নতুন বছরে টাইগারদের চ্যালেঞ্জ
ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভরাডুবি, টি২০ বিশ্বকাপের অনেকটা মিশ্র অভিজ্ঞতা, ঘরের মাঠে একের পর এক সিরিজ হার, পাকিস্তানের মাটিতে ইতিহাস গড়া টেস্ট সিরিজ জয়, প্রথমবারের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাদেরই মাটিতে হারানো, বিজয়ের মাসে যুবাদের অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপ জয়; বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিদায়ী ২০২৪ সাল ছিল সাফল্য-ব্যর্থতায় মোড়ানো। নতুন বছর ২০২৫ সালে টাইগারদের সামনে অনেক ব্যস্ততা, অনেক চ্যালেঞ্জ।
চলতি বিপিএলের পরই ফেব্রুয়ারি-মার্চে পাকিস্তান ও দুবাইয়ে মিশন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি, ছয়টি দিপক্ষীয় সিরিজের মাঝে সেপ্টেম্বরে আছে এশিয়া কাপ, সব মিলিয়ে ২০২৫ সালে ব্যস্ত সুচিই অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের সামনে। আইসিসি এবং এসিসির ইভেন্টগুলো ছাড়া, টাইগাররা এ বছরে মোট সাতটি পূর্ণাঙ্গ দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলবে। তবে ব্যস্ততার বেশিরভাগই সাদা বল আর রঙিন পোশাকে। টেস্ট ম্যাচ মাত্র চারটি। গত ৩০ ডিসেম্বর শুরু হয়েছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের (বিপিএল) ১১তম আসর।
৭ ফ্র্যাঞ্চাজি নিয়ে তিন ভেন্যু ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামে দেশি ও বিদেশি ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণে ঘরোয়া এই প্রতিযোগিতা চলবে আগামি ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। বিপিএল শেষ হওয়ার পর টাইগাররা চ্যাম্পিয়নস ট্রফির প্রস্তুতি শুরু করবে, যা হবে নতুন বছর ২০২৫ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট।
হাব্রিড মডেলে ১৯ ফেব্রুয়ারি শুরু নবম আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আয়োজক পাকিস্তান। শুধু ভারতের ম্যাচগুলো হবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। বাংলাদেশ দল ২০ ফেব্রুয়ারি দুবাইয়ে নিজেদের প্রথম ম্যাচ খেলবে ভারতকে বিপক্ষে। এরপর, ২৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠে নামবে। ২৭ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে।
এই সময়টায় বাংলাদেশ ১০ দিনের মতো নিজেদের গুছিয়ে নিতে পারবে এবং চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে তিনটি ম্যাচ খেলবে। মার্চের শেষে এবং এপ্রিলের শুরুতে বাংলাদেশ জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সিরিজ খেলবে। এই সিরিজে তিনটি ওয়ানডে এবং তিনটি টি২০ ম্যাচ আছে। মে মাসে বাংলাদেশ সফরে রয়েছে তিনটি ওয়ানডে এবং সমান সংখ্যা টি২০ ম্যাচের সিরিজ। জুন-জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পূর্ণাঙ্গ হোম সিরিজ খেলবে, যেখানে সমান তিনটি ওয়ানডে এবং তিনটি টি২০ ম্যাচসহ একটি টেস্ট সিরিজও রয়েছে।
আগস্টে টাইগাররা ভারতের বিপক্ষে ঘরের মাঠে প্রথমে টেস্ট সিরিজ খেলবে। এতে সমান তিনটি ওয়ানডে ও টি২০ ম্যাচও আছে। এরপর সেপ্টেম্বর মাসে ছয় জাতির এশিয়া কাপে অংশ নেবে বাংলাদেশ, যা হবে আরেকটি বড় মঞ্চ। এছাড়া, অক্টোবর মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হোম সিরিজে তিনটি করে ওয়ানডে ও টি২০ ম্যাচে সিরিজ আছে। বছরের শেষে, নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ আয়ারল্যান্ড সফর করবে। এই সফরে টাইগাররা পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলবে, যেখানে তিন ওয়ানডে, তিনটি টি২০ এবং একটি টেস্ট রয়েছে।
এ বছর যত দিপক্ষীয় সিরিজ আর বৈষয়িক টুর্নামেন্ট রয়েছে তার মধ্যে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিই সবচেয়ে বড় আয়োজন। আট দলের আসরে উপমহাদেশের দল চারটি। এর তিনটিই পড়েছে একই গ্রুপে। যেখানে ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গী বাংলাদেশ। তাদের অন্য প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। আইসিসি টুর্নামেন্টে যাদের রেকর্ড বরাবরই ভালো। সব মিলিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে প্রথম ধাপ পার করতে তাই খুব কঠিন পরীক্ষাই দিতে হবে নাজমুল হোসেন শান্ত, লিটন কুমার দাসদের।
দেড় যুগ পর এশিয়া মহাদেশে হবে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আসর। ২০০৬ সালে সবশেষ ভারতে হয়েছিল বৈশ্বিক এই প্রতিযোগিতা। এরপর ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০১৩ ও ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডে দুই আসরের পর আবার এশিয়া মহাদেশে ফিরেছে আট দলের টুর্নামেন্ট। দীর্ঘ টানাপোড়েন শেষে এবার হাইব্রিড মডেলে পাকিস্তান ও দুবাইয়ে হবে ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন ট্রফি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে দুবাইয়ে আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে নিজেদের অভিযান শুরু করবে বাংলাদেশ।
এরপর রাওয়ালপিন্ডিতে তাদের পরের দুই ম্যাচ নিউ জিল্যান্ড ও পাকিস্তানের বিপক্ষে। সবশেষ আসরের গ্রুপ পর্বে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ও পরে বৃষ্টির সহযোগিতা পেয়ে সেরা চারে উঠেছিল বাংলাদেশ। সেমি-ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে থেমে গিয়েছিল সেবারের স্বপ্নযাত্রা। তবে সেটিই এখন পর্যন্ত আইসিসি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য হয়ে আছে।
ওই টুর্নামেন্টের পেরিয়ে গেছে সাত বছরের বেশি সময়। এরপর ওয়ানডে সংস্করণের দুটি আইসিসি টুর্নামেন্টে প্রত্যাশা মেটাতে পারেনি বাংলাদেশ। ২০১৯ বিশ্বকাপে ৯ ম্যাচে জিতেছিল তিনটি। আর গত বছর জয় মাত্র দুটি। উইন্ডিজে সবশেষ টি২০ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো গ্রুপ পর্বের বাধা অবশ্য পেরিয়েছিল বাংলাদেশ। তবে সামগ্রিক পারফরম্যান্সে বিশ ওভারের বৈশ্বিক আসরেও সন্তোষজনক কিছু করতে পারেনি তারা। তাই সামনের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে আইসিসি টুর্নামেন্টে ভালো করতে না পারার ব্যর্থতা ঝেরে ফেলার চ্যালেঞ্জটাও নিতে হবে শান্ত, লিটনদের।
সেই অভিযানে প্রথমেই তাদের সামনে শিরোপাপ্রত্যাশী ভারত। দুবাইয়ের মাঠে দুবার ভারতের মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের দুই ম্যাচেই তারা ছিল পরাজিত দল। এছাড়া চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও একমাত্র দেখায় মনে রাখার মতো কিছু করতে পারেনি বাংলাদেশ। দুই দলের সার্বিক পরিসংখ্যানেও ৪১ ম্যাচে ৩২ জয় নিয়ে পরিষ্কারভাবে এগিয়ে ভারত। তবে সবশেষ পাঁচ ম্যাচের তিনটি জেতায় কিছুটা অনুপ্রেরণা পেতেই পারে বাংলাদেশ।
ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের সবশেষ জয়টিও নিরপেক্ষ ভেন্যুতে, কলম্বোয় গত বছরের এশিয়া কাপে। দুবাইয়ে ভারত ম্যাচ শেষে টুর্নামেন্টের বাকি অংশের জন্য পাকিস্তানে চলে যাবে বাংলাদেশ। রাওয়ালপিন্ডিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হবে তারা। প্রায় ২১ বছর পর এই মাঠে ওয়ানডে খেলবে তারা।
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সবশেষ আসরে কিউইদের বিপক্ষে স্মরণীয় জয় পায় বাংলাদেশ। কার্ডিফে ২৬৬ রানের লক্ষ্যে মাত্র ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। চাপের মুখে পঞ্চম উইকেটে ২২৪ রানের রেকর্ডগড়া জুটি গড়েন মাহমুদউল্লাহ ও সাকিব আল হাসান। দুজনের সেঞ্চুরিতে অনেক দিন মনে রাখার জয়ে সেমি-ফাইনালের টিকেট পেয়েছিল বাংলাদেশ। এর আগে ২০০২ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও নিউজিল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ।
সেবার বাংলাদেশকে মাত্র ৭৭ রানে অলআউট করে ১৬৭ রানে জিতেছিল কিউইরা। দুই দলের সার্বিক পরিসংখ্যানেও এগিয়ে নিউজিল্যান্ড। ৪৫ ম্যাচে তাদের জয় ৩৩টি। তবে উপমহাদেশে খেলা হওয়ায় উইকেট-কন্ডিশনের কিছুটা সহায়তা হয়তো পেতে পারে বাংলাদেশ। যা কাজে লাগিয়ে জয়ের ছক কষা কিছুটা সহজ হওয়া উচিত তাদের। একই মাঠে ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বাগতিকদের বিপক্ষে লড়বে বাংলাদেশ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে এর আগে কখনও মুখোমুখি হয়নি দুই দল।
তবে ওয়ানডে বিশ্বকাপে দুই দলের তিন ম্যাচে পাকিস্তানের জয় ২টি। আর ১৯৯৯ সালে জিতেছিল বাংলাদেশ। সার্বিকভাবেও বেশ এগিয়ে পাকিস্তান। ৩৯ ম্যাচে বাংলাদেশের জয় ৫টি। তবে চলতি বছরের পাকিস্তান সফর থেকে কিছুটা অনুপ্রেরণা নিতে পারে বাংলাদেশ। রাওয়ালপিন্ডিতে অগাস্টে খেলা দুই টেস্টে স্বাগতিকদের হারিয়ে ঐতিহাসিক এক সিরিজ জিতেছিল তারা। এ সবই হতে পারে প্রেরণার।
অবশ্য এশিয়ার মাঠে উপমহাদেশের দুই দলের বিপক্ষে কাজটা মোটেও সহজ হবে না বাংলাদেশের জন্য। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সবশেষ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জয় কিংবা তাদের জন্য বিরুদ্ধে কন্ডিশন কাজে লাগানোর কিছুটা সুযোগ পাবে টাইগাররা। টুর্নামেন্টের ‘বি’ গ্রুপে আছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আফগানিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা। গ্রুপ পর্ব শেষে আগামী ৪ ও ৫ মার্চ হবে দুই সেমি-ফাইনাল। পরে তিন দিন বিরতি দিয়ে ৯ তারিখ হবে শিরোপা নির্ধারণী লড়াই।