২০১১ সালে জাতীয় পিস্তল শুটার আরমিন আশা, দুই রাইফেল শুটার তৃপ্তি দত্ত এবং সৈয়দা সাদিয়া সুলতানার (ডানে) সঙ্গে প্রতিবেদক
৩২তম জন্মদিনের বাকি ছিল আর মাত্র তিন দিন। কিন্তু তার আগেই কি না অপ্রত্যাশিতভাবে না-ফেরার দেশে চলে গেলেন বাংলাদেশের এক ক্রীড়ারত্ন সৈয়দা সাদিয়া সুলতানা। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে মনকে প্রবোধ দেয়া যেত, কিন্তু যখনই শুনলাম মৃত্যুটা ছিল আত্মঘাতী, তখন সংবাদটা শুনে বজ্রাহত হয়ে গিয়েছিলাম!
আন্তর্জাতিক শূটিংয়ে দেশের হয়ে একাধিক স্বর্ণপদকজয়ী শূটার সাদিয়া আর নেই। ২ ডিসেম্বর দুপুর ২টায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন তিনি।
দীর্ঘদিন ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন সাদিয়া। অনেকবারই নিজেকে শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এজন্য তার পরিবারের সদস্যরা তাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতেন। অনেকে উদ্বেগের মধ্যে থাকতেন। কিন্তু যার জীবনের প্রতি মায়া নেই, তাকে কে ধরে রাখতে পারে! মর্মান্তিকভাবে তাই হয়েছে। অসুস্থ জীবনের অবসান ঘটাতে এবার বাড়ির ব্যালকনি থেকে লাফ দিলেন। গুরুতর আহত হন। সেই অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। নেওয়া হয় আইসিউতে। কিন্তু সেখান থেকেই না-ফেরার দেশে চলে যান অভিমানী সাদিয়া।
এর আগে ২০১৭ সালে আগুনে পুড়ে দীর্ঘদিন অসুস্থও ছিলেন তিনি। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল রান্না করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত আগুন লেগে যায় সাদিয়ার শরীরে। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছিলেন। কিন্তু মানসিকভাবে যে নয়, সেটা তো স্পষ্টই।
গোলাবারুদের খেলা শূটিংয়ে অনন্য এক প্রতিভাময়ী শূটার ছিলেন সাদিয়া। বিশ্বমঞ্চে ছড়িয়েছেন বাংলাদেশের নাম। তবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসের পর থেকে তাকে আর শুটিং খেলতে দেখা যায়নি। প্রায় এক যুগ ধরে অনেকটা অন্তরালে বা স্বেচ্ছা নির্বাচনে ছিলেন সোনাজয়ী এই শূটার।
সাদিয়ার শূটিং ক্যারিয়ার বর্ণাঢ্যময়। ২০১০ সালের কমনওয়েলথ শূটিং চ্যাম্পিয়নশিপে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে সোনা জিতেছিলেন। দলগত ইভেন্টে দিল্লির আসর থেকে শারমিন আক্তার রত্নার সঙ্গে জুটি গড়েও জেতেন সোনা। তার আগে ওই বছরই এসএ গেমসে একই ইভেন্টে জেতেন সোনার পদক। ক্লাস সেভেনের ইংরেজি (ইংলিশ ফর টুডে) পাঠ্যবইয়ে সাদিয়া-রত্না-তৃপ্তির এই সাফল্যের প্রতিবেদনের একাংশ এবং তাদের ছবি ছাপা হয়।
সাদিয়াকে নিয়ে রয়েছে অসংখ্য স্মৃতি। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে দৈনিক জনকণ্ঠে যোগ দেওয়ার পর আমার প্রথম আউটডোর রিপোর্টিং বা এ্যাসাইসমেন্ট শুরু হয় ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমস দিয়ে। আর নির্দিষ্ট কোন ক্রীড়া ডিসিপ্লিন বললে ওই আসরের শূটিং ইভেন্ট দিয়ে। এজন্য শূটিং খেলাটির প্রতি অন্যরকম একটা দুর্বলতা আছে এখনও। গুলশানে অবস্থিত শূটিং ফেডারেশনে রোজই খুব সকালে চলে যেতাম। থাকতাম বিকাল পর্যন্ত। তারপর সব সংবাদ-তথ্য সংগ্রহ করে ইস্কাটনে অফিসে এসে লিখতাম।
গুলশান শূটিং কমপ্লেক্সেই সেবার প্রথম সাদিয়াকে দেখা। এক সপ্তদশী তরুণী। সদ্যই এয়ার রাইফেল নারী টিম ইভেন্টে গোল মেডেল জিতে আনন্দে ভাসছেন। সাফল্যের দুই সঙ্গী তৃপ্তি দত্ত এবং শারমিন আক্তার রত্নাও সঙ্গে আছেন। তিনজনেরই সাক্ষাৎকার নিলাম। এরপরের চার বছরে সাদিয়াকে আরও কয়েকবার ইন্টারভিউ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে।
প্রতিবারই যে বিষয়টা মনে হয়েছে, তা হচ্ছে—সাদিয়া অন্যদের মতো নন, একটু আলাদা। অন্য নারী শূটাররা যেমন সপ্রতিভ, চটপটে, হাসিখুশি, মিশুক ... সাদিয়া তেমনটা নন! তিনি বেশ অন্তঃমুখী, লাজুক, স্বল্পভাষী, গম্ভীর, বিষণ্ন। তার মুখে হাসি দেখাটা যেন ছিল বিরল ব্যাপার। একবার তো ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় ঠাট্টা করে সাদিয়াকে বলেছিলাম, ‘প্রতিদিন যেভাবে রেঞ্জে গিয়ে রাইফেল নিয়ে শূটিং প্র্যাকটিস করেন, তেমনি রোজ আয়নার সামনে গিয়ে হাসির প্র্যাকটিসটা করতে পারেন না? পেপারে আপনার কোনো হাসিমুখের ছবি নেই!’ এমনটা শুনে লজ্জায় আরক্ত হয়ে ‘ফিক’ করে হেসে ফেলেছিলেন সাদিয়া। সঙ্গে সঙ্গেই বলেছিলাম, ‘এই তো, ঠিক এভাবেই হাসবেন। তাহলে পত্রিকায় আপনার হাসিমুখের ছবিটা আমরা দেখতে পাব।’
সাদিয়া এমন একটি পরিবারের সন্তান, যেখানে তিনিসহ তাঁর সব ভাই-বোনই নামকরা ক্রীড়াবিদ। সৈয়দ সরওয়ার আলম ও কাজী সালেহা বেগমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সাদিয়া দ্বিতীয়। প্রথমজন সৈয়দ সালেহ মো. সাজ্জাদউল্লাহ, আন্তর্জাতিক শাটলার। এরপরেই সাদিয়া। তৃতীয়জন সৈয়দা সায়মা সুলতানা, জাতীয় শুটার। চতুর্থজন সৈয়দ শাকের মো. সিবগাতউল্লাহ্, আন্তর্জাতিক শাটলার। পঞ্চমজন সৈয়দ সাদিক মো. সিফাতউল্লাহ গালিব, আন্তর্জাতিক শাটলার।
খুব দ্রুতই সাদিয়ার অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে পরিচয় হলো। সবচেয়ে বেশি হৃদতা হলো সাদিয়ার বাবার সঙ্গে। ভদ্রলোক ধার্মিক, কবি এবং ক্রীড়া অন্তঃপ্রাণ। চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার প্রশাসনিক অফিসার। ফেসবুকে ও ফোনে প্রায়ই তাঁর সঙ্গে আলাপ হতো। কেন জানি আমাকে খুব পছন্দ করতেন।
২০১৫ সালের ২০-৩০ অক্টোবর। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হলো শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। বাফুফে ঢাকা থেকে ক্রীড়া সাংবাদিকদের চট্টগ্রাম নিয়ে গিয়েছিল আসরটি কাভার করাতে। তাদের থাকার ব্যবস্থা বাফুফেই করেছিল। এই প্রতিবেদকও গিয়েছিলেন চট্টগ্রামে। সঙ্গে ছিলেন জনকণ্ঠের তৎকালীন ফটোসাংবাদিক আবদুল হান্নান-ও। সাদিয়ার বাবাকে জানালাম, তাঁর শহরে এসেছি। সরওয়ার সাহেবের সঙ্গে স্টেডিয়ামে তাঁর অফিসে দেখা করলাম। এতেই তিনি সন্তষ্ট হলেন না। গোঁ ধরলেন-তাঁর বাসায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করতেই হবে, নইলে ভীষণ রাগ করবেন। তাই তাঁর বাসায় না গিয়ে পারিনি। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সব উপাদেয় খাবার-দাবারের বিশাল আয়োজন। এলাহী কারবার! সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টন কোচ নিখিল চন্দ্র ধর এবং তাঁর স্ত্রী সুবর্ণা নিখিলও।
সরওয়ার সাহেবের বাসায় নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে ‘রথ দেখা, কলা বেচা’র মতো একটি আইডিয়া মাথায় এলো। যেহেতু সরওয়ার সাহেবের পাঁচ সন্তানই প্রতিষ্ঠিত-সফল ক্রীড়াবিদ, কাজেই তাদের একসঙ্গে ইন্টারভিউ করার সুযোগ হাতছাড়া করা যায় কিভাবে? যেই ভাবা সেই কাজ। সরওয়ার সাহেবকে বিষয়টা জানাতেই সাগ্রহে তা মঞ্জুর করলেন। সৌভাগ্যক্রমে হান্নান ভাইয়ের সঙ্গে তার ডিজিটাল ক্যামেরাটা ছিল। তা দিয়ে সাদিয়া ও তার ভাইবোনকে ক্যামেরাবন্দি করা হলো।
পরে ঢাকায় ফিরে ‘চাঁটগার পঞ্চরত্নের ইতিকথা’ শিরোনামে একটি বড় আকারের ফিচার জমা দিয়েছিলাম, যা ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর গুরুত্বের সঙ্গে ছেপেছিল জনকণ্ঠ।
সাদিয়া যখন ২০১৭ সালে অগ্নিদগ্ধ হন, তখন স্বভাবতই বেশ উদ্বিগ্ন হয়েছিলাম, কষ্টও পেয়েছিলাম। এর প্রায় বছর দেড়েক পর মাঝরাতে হঠাৎই একটি অচেনা মোবাইল নম্বর থেকে কল এলো। ফোন করেছেন সাদিয়া! শূটিং ছেড়ে দেওয়া, নিভৃতচারী হওয়া, গণমাধ্যম-সতীর্থদের এড়িয়ে যাওয়া ... এসব নিয়ে তার মত জানার চেষ্টা করলাম। কিছু প্রশ্নের উত্তর আংশিক দিলেন, কিছু এড়িয়ে গেলেন। কিছু কথা অসংলগ্ন। লক্ষ্য করলাম তাঁর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। এবং কণ্ঠস্বরও তেমন জোরালো নয়। নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে সব কথা বোঝাও যাচ্ছিল না। তারপরও মনে হলো জীবন নিয়ে তিনি হতাশ। তাঁকে আশা না হারিয়ে আবারও শূটিংয়ে ফেরার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। জবাবে শুধু বলেছিলেন, ‘আর ফেরা!’
সাদিয়ার স্বামী ছিলেন সাবেক আর্মি অফিসার। মৃত্যুকালে দুটি শিশু সন্তান রেখে গেছেন তিনি।
এত বছর পর সাদিয়ার অকালপ্রয়াণের পর মনে হচ্ছে অগ্নিদগ্ধ হওয়ার আগে থেকেই হয়তো মানসিক সুস্থতা হারিয়ে ফেলেছিলেন ট্যালেন্ট এই শূটার, আর অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর সেটা আরও প্রকট হয়েছিল। ২ ডিসেম্বর ফেসবুকে এক পুরুষ শূটার (সঙ্গত কারণেই তার নাম উল্লেখ করছি না) জানালেন, ‘শূটিংয়ে থাকা অবস্থায় উনি মেন্টালি ডিজঅর্ডার ছিলেন। তারপর থেকে অনেকবার সুইসাইড করার ট্রাই করলেও এবার উনি মারা গিয়েছেন। উনি একা না, আমাদের অনেক প্লেয়ার আছি যারা ওনার মতো মেন্টালি ডিজঅর্ডার হওয়ার পথে!’ এর কারণ জানতে চাইলে সেই শূটারের রিপ্লাই, ‘ফেডারেশন-ফ্যামিলির প্রেশার ইত্যাদি।’
জানতাম সিজেকেএস ও শুটিং ফেডারেশন নানা সময়ে সাদিয়াকে অবমূল্যায়ন করেছে। এ নিয়ে অনেক দুঃখ ছিল তাঁর।
হায়রে চাপ, দুশ্চিন্তা ... এসবই কি সাদিয়াকে শেষ করে দিয়েছিল? হয়তো কোনদিনই জানা যাবে না এসব। কিন্তু সাদিয়ার মতো এমন অমিত প্রতিভাময়ীর অকালপ্রয়াণে যে বাংলাদেশের শুটিংয়ের প্রভূত ক্ষতি হলো, তাতে কোন সন্দেহ নেই।