সাদিয়া সুলতানা
‘ওগো মৃত্যু/তুমি যদি হতে শূন্যময়/ মুহূর্তে নিখিল তবে হয়ে যেত লয়/তুমি পরিপূর্ণ রূপ, তবে বক্ষে কোলে/জগৎ শিশুর মতো নিত্যকাল দোলে’... যে মানুষ নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না, তখন ভেবে নিতে হবে যে সে ভিতরে ভিতরে মারা যাচ্ছে। সৈয়দা সাদিয়া সুলতানাও কি তবে এমনই একজন ছিলেন? এই অবিনশ্বর ধরণী ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমানোর জন্য কি ৩১ বছর বয়সটা অনেক কম সময় নয়?
২০১০ সালে সাউথ এশিয়ান গেমসে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে দলগত ইভেন্টে স্বর্ণজয়ী শূটার সৈয়দা সাদিয়া সুলতানা আর নেই। সোমবার দুপুর ২টায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহে ... রাজিউন)। সাদিয়ার অকাল মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ শূটিং স্পোর্টস ফেডারেশনসহ আরও অনেক ক্রীড়া সংগঠন।
বিসিবির সাবেক পরিচালক ও চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিরাজউদ্দীন আলমগীরের বরাতে জানা গেছে, সোমবার বাদ এশা রাত ৮টায় সাদিয়ার জানাজা অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের হামজারবাগস্থ মোমিনবাগ অনিবার্ণ ক্লাব প্রাঙ্গণে।
দীর্ঘদিন ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন সাদিয়া। অনেকবারই আত্মহননের চেষ্টা করেছিলেন। এজন্য তার পরিবারের সদস্যরা তাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতেন। কিন্তু যে পৃথিবীর মায়া কাটাতে চায়, তাকে কে বেঁধে রাখতে পারে! সাদিয়াকে কেউ রুখতে পারেননি। অসুস্থ জীবনের অবসান ঘটাতে এবার বাড়ির ছাদ থেকে লাফ দেন। গুরুতর আহত হন। সেই অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। নেওয়া হয় আইসিইউতে। কিন্তু সেখান থেকেই না-ফেরার দেশে চলে যান অভিমানী সাদিয়া।
এর আগে ২০১৭ সালে আগুনে পুড়ে দীর্ঘদিন অসুস্থও ছিলেন তিনি। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল রান্না করতে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত আগুন লেগে যায় সাদিয়ার শরীরে। কিন্তু অন্য একটি সূত্র থেকে জানা গিয়েছিল, ইচ্ছে করেই শরীরে আগুন দিয়েছিলেন সাদিয়া! দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছিলেন।
গোলাবারুদের খেলা শূটিংয়ে অনন্য এক প্রতিভাময়ী শূটার ছিলেন সাদিয়া। বিশ্বমঞ্চে ছড়িয়েছেন বাংলাদেশের নাম। তবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ গেমসের পর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি। প্রায় এক যুগ ধরে অনেকটা অন্তরালে বা স্বেচ্ছা নির্বাচনে ছিলেন সোনাজয়ী এই শূটার। মেয়ের মরদেহ হাসপাতাল থেকে বের করার মুহূর্তে সাদিয়ার বাবা সৈয়দ সরওয়ার আলম গণমাধ্যমকে জানান, ‘আমার সাদিয়া আর নেই। দুপুর ২টার দিকে সবাইকে ছেড়ে চলে গেছে। আমরা এখন ওর মরদেহ হাসপাতাল থেকে বের করছি।’
সাদিয়ার শূটিং ক্যারিয়ার বর্ণাঢ্যময়। ২০১০ সালের কমনওয়েলথ শূটিং চ্যাম্পিয়নশিপে ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে সোনা জিতেছিলেন। দলগত ইভেন্টে দিল্লির আসর থেকে শারমিন আক্তার রতœার সঙ্গে জুটি গড়েও জেতেন সোনা। তার আগে ওই বছরই এসএ গেমসে একই ইভেন্টে জেতেন সোনার পদক। ক্লাস সেভেনের ইংরেজি (ইংলিশ ফর টুডে) পাঠ্যবইয়ে সাদিয়া-রতœা-তৃপ্তির এই সাফল্যের প্রতিবেদনের একাংশ এবং তাদের ছবি ছাপা হয়। সর্বশেষ ২০১৩ সালে ১০ মিটার এয়ার রাইফেল থেকে স্বর্ণপদক পান বাংলাদেশ গেমসে। এরপর থেকেই রহস্যজনক কারণে শূটিং ছেড়ে দেন সাদিয়া। গণমাধ্যম তো বটেই, আর এবার তো ছেড়ে গেলেন দুনিয়াই!
সাদিয়া এমন একটি পরিবারের সন্তান, যেখানে তিনিসহ তাঁর সব ভাই-বোনই নামকরা ক্রীড়াবিদ। সৈয়দ সরওয়ার আলম ও কাজী সালেহা বেগমের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সাদিয়া দ্বিতীয়। প্রথমজন সৈয়দ সালেহ মো. সাজ্জাদউল্লাহ, আন্তর্জাতিক শাটলার। দ্বিতীয়জন সৈয়দা সাদিয়া সুলতানা। তৃতীয়জন সৈয়দা সায়মা সুলতানা, জাতীয় শূটার। চতুর্থজন সৈয়দ শাকের মো. সিবগাতউল্লাহ্, আন্তর্জাতিক শাটলার। পঞ্চমজন সৈয়দ সাদিক মো. সিফাতউল্লাহ গালিব, আন্তর্জাতিক শাটলার।
সাদিয়া একসময় চট্টগ্রাম রাইফেল ক্লাবের ১০ মিটার এয়ার রাইফেল ইভেন্টের বন্দুকধারী ছিলেন। জন্ম ৫ ডিসেম্বর, ১৯৯৩। শূটিংয়ের বদৌলতে তিনি শুধু চট্টগ্রামেরই নয়, পুরো বাংলাদেশেরই গর্ব। তার সাফল্য শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিম-লেও বিস্তৃত। শূটিং অঙ্গনে ‘ভদ্র ও শান্ত মেয়ে’ খ্যাত সাদিয়ার সাফল্যের সূচনা ২০০৮ সালে জাতীয় শূটিং চ্যাম্পিয়নশিপের জুনিয়র বিভাগে তা¤্রপদক জেতেন। সে বছরই জাতীয় শূটিংয়ে জুনিয়র বিভাগে স্বর্ণপদক জেতেন।
এ ছাড়া সিনিয়র পর্যায়ে ২০১০ সালে কমনওয়েলথ শূটিং চ্যাম্পিয়নশিপে এককে রৌপ্যপদক, সেবারই জাতীয় শূটিং চ্যাম্পিয়নশিপে জুনিয়র রৌপ্যপদক, জাতীয় এয়ারগান চ্যাম্পিয়নশিপে তা¤্রপদক, ২০১২ সালে জাতীয় শূটিং চ্যাম্পিয়নশিপে রৌপ্যপদক পান।