জয়সওয়াল
বাউন্সার দিয়েছিলেন জশ হ্যাজেলউড। সপাটে হাঁকালেন যশস্বী জয়সওয়াল। ফাইন লেগের ওপর দিয়ে হওয়ায় ভেসে বল পড়ল বাউন্ডারি মার্কারের ওপর। টিভি রিপ্লে দেখে সিদ্ধান্ত দিলেন থার্ড আম্পায়ার। কমেন্ট্রি বক্সে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট বলে উঠলেন ‘এটা ছক্কা। আর টেস্টে এক তরুণের এটা চতুর্থ সেঞ্চুরি। যে প্রচুর খ্যাতি নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছে। জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই বড় কিছু তৈরি হয়। কী দারুণভাবেই না আভিজাত্যের সঙ্গে নিজেকে মেলে ধরল। কী দুর্ধর্ষ মুহূর্ত।’
পার্থে প্রথম ইনিংসে শূন্য হাতে ফেরা বাঁহাতি ওপেনার দ্বিতীয় ইনিংসেই হিসাব চুকিয়ে দিলেন। সুনীল গাভাস্কার ও প্রয়াত এমএল জয়সিমহার পর তৃতীয় ভারতীয় হিসেবে জীবনের প্রথম অস্ট্রেলিয়া সফরে প্রথম টেস্টেই পেলেন সেঞ্চুরির দেখা। শেষ পর্যন্ত খেললেন ১৬১ রানের মনোমুগ্ধকর ইনিংস। প্রথম ইনিংসের ব্যর্থতা ঝেড়ে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির প্রথম টেস্টে ঘুরে দাঁড়ানো ভারতও পেল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে রেকর্ড গড়া জয়। জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বড় কিছু তৈরি হয়Ñ গিলি যেন এক বাক্যেই সব বলে দিয়েছেন।
উত্তর প্রদেশে জন্ম হলেও মাত্র ১১ বছর বয়সেই ক্রিকেটের টানে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান জয়সওয়াল। মালিদের সঙ্গে রাত্রি যাপন, রাস্তার পাশে ফুচকা বিক্রি করে জীবন ধারণ, যুব দল, আইপিএল হয়ে আজ সে সেনসেশন। জীবন সংগ্রামই বলে দেয় হারিয়ে যেতে আসেননি। ২০২২ আইপিএলের নিলামে রাজস্থান রয়্যালস তাকে ২ কোটি ৪০ লাখ রুপি কিনে নিলে জয়সওয়াল বলেছিলেন, ‘আমি যে সফর করেছি, তা সারা জীবন আমার সঙ্গেই থাকবে। সেই অতীতকে স্মরণ করে আমি সবসময়ই আত্মবিশ্বাস পাব। হ্যাঁ, এখন অর্থ নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু এমনটা নয় যে আমার ভাবনায় কোনো পরিবর্তন এসেছে।
আমি কঠিন সেই দিনগুলোতে যেমনটা ছিলাম, আজও তেমনটাই রয়েছি। আমি একদমই বদলাইনি, আর বদলাবও না। আমি আজ পর্যন্ত যেমনটা ভেবে এসেছি, ভবিষ্যতেও তেমন করেই ভাবব। কারণ আমি জানি যে, লক্ষ্যে পৌঁছাতে কতটা পরিশ্রম আর নিষ্ঠার প্রয়োজন।’ কমেন্ট্রি বক্সে এদিন গিলক্রিস্টের সঙ্গে থাকা আরেক অস্ট্রেলিয়ান বলছিলেন, ‘মাঠে হেলমেট এবং ব্যাট রেখে যুদ্ধ জয়ের মতো দু-হাত তুলল ও। দেখে মনে হচ্ছে যে বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে নয়া যুগের সূচনা হলো।
আর সেটার মুখ্য চরিত্রে জয়সওয়াল।’ ২৯৭ বলে ১৫টি চার ও ৩ ছক্কায় করেছেন ১৬১ রান। তার ইনিংসে হয়েছে বেশ কয়েকটি রেকর্ডও। সংখ্যায় সংখ্যায় সেসব কীর্তি দেখে নেওয়া যাকÑ জয়সওয়াল বিশ্ব ক্রিকেটে মাত্র দ্বিতীয় ব্যাটার যিনি নিজের প্রথম চারটি সেঞ্চুরিকেই দেড় শ’তে পরিণত করেছেন। এর আগে ক্যারিয়ারের প্রথম চার সেঞ্চুরিকেই দেড়শতে রূপ দেওয়ার একমাত্র কীর্তিটি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথের।
২০০১ সালের পর এখন পর্যন্ত তিনজন বিদেশী অস্ট্রেলিয়ায় ছক্কা মেরে সেঞ্চুরিতে পৌঁছেছেন। ২০০৩ সালে অ্যাডিলেডে রাহুল দ্রাবিড়, ২০০৯ সালে ওয়াকায় ক্রিস গেইল। আর এবার পার্থে জয়সওয়াল। বয়স তাঁর ২২ হলেও কথা শুনে মনে হবে অন্তত তিরিশের তরুণ তিনি, ‘বরাবরই ভয়ডরহীন মানসিকতা নিয়ে খেলতে পছন্দ করি আমি। নিজের ওপর ভরসা আছে বলেই কঠিন পরিস্থিতিতেও সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে দুইবার ভাবি না। তারপরও বলব, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দুর্দান্ত বোলিং আক্রমণের বিরুদ্ধে এমন ইনিংস খেলতে পেরে আমি গর্বিত। এই সেঞ্চুরি আমার জন্য একটু বেশিই স্পেশাল।’ বলছিলেন তিনি।
ক্যারিয়ারের ১৫তম টেস্ট শেষে রানসংগ্রহে বিশ্ব ক্রিকেটে চতুর্থ অবস্থান জয়সওয়ালের। তিনি ১৫৬৮ রান করেছেন। তার আগে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি ডন ব্র্যাডম্যান (২১১৫), মার্ক টেলর (১৮১৮) ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের এভারটন উইকস (১৫৭৬)। পাঁচে থাকা আরেক অজি তারকা মাইকেল হাসি সমানসংখ্যক টেস্টে ১৫৬০ রান করেন। এ ছাড়া বয়স ২৩ পূর্ণ হওয়ার আগেই টেস্টে চারটি দেড় শ’ প্লাস রানের ইনিংস খেললেন জয়সওয়াল।
সমানসংখ্যক দেড়শ নিয়ে একই কীর্তি রয়েছে জাভেদ মিয়াঁদাদ, গ্রায়েম স্মিথ এবং শচীন টেন্ডুলকারের। ২৩ বছর বয়সের আগেই সর্বোচ্চ ৮টি টেস্টে দেড়শ’ বা তার বেশি রানের রেকর্ডটিও ডন ব্যাডম্যানের দখলে। একইভাবে ২২ বছর বয়সে ভারতের হয়ে চারটি করে সেঞ্চুরির কীর্তি গাভাস্কার-বিনোদ কাম্বলি ও জয়সওয়ালের। শচীন ৮টি এবং রবি শাস্ত্রীর সেঞ্চুরি রয়েছে ৮টি।
বয়স ২৩ হওয়ার আগে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারেই (২০২৪) তিনটি সেঞ্চুরি করে ফেললেন জয়সওয়াল। ওই বয়সে সমান তিনটি করে টেস্ট সেঞ্চুরি আছে ভারতের রবি শাস্ত্রী (১৯৮৪) ও শচীনের (১৯৯২)। তবে গাভাস্কার (১৯৭১) ও বিনোদ কাম্বলি (১৯৯৩) ওই সময়েই ৪টি টেস্টে তিন অঙ্কের দেখা পেয়েছেন। গত বছর অভিষেক হওয়া এ ওপেনার তার ক্যারিয়ারের ১৫ টেস্টের ১৩টি খেলেছেন এ বছর (২০২৪ সালে)। যেখানে ছক্কা হাঁকিয়েছেন ৩৪টি। টেস্টে এক ক্যালেন্ডার ইয়ারে যা সর্বোচ্চ ছক্কার নতুন রেকর্ড। ২০১৪ সালে ৩৩টি ছক্কা মেরেছিলেন সাবেক নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম।
ভারত-অস্ট্রেলিয়ার পার্থ টেস্টের প্রথম দিন দেখে মনে হয়েছিল এই ম্যাচের আয়ু সম্ভবত দুই দিন। কিন্তু সব হিসাব উল্টে দিয়ে একেবারেই ভিন্ন একটা গল্প লিখছেন ভারতের দুই ওপেনার যশস্বী জয়সওয়াল ও লোকেশ রাহুল। সত্যিই অবিশ্বাস্য! এমনভাবেও ক্যামব্যাক করা যায়। পার্থে যে উইকেটে প্রথম দিনে পড়েছিল ১৭ উইকেট, সেই পিচেই রানের বন্যা বইয়ে ৩৮ বছরের পুরনো রেকর্ড ভাঙলেন তারা। দ্বিতীয় ইনিংসে উদ্বোধনী জুটিতে ২০১ রান করেছেন জয়সওয়াল ও রাহুল। ১৭৬ বলে ৭৭ রানের ঠান্ডা মাথার ইনিংস খেলে রাহুল আউট হলে জুটি ভাঙে।
অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে এটাই প্রথম উইকেটে ভারতের সর্বোচ্চ রানের জুটির রেকর্ড। এর আগে ১৯৮৬ সালে সিডনিতে প্রথম উইকেটে সুনীল গাভাসকর ও ক্রিস শ্রীকান্ত ১৯১ রানের জুটি করেছিলেন। সেই রেকর্ড জুটি টপকে এখন শীর্ষস্থান দখল করেছেন জয়সওয়াল ও রাহুল। একে তো নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবার ঘরের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের কাছে হোয়াইটওয়াশ, তার ওপর নেই অধিনায়ক রোহিত শর্মা। অস্ট্রেলিয়ায় আলোচিত বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফির পাঁচ টেস্টের দ্বৈরথের শুরুতেই ১৫০ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পর কে ভেবেছিল, পার্থে সাড়ে তিন দিনেই রেকর্ড গড়া জয় পাবে সফরকারীরা। এটা সম্ভব হয়েছে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক জাসপ্রিত বুমরাহর দূর্দান্ত বোলিং আর ব্যাটিংয়ে জশস্বী জয়সওয়াল (১৬১), লোকেশ রাহুল (৭৭) ও বিরাট কোহলির (অপরাজিত ১০০) অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনের সৌজন্যে।
৬ উইকেটে ৪৮৭ রানে দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করে ভারত। ৫৩৪ রানের অসম্ভব লক্ষ্য তাড়ায় চতুর্থ দিনে ২৩৮ রানে অলআউট প্যাট কামিন্সের দল। প্রথম ইনিংসে তারা গুটিয়ে গিয়েছিল মাত্র ১০৪ রানে। ২৯৫ রানের এই জয় (রানের হিসাবে) অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারতের সবচেয়ে বড় জয়। ৫ ও ৩ ও মোট ৮ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা বুমরাহ। অস্ট্রেলিয়ায় এর আগে ভারতের সবচেয়ে বড় জয় ছিল ১৯৭৮ সালে। ৪৬ বছর আগে মেলবোর্নে ২২২ রানে জিতেছিল তারা। এশিয়ার বাইরেও মোড়ল দেশটির এটি দ্বিতীয় সবচেয়ে বেশি রানের জয়; ২০১৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ৩১৮ রানের জয় তাদের রেকর্ড।
আর সর্বোপরি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেও রানের হিসেবে এটি ভারতের দ্বিতীয় বড় জয়; ২০০৮ সালে মোহালিতে ৩২০ রানের জয় এখনো সেরা। পার্থে টেস্ট জয়ী দ্বিতীয় এশিয়ান অধিনায়ক এখন বুমরাহ। ২০০৮ সালে ভারতের গ্রেট লেগ স্পিনার আনিল কুম্বলের নেতৃত্বে এখানে জিতেছিল ভারত। এবারের জয়ে মূল কৃতিত্বটা দিতে হবে ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক জাসপ্রিত বুমরাহকেই। অনেক অদল-বদলে চেহারা বদলে যাওয়া দলকে চমৎকার নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। সঙ্গে প্রথম দিন থেকে তার দুর্দান্ত বোলিং গড়ে দিয়েছে সবচেয়ে বড় ব্যবধান। ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে অবশ্য জয়সওয়ালকে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন বুমরাহ।