স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেষ ব্যাটার শামার জোসেফকে বোল্ড করে বাংলাদেশের অবিস্মরণীয় জয় নিশ্চিত করেন পেসার নাহিদ রানা
বছরের শুরুটা ভালো হয়নি, তবে শেষটা দুর্দান্ত হয়েছে। ঘরের মাটিতে শ্রীলঙ্কার কাছে ৩২৮ রানে হেরে বছর শুরু বাংলাদেশের। আর বছরের শেষ টেস্ট ম্যাচটি জ্যামাইকার কিংস্টনে স্যাবিনা পার্কে টাইগাররা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে জিতেছে ১০১ রানে। ক্যারিবীয় দ্বীপে ১৫ বছর পর কোনো টেস্ট জিতল টাইগাররা। সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টের চতুর্থ দিন জয়ের ভিত গড়ে দেন জাকের আলী অনিক। তিনি ক্যারিয়ারসেরা ৯১ রান করেন ১০৬ বলে ৮ চার, ৫ ছয়ে।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংসে করে ২৬৮ রান। ফলে ২৮৭ রানের টার্গেট পায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পরে তাইজুল ইসলামের ঘূর্ণিতে ১৮৫ রানেই গুটিয়ে যায় উইন্ডিজের দ্বিতীয় ইনিংস। তাইজুল ক্যারিয়ারে ১৫তম বারের মতো ৫ উইকেট নেন। সবমিলিয়ে দলগত নৈপুণ্যেই দীর্ঘ সময় পর ক্যারিবীয় দ্বীপে টেস্ট জিতেছে বাংলাদেশ। ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক হিসেবে দ্বিতীয় টেস্টেই জয়ের মুখ দেখেছেন মেহেদি হাসান মিরাজ। ফলে ২ টেস্টের সিরিজ শেষ হয়েছে ১-১ সমতায়। চলমান আইসিসির বিশ^ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ১২ টেস্টে ৪ জয়, ৮ হারে ৪৫ পয়েন্ট নিয়ে ৮ নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এটাই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা সাফল্য টাইগারদের।
জ্যামাইকা টেস্টের তৃতীয় দিন শেষেই চালকের আসন পেয়ে যায় বাংলাদেশ দল। দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেটে ১৯৩ রান তুলে লিড নেয় ২১১ রানের। চতুর্থ দিন মুমিনুল হক ব্যাটিংয়ে নামতে পারবেন কিনা তা ছিল অনিশ্চিত। দিনের শুরুতেই সাজঘরে ফেরেন তাইজুল (৫০ বলে ১৪)। এরপর মুমিনুল ক্রিজে আসলেও আরেকবার শূন্য হাতেই সাজঘরে ফেরেন। তখন বাংলাদেশের রান ৭ উইকেটে ২১১ এবং জাকের ৭২ বলে ৩৯ রানে ব্যাট করছিলেন। এরপরই তিনি তা-ব শুরু করেন। আলজারি জোসেফের ১ ওভারে ১৮ রান তোলার পথে ছক্কা হাঁকিয়ে ক্যারিয়ারের তৃতীয় হাফ সেঞ্চুরি হাঁকান জাকের। দুর্দান্ত কিছু শটে তিনি টি২০ মেজাজে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সেঞ্চুরির পথে।
কিন্তু ১০৬ বলে ৯১ রান করে আলজারির পেসেই ক্যাচ দিয়ে সাজঘরে ফেরেন। ২৬৮ রানে থামে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস। এদিন ৭৫ রান যোগ করেছে বাংলাদেশ, জাকের একাই করেছেন ৬২। আর মুমিনুল সাজঘরে ফেরার পর তিনি ৩৪ বলে করেন ৫২ রান (বাংলাদেশ করে ৫৭)। তার এমন ব্যাটিং-ই মূলত বাংলাদেশ দল ২৬৮ রান করে। আলজারি ও কেমার রোচ ৩টি করে এবং শামার জোসেফ ২টি উইকেট নেন। ২৮৭ রানের জয়ের লক্ষ্যে নেমে দ্রুতগতিতে শুরু করেন ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট ও মিকাইল লুই।
তাইজুল বোলিংয়ে এসে নিজের দ্বিতীয় বলেই আঘাত হানেন। মিকাইল ১২ বলে ১ চারে ৬ রানে বিদায় নেন। সতর্ক থাকলেও কিসি কার্টি (৪৩ বলে ১৪) তাসকিন আহমেদের পেসে কট বিহাইন্ড হন। ৬৩ বলে ২ চার, ১ ছয়ে ৪৩ রান করা ভয়ংকর ব্র্যাথওয়েটও তাইজুলের শিকার হলে আর কোনো জুটিই বড় হয়নি। ক্যাভেম হজ সাবলীল খেলছিলেন। তিনিও ৭৫ বলে ৬ চারে ৫৫ রান করে তাইজুলের স্পিনে এলবিডব্লিউ হন। চা বিরতির পর নিয়মিত বিরতিতে উইকেট হারিয়েছে ক্যারিবীয়রা। শেষ বিকেলে হাসান মাহমুদের জোড়া শিকার ও নাহিদ রানার গতিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৮৫ রানেই থামে।
তাইজুল ১৭ ওভারে ৫ মেডেনে ৫০ রান দিয়ে ৫ উইকেট নেন। ২টি করে শিকার হাসান ও তাসকিনের। এই প্রথম দেশের বাইরে কোনো দলকে দুই ইনিংসেই ২০০ রানের নিচে অলআউট করেছে বাংলাদেশ। গত বছর জুনে আফগানিস্তান মিরপুরে দুই ইনিংসে ১৪৬ ও ১১৫ রানে অলআউট হয়। বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টের দুই ইনিংসে ২০০ রানের নিচে প্রতিপক্ষের গুটিয়ে যাওয়ার ঘটনা এ দুটিই। ১০১ রানে জয় পায় বাংলাদেশ। ১৫ বছর পর আবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে টেস্ট জিতল বাংলাদেশ দল। ২০০৯ সালে নিয়মিত ক্রিকেটাররা বিদ্রোহ করায় পুরোপুরি দ্বিতীয় সারির একটি দল নিয়ে সফরকারী বাংলাদেশের মুখোমুখি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সেই সিরিজে বাংলাদেশ ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করে স্বাগতিক ক্যারিবীয়দের।
এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২২ সালের সফরে দুটি করে ৬ টেস্টে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে পারেনি বাংলাদেশ। অথচ ২০০৪ সালে প্রথমবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে সেন্ট লুসিয়ায় প্রথম টেস্টেই ড্র করে টাইগাররা। এবারও অ্যান্টিগায় সিরিজের প্রথম টেস্টে বিন্দুমাত্র সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু এবার জিতে এই প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ ড্র করল বাংলাদেশ। ১১টি দ্বিপক্ষীয় সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ২০০৯ সালে ও দেশে ২০১৮ সালে ২-০ ব্যবধানে জিতেছে তারা। এবার হয়েছে ড্র, বাকি ৮টি সিরিজ জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সবমিলিয়ে দুই দলের হওয়া ২২ টেস্টে বাংলাদেশের জয় ৫, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৫ এবং ড্র ২। এক বছরে সর্বাধিক ৩ টেস্ট জিতেছে এবার বাংলাদেশ। এর আগে এক বছরে ২ টেস্টের বেশি জিততে পারেনি তারা। অধিনায়ক হিসেবে মিরাজও দারুণ শুরু করলেন।
বাংলাদেশ প্রথম ইনিংস- ১৬৪/১০; ৭১.৫ ওভার (সাদমান ৬৪, মিরাজ ৩৬, শাহাদাত ২২; সিলস ৪/৫, শামার ৩/৪৯, রোচ ২/৪৫) ও দ্বিতীয় ইনিংস- ২৬৮/১০; ৫৯.৫ ওভার (জাকের ৯১, সাদমান ৪৬, মিরাজ ৪২, শাহাদাত ২৮; রোচ ৩/৩৬, আলজারি ৩/৭৭, শামার ২/৮০)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম ইনিংস- ১৪৬/১০; ৬৫ ওভার (কার্টি ৪০, ব্র্যাথওয়েট ৩৯; নাহিদ ৫/৬১, হাসান ১/১৯) ও দ্বিতীয় ইনিংস- ১৮৫/১০; ৫০ ওভার (হজ ৫৫, ব্র্যাথওয়েট ৪৩, গ্রিভস ২০; তাইজুল ৫/৫০, হাসান ২/২০, তাসকিন ২/৪৫)।
ফল ॥ বাংলাদেশ ১০১ রানে জয়ী। ম্যাচসেরা ॥ তাইজুল ইসলাম (বাংলাদেশ)। সিরিজ ॥ ২ টেস্টের সিরিজে ১-১ সমতা। সিরিজ সেরা ॥ তাসকিন আহমেদ (১১ উইকেট) ও জেডেন সিলস (১০ উইকেট)।