন খুশদিল শাহ (২৭৪), সাইফ হাসান (২৪৫), অ্যালেক্স হেলস (২১৮), ইফতিখার আহমেদরা (২০৭)। বোলিংয়ে আকিফ জাভেদ (১২ উইকেট), খুশদিল (১১), শেখ মেহেদী (৯), নাহিদ রান (৯) দুরন্ত-দুর্বার নৈপুণ্য প্রদর্শন করছেন। কাগজে-কলমে এবারের বিপিএলের সেরা দল রংপুর।
ফ্র্যাঞ্চাইজিটির কোচ হিসেবে আছেন দক্ষিণ আফ্রিকান গ্রেট মিকি আর্থার, সহকারী কোচ সাবেক টাইগার তারকা মোহাম্মদ আশরাফুল। মাঠ ও মাঠের বাইরে তারায় তারায় খচিত এক ফ্র্যাঞ্চাইজি। বিপিএলে রংপুর এখন পর্যন্ত একবারই চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে, সেটা ২০১৭ সালের পঞ্চম আসরে। সোহান, নাহিদ, সৌম্যরা কি পারবেন দ্বিতীয় শিরোপা উপহার দিতে, সেটিই এখন দেখার অপেক্ষা।