ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

অবিস্মরণীয় সাফল্যে বছর শেষ টাইগারদের

মো. মামুন রশীদ

প্রকাশিত: ২২:৪২, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪

অবিস্মরণীয় সাফল্যে বছর শেষ টাইগারদের

জ্যামাইকায় টেস্ট সিরিজের ট্রফি নিয়ে দুই অধিনায়ক বাংলাদেশের মেহেদি হাসান মিরাজ (ডানে) ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট

টানা ৫ টেস্টে বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ। এমনকি বাকি দুই ফরম্যাটেও চরম ভরাডুবি। ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থকরা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে ভাবতে বসেছিলেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা খেলাটাই ভুলতে বসেছেন। তবে বছরের শেষ টেস্টে জ্যামাইকার কিংস্টনে স্যাবিনা পার্ক স্টেডিয়ামে চতুর্থ দিন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১০১ রানে হারিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ দল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ১৫ বছর পর আবার কোনো টেস্ট জেতাটা নানা কারণেই অবিস্মরণীয় সাফল্য। কারণ পঞ্চপা-ব হিসেবে পরিচিত মাশরাফি বিন মর্তুজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও মুশফিকুর রহিমকে ছাড়াই জিতেছে বাংলাদেশ।

নিয়মিত অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তও ছিলেন না, ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসেবে মেহেদি হাসান মিরাজ দ্বিতীয় টেস্টেই জয় ছিনিয়ে এনেছেন। প্রথমবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ ১-১ সমতায় শেষ করেছে বাংলাদেশ। যদিও এবার অ্যান্টিগায় প্রথম টেস্ট ২০১ রানে হেরে শুরু। বছরের শুরু শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে। তবু এ বছর ৩ টেস্ট জিতেছে বাংলাদেশ। কোনো বছরই যা পারেনি। আইসিসির বিশ^ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে এবারের চক্রে ৪ জয়ে ৪৫ পয়েন্ট নিয়ে চারে উঠে এসেছে টাইগাররা সেটিও সেরা প্রাপ্তি। জ্যামাইকার কিংস্টনে জয়ের ভিতটা তৃতীয় দিনশেষেই গড়ে তোলে বাংলাদেশ আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেটে ১৯৩ রান তুলে ততক্ষণে লিড হয়েছে ২১১।

চতুর্থ দিনের শুরুতেই তাইজুল ইসলাম বিদায় নেওয়ার পর অসুস্থ মুমিনুল ব্যাটিংয়ে নামেন এবং শূন্য রানেই ফিরে যান। এরপর জাকের আলী অনিক উপহার দেন অবিশ^াস্য ব্যাটিং। আলজারি জোসেফের এক ওভারে ১৮ রান তোলার পথে ছক্কা হাঁকিয়ে ক্যারিয়ারের তৃতীয় অর্ধশতকে পৌঁছেন তিনি। মুমিনুলের বিদায়ের পর বাকি ৩৪ বলে আরও ৫২ রান করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ১০৬ বলে ৮ চার, ৫ ছয়ে ৯১ রানের দুর্ধর্ষ ইনিংসটি থামে। কিন্তু ২৬৮ রান করে ফেলে বাংলাদেশ এবং লিড পেয়ে যায় ২৮৬ রানের। 
স্যাবিনা পার্কের উইকেট পরিস্থিতি ও কন্ডিশন বিবেচনায় সবাই আগে থেকেই বলছিলেন ২৫০ রানের টার্গেট দিতে পারলেও জয় পাওয়া সম্ভব হবে। প্রথম ইনিংসে রক্ষণাত্মক খেলেও দুই দল সুবিধা করতে পারেনি। বাংলাদেশ ১৬৪ আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৪৬ রানে গুটিয়ে যায়। তাই অধিনায়ক মিরাজ দ্বিতীয় ইনিংসে নামার আগে ব্যাটিং পরিকল্পনা নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি খেলোয়াড়দের একটা কথা বলেছি, এই উইকেটে ইতিবাচক চিন্তা ছাড়া খেললে অনেক কঠিন হবে। যেহেতু আমরা  লিড পেয়েছি ১৮ রানের, এখানে রান করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানি যে এই উইকেটে যদি আমরা ২৫০ রান করতে পারি, আমাদের জন্য ম্যাচটা জেতা সহজ হবে। ১৬৪ রানে অলআউট হওয়ার পরও আমরা নেতিবাচক চিন্তা করিনি।’
এরপর ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২৮৭ রানের লক্ষ্যে নেমে দ্রুতগতিতে শুরু করে। কিন্তু তাইজুল ইসলাম বোলিংয়ে এসে পরিস্থিতি পাল্টে দেন। এ ছাড়া তাসকিন আহমেদ ও হাসান মাহমুদের পেসেও উইন্ডিজ ব্যাটাররা নতি স্বীকার করে। তাই অধিনায়ক ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট ৬৩ বলে ২ চার, ১ ছয়ে ৪৩, ক্যাভেম হজ ৭৫ বলে ৬ চারে ৫৫ রান করলেও শেষ পর্যন্ত ১৮৫ রানেই গুটিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংস। তাইজুল ১৭ ওভারে ৫ মেডেনে ৫০ রান দিয়ে ৫ উইকেট নেন। চতুর্থ ইনিংসে দেশের বাইরে কোনো বাংলাদেশীর সেরা বোলিং এটি। তাই দেশের বাইরে প্রথমবার ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন তিনি। ২টি করে শিকার হাসান ও তাসকিনের। 
এই প্রথম দেশের বাইরে কোনো দলকে দুই ইনিংসেই ২০০ রানের নিচে অলআউট করেছে বাংলাদেশ। গত বছর জুনে আফগানিস্তান মিরপুরে দুই ইনিংসে ১৪৬ ও ১১৫ রানে অলআউট হয়। বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টের দুই ইনিংসে ২০০ রানের নিচে প্রতিপক্ষের গুটিয়ে যাওয়ার ঘটনা এ দুটিই। চতুর্থ দিনের প্রায় ঘণ্টাখানেক খেলা বাকি থাকতেই ১০১ রানে জয় পায় বাংলাদেশ। 
রানের হিসেবে টেস্টে এটাই ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে বড় জয় বাংলাদেশের। ২০০৯ সালে সেন্ট ভিনসেন্টে ৯৫ রানের জয়টাই ছিল বড়। আর সেটাই ছিল ক্যারিবীয় দ্বীপে বাংলাদেশ দলের শেষ জয়। ১৫ বছর পর আরেকটি টেস্ট জিতল এখানে টাইগাররা। এ বছর ১০ টেস্ট খেলে ৩টি জিতেছে বাংলাদেশ। এক বছরে দুটির বেশি টেস্ট জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ৩টি জয়ই এসেছে দেশের বাইরে সেটিও সর্বাধিক। জিম্বাবুয়ে ও পাকিস্তানে ২টি করে জয় আছে এক বছরে। 
২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে দ্বিতীয় সারির দলের  বিপক্ষে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২২ সালের সফরে দুটি করে ৬ টেস্টে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারেনি। অথচ ২০০৪ সালে প্রথমবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে সেন্ট লুসিয়ায় প্রথম টেস্টেই ড্র করে টাইগাররা। এবারও অ্যান্টিগায় সিরিজের প্রথম টেস্টে বিন্দুমাত্র সুবিধা করতে পারেনি। ২০১ রানে হেরেছে। সেই পরাজয়ের পর ঠিক একইভাবে প্রতিপক্ষকে হারিয়েছে বাংলাদেশ। স্বাগতিক দলের সাবেক ক্রিকেটার ও সাবেক কোচ ফিল সিমন্স এখন বাংলাদেশের প্রধান কোচ।

দায়িত্ব নেওয়ার পর চতুর্থ টেস্টেই একটি অবিস্মরণীয় জয় এনে দিয়েছেন তিনি টাইগারদের। তাই উইন্ডিজের সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার ইয়ান বিশপ বলছিলেন, ‘অসাধারণ এক জয়ে টেস্ট সিরিজের সমাপ্তি হলো। যা বাংলাদেশকে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ২০০৯ সালের পর প্রথম জয়ের স্বাদ দিল। সঙ্গে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ ড্র। প্রথম টেস্ট যেভাবে হেরেছিল, দ্বিতীয় টেস্ট ঠিক সেভাবে জিতল, কুর্নিশ তো করতেই হবে তাদের। এভাবে ফিরে আসা, দাপট দেখানো, অধিনায়কত্বে সাহস দেখানো সত্যিই অপূর্ব।’ এই প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ ড্র করল বাংলাদেশ। ১১টি দ্বিপক্ষীয় সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ২০০৯ সালে ও দেশে ২০১৮ সালে ২-০ ব্যবধানে জিতেছে তারা। এবার হয়েছে ড্র, বাকি ৮টি সিরিজ জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সবমিলিয়ে দুই দলের হওয়া ২২ টেস্টে বাংলাদেশের জয় ৫, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৫ এবং ড্র ২। 
এই সিরিজে ২৫টি উইকেট নিয়েছেন বাংলাদেশের পেসাররা। এক সিরিজে যা সর্বাধিক, এর আগে ২ বার ২১টি করে উইকেট নিতে পেরেছিলেন বাংলাদেশী পেসাররা। তাসকিন একাই এই সিরিজে ১১ উইকেট নিয়ে হয়েছেন সিরিজের সেরা খেলোয়াড়। কখনো ম্যান অব দ্য ম্যাচ না হওয়া তাসকিন দেশের দ্বিতীয় পেসার হিসেবে সিরিজসেরা হওয়ার গৌরব দেখিয়েছেন। ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে রবিউল ইসলাম শিপলু প্রথম বাংলাদেশী পেসার হিসেবে টেস্টে সিরিজ সেরা হন। তাই সবমিলিয়ে অবিস্মরণীয় একটি সিরিজ দিয়েই বছর শেষ করেছে টাইগাররা। তাসকিন বলেছেন, ‘আমরা একটু কঠিন সময় পার করছিলাম। 
পাকিস্তানের সঙ্গে সিরিজ জয়ের পর কয়েকটি সিরিজ হারাতে আমরা মানসিকভাবে একটু পিছিয়ে ছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আশা করছি, আল্লাহ চাইলে এমন অনেক বড় অর্জন হবে সামনে।’ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের আগের দুই চক্রে বাংলাদেশ ছিল ৯ নম্বরে। প্রথম চক্রে ৭ টেস্টে একটি ড্র্র করলেও কোনো জয় পায়নি। দ্বিতীয় টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ১২ টেস্টে ১ জয়, ১ ড্র করেছে।

এবার ১২ টেস্টে ৪ জয় নিয়ে বড় সাফল্যই পেয়েছে টাইগাররা। সেটিও অধিনায়ক হিসেবে মিরাজের দারুণ নেতৃত্বে বছরের শেষ টেস্ট জিততেই হয়েছে। প্রথম ইনিংসে ২০০ রানের নিচে অলআউট হয়েও এই প্রথম কোনো টেস্ট জিতেছে বাংলাদেশ। তাই মিরাজ বলেছেন, ‘এটা অবশ্যই আমার জন্য বড় একটা অর্জন। যেহেতু আমি প্রথম অধিনায়কত্ব করেছি, এটা আমার জন্য বড় একটা পাওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে।’

×