বাংলাদেশের অন্য অনেক ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও রেকর্ড সংরক্ষিত নেই। দুই দলের মুখোমুখি ম্যাচের ফলাফলের বিস্তারিত রেকর্ড নেই বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এবং মোহামেডান-আবাহনী কারও কাছে। সেই ইতিহাস সংরক্ষণের কাজটি করেছেন মোহামেডানের সমর্থক টি ইসলাম তারিকইতিহাস
বিনোদনের নির্মল মাধ্যম খেলাধুলা। আর খেলাধুলার প্রাণ হচ্ছে দর্শক, ভক্ত, সমর্থক। বিশ্বের অসংখ্য দেশ কিংবা ক্লাবের সাফল্যের পেছনে ভক্ত-সমর্থকদের অবদান অসামান্য। বিশেষ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠিত নামী-দামী ক্লাবের রয়েছে বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী। যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সেসব দেশের ক্লাব কিংবা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নতিতে কাজ করে থাকেন। বাংলাদেশেও রয়েছে এ রকম একটি ক্রীড়াপাগল সংগঠন। যার নাম ব্যতিক্রমধর্মী মোহামেডান সমর্থকদল ‘মহাপাগল’।
এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সংগঠনটি দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আলোচিত একটি নাম। যারা একটা সময় মৃতপ্রায় ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডকে আবার চাঙ্গা করতে বিভিন্ন উদ্দীপ্তমূলক কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। বলা যায় মোহামেডানের বর্তমানে জেগে ওঠার পেছনে এই সমর্থকগোষ্ঠীর আছে অনবদ্য অবদান। এই সমর্থকগোষ্ঠীর প্রাণপুরুষ মোহামেডানের অন্তঃপ্রাণ সমর্থক ও ক্রীড়া লেখক টি ইসলাম তারিক। তার সুদক্ষ নেতৃত্বে মোহামেডান তথা দেশীয় ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে কাজ করে চলেছে মহাপাগল।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে বড় অংশজুড়ে আবাহনী ও মোহামেডান। বিশেষ করে ফুটবলে এই দুই দলের দ্বৈরথ জন্ম দিয়েছে অনেক ইতিহাসের। সত্তর-আশি-নব্বই দশকে এ দেশের মানুষের বিনোদন ছিল দুটি। একটি চলচ্চিত্র, অন্যটি ফুটবল। ফুটবলে যে দুই দল নিয়ে পুরো দেশ বিভক্ত হয়ে যেত, সেই দল দুটি হচ্ছে আবাহনী ক্রীড়া চক্র (পরে আবাহনী লিমিটেড ঢাকা) এবং মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। যদিও ক্লাব দুটির বয়সের ফারাক ৩৬ বছরের। মোহামেডানের জন্ম ১৯৩৬ আর আবাহনীর জন্ম ১৯৭২ সালে। এই দুই দলের মধ্যে দ্বৈরথ নিয়ে কত যে ক্রেজ, দ্বন্দ্ব-তর্ক-ঘটনা ঘটেছে, তার কোনো হিসাব নেই। যেকোনো পর্যায়ের ফুটবলে এই দল দুটি মোট কতবার-কোথায় মুখোমুখি হয়েছে, কে কতবার জিতেছে, ম্যাচগুলোতে কারা খেলেছেন, এসব তথ্য-পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন তো বটেই, এমনকি আবাহনী-মোহামেডানের কাছেও নেই। নেই ক্রীড়া সাংবাদিকদের কাছেও। কিন্তু একজনের কাছে আছে। তিনি টি ইসলাম তারিক। বহু বছরের সাধনার মাধ্যমে তিনি এই দুই দলের সব তথ্য-পরিসংখ্যান-ইতিহাস সংরক্ষণ করে অসাধ্যকে সাধ্য করেছেন। সেটা ১১ জানুয়ারি ‘মোহামেডান-আবাহনী ময়দানি লড়াই’ বই প্রকাশ করে। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) মিলনায়তনে হয়েছে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান। এর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে ‘রূপকথার মোহামেডান-আবাহনী’ নামে আরও একটি বই প্রকাশ করেন টি ইসলাম তারিক।
রাজউকের অংকনবিদ টি ইসলাম তারিক মোহামেডানের অন্তঃপ্রাণ সমর্থক, ক্রীড়া লেখক এবং মোহামেডানের ব্যতিক্রমধর্মী সমর্থকগোষ্ঠী ‘মহাপাগল’-এর প্রতিষ্ঠাতা কর্ণধার। পুরনো দিনের সব পত্রিকা-ম্যাগাজিন ঘেঁটে ও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সহায়তা নিয়ে তিনি ১৯৭৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৫০ বছরে আবাহনী-মোহামেডানের লিগ ও টুর্নামেন্টে প্রীতি ম্যাচ মিলিয়ে মোট ১৩৬ ম্যাচের সব ফলাফল নিয়ে অসাধারণ এক সংকলিত গ্রন্থ রচনা করেছেন। বর্ষীয়ান ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মুহাম্মদ কামরুজ্জামান বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন। মোহামেডানের কিংবদন্তি প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, ছাইদ হাসান কানন, ইমতিয়াজ আহমেদ নকীবের পাশাপাশি আবাহনীর কিংবদন্তি আবদুস সাদেক, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, কাজী আনোয়ার অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত সাবেক ফুটবলাররা লেখকের গ্রন্থকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। বইটির দাম ১৫০০ টাকা। ২৫ শতাংশ ছাড়ে ১১২৫ টাকায় বইটি সংগ্রহ করা যাবে অন্বেষা প্রকাশনী এবং রকমারি ডটকম থেকে। তথ্যসমৃদ্ধ বইটি প্রকাশ করেছে অন্বেষা প্রকাশন। আগামী একুশে বইমেলাতেও বইটি পাওয়া যাবে।
লেখকের তথ্যমতে, ১৯৭৩-২০২৩ এই ৫০ বছরে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দল ফুটবলে ১৩৬ বার মুখোমুখি হয়েছে। এর মধ্যে মোহামেডান ৪৭ বার (টাইব্রেকারে ১০) এবং আবাহনী ৪৯ বার (টাইব্রেকারে ৪) জিতেছে। অমীমাংসিত ছিল ৩৪ বার, পরিত্যক্ত ৫ এবং ওয়াকওভার হয়েছে একটি ম্যাচে। জয়-পরাজয়ের পাশাপাশি দুই দলের হেড টু হেডে গোল সংখ্যা, গোলদাতা, অধিনায়ক ও কোচের নামও রয়েছে এই গ্রন্থে। মোহামেডান সমর্থকের বই হলেও এটি উৎসর্গ করা হয়েছে আবাহনীর প্রয়াত কিংবদন্তি মোনেম মুন্না ও মোহামেডানের প্রয়াত বাদল রায়কে। সাধারণত লেখকের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনকে বই উৎসর্গের রীতি থাকলেও ‘মোহামেডান-আবাহনী ময়দানি লড়াই’ ব্যতিক্রম। লেখক টি ইসলাম তারিক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ক্রীড়াঙ্গনের বই। এ কারণে দুই ক্লাবের দুই প্রয়াত কিংবদন্তিকে উৎসর্গ করেছি। বাদল দা মোহামেডান ছাড়া অন্য কোনো ক্লাবে খেলেননি। আমরণ মোহামেডানের সঙ্গে ছিলেন। অন্যদিকে মোনেম মুন্না আবাহনী তো বটেই, দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ও সেরা ফুটবলারদের একজন। তাই এই দু’জন প্রয়াতকে উৎসর্গ করা হয়েছে।’
সেই আশির দশক থেকে মোহামেডানের ফুটবল ম্যাচ গ্যালারিতে বসে উপভোগ করার চেষ্টা করেন। যে কারণে ঐতিহাসিক বই প্রকাশ করতে পেরে আবেগাল্পুত টি ইসলাম তারিক বলেন, ‘মোহামেডান-আবাহনীতে যারা খেলেছেন অনেকের নাম ক্লাবে সংরক্ষিত নেই। এই বইয়ে প্রতি ম্যাচের ফলাফলের পাশাপাশি খেলোয়াড়দের তালিকা এবং রেফারির নামও রয়েছে। যা তাদের একটি স্বীকৃতিও। এটা আমার তৃপ্তির একটা জায়গা।’ বই প্রকাশ অনেক কষ্টসাধ্য বিষয়। এরপর ক্রীড়াঙ্গনের ঐতিহাসিক বই তো আরও দুরূহ। বই সম্পাদনের কাঠখড় পোড়ানো সম্পর্কে লেখক বলেন, ‘এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমি এ নিয়ে কাজ করছি। ১৯৮০-৯৫ পর্যন্ত মোহামেডান আবাহনীকে হারানো ম্যাচের পত্রিকার কাটিং আমার কাছে ছিল। যখন চিন্তা করলাম বই বের করব, তখন আবাহনীর জয়ের ম্যাচেরগুলোও সংগ্রহ করেছি। বাংলাদেশ আর্কাইভে গিয়ে পত্রিকা-ম্যাগাজিন ঘেটে প্রতিটি খেলার ফলাফল সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেছি।’
আলোচিত বইটি ক্রীড়াঙ্গনে সাড়া ফেলেছে। অনেকে বলছেন, বইটি দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে দলিল হয়ে থাকবে। কেননা স্বর্ণালি দিনের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহামেডান ও আবাহনীর উত্তেজনাপূর্ণ ও শ্বাসরুদ্ধকর সব দ্বৈরথের ছোঁয়া আছে বইটিতে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রয়াস থেকেই মূলত বইটি প্রকাশিত হয়েছে। বইটির পেছনে অক্লান্ত শ্রম দিয়েছেন লেখক। সময়ের বিবর্তনে বর্তমান প্রজন্মের কাছে মোহামেডান ও আবাহনীর ধ্রুপদী লড়াই এখন অনেকটাই রূপকথার গল্প। কিন্তু সত্তর, আশি, নব্বইয়ের দশকে যারা ঢাকার মাঠে বসে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর লড়াই উপভোগ করেছেন তারা এখনও সেসব ম্যাচের স্মৃতিগুলো রোমান্থন করতে গিয়ে নষ্টালজিক হয়ে পড়েন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধারার প্রয়াস থেকেই মূলত বইটি প্রকাশ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই বই বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশের ক্লাব ফুটবলের অসাধারণ প্রামাণ্য দলিল ও ইতিহাস হয়ে থাকবে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বে দুটো ফুটবল ক্লাবের ইতিহাস এবং দ্বৈরথ নিয়ে এমন বিশাল বই এর আগে কোনো দেশে প্রকাশিত হয়নি।
বাংলাদেশ ক্রিকেট সাপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জুনায়েদ পাইকার বলেন, ‘ফুটবলের প্রতি মানুষের এতটা প্রেম থাকতে পারে, তারিক ভাইয়ের সান্নিধ্য না পেলে কোনোদিন অনুধাবন করতে পারতাম না। তিনি অসাধ্যকে সম্ভব করেছেন। মোহামেডান-আবাহনীর ৫০ বছরের দ্বৈরথের গল্প এক মলাটে বন্দি করেছেন। তৈরি করেছেন বাংলাদেশ ক্রীড়া ইতিহাসের এক অনন্য রেফারেন্স বুক, যার তথ্যগুলো গুগল, উইকিপিডিয়া, এমনকি চ্যাটজিপিটিও এখনো দিতে পারবে না। এটি সত্যিই অবিশ্বাস্য, অসাধারণ এবং অনবদ্য!’ মোহামেডানের অন্তঃপ্রাণ সমর্থক টিক্কু জামান বলেন, ‘ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছি আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ম্যাচের দিন গোটা শহরের মানুষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কিংবা ভারত-পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচে! তেমনি মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচের দিনও এদেশের মানুষ দু’ভাগে ভাগ হয়ে যেত। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের সেই ঐতিহাসিক দ্বৈরথ এক মলাটে নিয়ে এসে ঐতিহাসিক কাজ করেছেন তারিক ভাই। আমি বিশ্বাস করি অনন্য কাজ করার জন্য তারিক ভাইকে জাতীয় পর্যায় থেকে পুরস্কৃত করা হবে।’
এটিএন বাংলা টেলিভিশনের ক্রীড়া সম্পাদক পরাগ আরমান বলেন, ‘ইতিহাসের সন্ধান না করলে নতুন পথের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রজন্ম বঞ্চিত হবে গর্বিত ঐতিহ্য থেকে। টি ইসলাম তারিকের ‘মোহামেডান-আবাহনী ময়দানি লড়াই’ বইটি সেই ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক স্মারক। মোহামেডান-আবাহনী’র ৫০ বছরের সকল দ্বৈরথের তথ্যের প্রয়োজন হলে এই বইটির ওপর নির্ভর করা যাবে। সেই হিসেবে বইটিকে চলমান ইতিহাসও বলা যায়।’