ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

নক্ষত্রের পতন আর কিংবদন্তির বিদায়

শাকিল আহমেদ মিরাজ  

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ১৪ জানুয়ারি ২০২৫

নক্ষত্রের পতন আর কিংবদন্তির বিদায়

.

৬ জুলাই ২০২৩, স্থান চট্টগ্রামের টাওয়ার ইন হোটেল। আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের মধ্যপথে অশ্রুসিক্ত চোখে তামিম ইকবাল যখন আচমকাই অবসরের ঘোষণা দেন, দেশের ক্রিকেটে সেটা ছিল বড় বিস্ফোরণ। তখন তিনি অধিনায়ক, ব্যাটিংয়ে- নেতৃত্ব বাংলাদেশকে তুলেছিলেন বিশ্বকাপের মঞ্চে। বিশ্বকাপের আগে অমন কিছুর আভাস কিংবা প্রত্যাশা, কিছুই ছিল না। অবসরের পরদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে আবার অবসর তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্তও ছিল মহানাটকীয়। তবু খেলা হয়নি বিশ্বকাপে! এক সময়ের বন্ধু সাকিব আল হাসানের সঙ্গে বিরোধের বিষয়টি নতুন করে উঠে আসে আলোচনায়। এবার আর তেমন নাটকীয় কিছু হয়নি। বরং অনুমিত পথই বেছে নিয়েছেন দেশসেরা এ ওপেনার। সামাজিক মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন বিদায়ের সিদ্ধান্ত। কাকতালীয়ভাবে তাতে না থেকেও থাকলেন সাকিব! কারণ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির দলে জায়গা হয়নি তার। গত বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপের সময়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলে সব ফরম্যাট থেকে অবসরের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। নাটকীয় কোনো পালাবদল না হলে ধরে নেওয়া যায়, বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারও শেষ।
দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পথ ধরে বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর ফারুক আহমেদ প্রকাশ্য নানা সময়েই বলেছেন, তামিমকে ফিরে আসতে দেখলে তার ভালো লাগবে। অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় নিজের ইচ্ছার কথা কয়েক দফায় তিনি বলেছেন তামিমকে। তবে তামিম প্রতিবারই তাকে ‘না’ করে দেন। সেই প্রক্রিয়ারই অংশ নির্বাচকদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন তামিম। ফেসবুকে বিদায়ী বার্তায় তামিম উল্লেখ করেছেন, ২০২৩ বিশ্বকাপের আগের ধাক্কায় তার হৃদয়ে ক্ষত রয়ে গেছে এখনো, যেহেতু তার সরে দাঁড়ানো ক্রিকেটীয় কারণে ছিল না। এবার নির্বাচকদের সঙ্গে বৈঠকেও সেই সময়ের প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তখনকার নির্বাচক কমিটি, বোর্ডপ্রধান, কোচ-অধিনায়ক কেউই আর নেই। বদলে যাওয়া বাস্তবতায় বোর্ড ও নির্বাচকদের দৃষ্টিভঙ্গি যে বদলে গেছে, এটা তামিমের কাছে তুলে ধরেন প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। দলের প্রয়োজনের কথাও তিনি উল্লেখ করেন বারবার। তার অভিজ্ঞতা দলের কতটা প্রয়োজন, টপ অর্ডারে নির্ভরতা ও স্থিতিশীলতা কতটা জরুরি, এসব তামিমের কাছে ব্যাখ্যা করেন নির্বাচকরা। প্রথম দফায় বৈঠকে তার পরও ‘না’ বলেই দিয়েছিলেন। নির্বাচকরাও ফিরে গিয়েছিলেন সেই উত্তর জেনে। পরে জাতীয় দলের কয়েকজন ক্রিকেটার তামিমকে আবার অনুরোধ করতে থাকেন সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে। অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তও একান্তে  অনুরোধ জানান। 
এরপর প্রধান নির্বাচক আরেক দফায় বৈঠক করেন তামিমের সঙ্গে। এবার পরিবারের সঙ্গে কথা বলার জন্য একটু সময় নেন তামিম। বৃহস্পতিবার বিপিএলের ম্যাচ খেলে পরদিন সকালে ঢাকায় ফেরেন ফরচুন বরিশাল অধিনায়ক। নির্বাচকদের সঙ্গে বৈঠকের আগেই স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয় তার।  ঢাকায় ফিরে কথা বলেন আরেকবার। তামিমের বিদায়ী বার্তায় উল্লেখ আছে ছেলের কথা, যে তার বাবাকে আবার দেশের জার্সিতে দেখতে মুখিয়ে ছিল। ঢাকার বাসায় ফিরে ৯ বছর বয়সী ছেলের সঙ্গেও আলাদা করে কথা বলেন তিনি। এছাড়াও শুভাকাক্সক্ষী ও ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গেও তিনি আলোচনা করেন। এরপর গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগকে নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন তামিম। রাতেই তা ঘোষণা করে দেন সামাজিক মাধ্যমে। কথা হয় লিপুর সঙ্গেও। নিজেদের দিক থেকে কিছুটা দুঃখবোধের কথা জানিয়ে তামিমের ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা জানান প্রধান নির্বাচক। ২০১৮ এশিয়া কাপেই যেমন আঙুলে ব্যান্ডেজ নিয়ে গ্লাভস কেটে ব্যাটিংয়ে নেমে যেদিন এক হাতের বীরত্ব দেখিয়েছিলেন, তখন তিনি ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন ক্রিকেটের সীমানাও। টাইগার ক্রিকেট ইতিহাসের সঙ্গেই সমানে জড়িয়ে থাকবে তামিমের নাম। কত অর্জন, অনেক কীর্তি। রেকর্ড হয়ত সবসময় বাস্তবতা তুলে ধরতে পারে না, তবে লেখা থাকে ইতিহাসের পাতায়। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি২০- তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ১৫ হাজার রান করা প্রথম ব্যাটসম্যান তামিম। তার নামের পাশে আছে ১৫১৯২ রান। পরে তাকে ছাড়িয়ে যান মুশফিকুর রহিম। ১৫৩০০ রান নিয়ে এখন শীর্ষে এই উইকেটরক্ষক-ব্যাটার। ওয়ানডেতে ২৪৩ ম্যাচে ৮৩৫৭ রান নিয়ে শীর্ষে তামিম। সেঞ্চুরি ১৪ ও হাফ সেঞ্চুরি ৫৬টি। ৭৭৯৩ রান নিয়ে দুইয়ে মুশফিক। তিন সংস্করণ মিলিয়ে তামিমের সেঞ্চুরি ২৫টি (১০+১৪+১)। বাংলাদেশের আর কারও ২০টির বেশি শতক নেই। তিন সংস্করণেই সেঞ্চুরি করা বাংলাদেশের প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র ব্যাটসম্যান তামিম। ২০১৬ সালের টি২০ বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করে অনন্য এই কীর্তি গড়েন তিনি। ছোট্ট ফরম্যাটে সেঞ্চুরি নেই দেশের আর কোনো ব্যাডসম্যানের। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে সেঞ্চুরির রেকর্ড তামিমের। ২০০৮ সালে আয়ারল্যন্ডের বিপক্ষে ১২৯ রানের ইনিংস খেলার দিন তার বয়স ছিল ১৯ বছর ২ দিন। ওয়ানডেতে ছক্কা ১০৩টি, পরে তাকে ছাড়িয়ে যান মাহমুদউল্লাহ (১০৭)। 
ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে একাধিক দেড়শ ছোঁয়া ইনিংস খেলা একমাত্র ব্যাটসম্যান তামিম। ২০০৯ সালে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ১৫৪ রানের পর ও ২০২০ সালে ১৫৮ রান করে তিনিই ভাঙেন সেই রেকর্ড। এক ম্যাচ পর ১৭৬ রান করেন লিটন দাস। ওয়ানডে ইতিহাসে একটি নির্দিষ্ট ভেন্যুতে সর্বোচ্চ রানের বিশ্বরেকর্ড তামিমের দখলে (মিরপুরে ২৮৯৭), পরের দুটি নামও অবশ্য বাংলাদেশেরই। মুশফিক ২৬৮৪ ও সাকিব ২৬৫৬। কলম্বোর প্রেমাদাসায় ২৫১৪ রান নিয়ে চারে শ্রীলঙ্কার সনাথ জয়সুরিয়া। টেস্টেও একসময় দেশের হয়ে সর্বোচ্চ ইনিংস ছিল তামিমের। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০৬ রান। পরে ২১৭ রান করে সেটি ছাড়িয়ে যান সাকিব। এখন ২১৯ রানের অপরাজিত ইনিংসে রেকর্ডটি মুশফিকের। বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫১৩৪ রান তামিমের। সেঞ্চুরি ১০ ও হাফ সেঞ্চুরি ৩১টি। ১১ সেঞ্চুরিতে ৬০০৭ রান নিয়ে শীর্ষে মুশফিক। টেস্টে টানা পাঁচ ইনিংসে ফিফটি করা বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাটসম্যান তামিম। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি করার পথে ইমরুল কায়েসের সঙ্গে ৩১২ রানের উদ্বোধনী জুটি গড়েন তামিম। শুধু বাংলাদেশের নয়, সর্বোপরি টেস্টের ইতিহাসেই দলের দ্বিতীয় ইনিংসে এটিই ওপেনিংয়ে সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড। সেঞ্চুর হাঁকিয়ে ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম লেখানো প্রথম বাংলাদেশী ব্যাটসম্যান এবং তৃতীয় ক্রিকেটার তামিম। ২০১০ সালের ২৮ মে ৫ উইকেট নিয়ে প্রথমে স্থান করে নিয়েছিলেন শাহাদাত হোসেন। তার দুদিন পর সেঞ্চুরি পান তামিম। অপর জন মুস্তাফিজ (২০২৯)।
অন্যদিকে একদিন আগেই অ্যাকশন পরীক্ষায় সাকিব দ্বিতীয়বার ফেল করায় নির্বাচকদের জন্য অবশ্য কাজটা সহজই হয়ে  যায়, ‘বোলিং অ্যাকশন নিয়ে যে সমস্যায় আছেন সাকিব, পরীক্ষা দিয়েছিলেন। দুঃখজনকভাবে ফলটা নেতিবাচক হওয়ায় তিনি একজন ব্যাটসম্যান হিসেবেই শুধু খেলতে পারতেন। দল নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় তাই তার অবস্থানটা শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিল আমাদের কাছে। এই দলে আসলে সমন্বয় সাজাতে তাকে আমরা জায়গা দিতে পারিনি।’ বলছিলেন প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ। এদিকে গত বছর অক্টোবরে ভারতের বিপক্ষে কানপুর টেস্টের আগে টেস্ট এবং টি২০ ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে মিরপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন সাকিব। কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতে আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি সাকিব আর দেশে ফিরতে পারেননি। সর্বশেষ নভেম্বর-ডিসেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেও ছিলেন না তিনি। ২০২৩ বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশের হয়ে আর ওয়ানডে খেলেননি। এই অবস্থায় ওয়ানডে ফরম্যাটের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তার থাকা-না থাকা ছিল আলোচনায়। ২০০৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলার পর ওই বছরই আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে খেলেন সাকিব। সেই থেকে কখনোই কোনো বৈশ্বিক আসরে তাকে ছাড়া খেলেনি বাংলাদেশ। ১৯ বছরের সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ল এবার। শেষ হলো সাকিব-তামিম যুগের!

×