ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সংবর্ধনার জোয়ারে সাফজয়ীরা

জনকণ্ঠ ফিচার

প্রকাশিত: ২৩:৫২, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

সংবর্ধনার জোয়ারে সাফজয়ীরা

রাঙামাটিতে সংবর্ধনায় সিক্ত তিন চাকমা ফুটবলার রূপনা, ঋতুপর্ণা (মাঝে) ও মনিকা চাকমা (ডানে)

গত ৩০ অক্টোবর কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে রোমাঞ্চ ও উত্তেজনায় ঠাসা ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ২-১ গোলে হারিয়ে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দ্বিতীয়বার শিরোপা জয়ের উল্লাস করে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল। এরপর সাবিনা-ঋতুপর্ণাদের জন্য আগেরবারের মতো এবারো ছাদখোলা বাসের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। দুই বছর আগে প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে দেশে ফেরার পরও ছাদখোলা বাসে করে বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবনে ফিরেছিল বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বাংলার সোনার মেয়েদের। এবার বরণ করে নিতে আগেরবারের মতো জনতার জোয়ার না থাকলেও ক্রীড়াপ্রেমীদের আগ্রহের কমতি ছিল না। 
উৎসবমুখর পরিবেশে লাল-সবুজের বাংলাদেশকে একবিন্দুতে দাঁড় করিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের ফুটবলাররা। দুই বছর আগে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মেয়েরা পেয়েছিলেন ঐতিহাসিক সংবর্ধনা। যা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উৎসবে পরিণত হয়েছিল। এবার দুই বছর পর একই সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করেছেন সাবিনা-ঋতুপর্ণারা। বেতনাদি ঠিকমতো না পাওয়া, কোচ-খেলোয়াড়দের অন্তর্দ্বন্দ্ব ছাপিয়ে এমন সাফল্যে বিস্মিত অনেকে। দৃঢ় মনোবল আর দেশপ্রেমের কারণে এমন স্বর্ণসাফল্য এসেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য আগেরবারের মতো এবার অগ্নিকন্যাদের বরণ অনুষ্ঠান সেভাবে জমকালো হয়নি। তবে জনসাধারণের উৎসাহের কমতি ছিল না।

তারা ঠিকই মেয়েরা যখন ছাদখোলা বাসে করে বাফুফে ভবনের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন আনন্দ প্রকাশ করেন। বিমানবন্দরেও উৎসুক জনতাকে খণ্ড খণ্ড মিছিল করতে দেখা যায়। বাফুফে ভবনের সামনে জড়ো হয়েছিলেন অনেক ভক্ত-সমর্থক। সাতক্ষীরা, রাঙ্গামাটি, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকাতেও আনন্দ মিছিল হয়েছে। এ জেলাগুলোতে সোনার মেয়েদের রাজকীয় সংবর্ধনায় বরণ করে নেওয়া হয়েছে।  
জনকণ্ঠের রাঙ্গামাটি জেলার নিজস্ব সংবাদদাতার খবরে জানা যায়, তিন পাহাড়ি ফুটবলার রূপনা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা ও মনিকা চাকমাকে সংবর্ধনা দিয়েছে রাঙ্গামাটিবাসী। ২৩ নভেম্বর তিন ফুটবলারকে নিয়ে রাঙ্গামাটির ঘাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে মোটরবাইক এবং ফুলসজ্জিত ট্রাক দিয়ে শোভাযাত্রা শুরু করে। শোভাযাত্রাটি রাঙ্গামাটির ভেদভেদী-আসামবস্তী-তবলছড়ি-দোয়েল চত্বর-বনরূপা এলাকা প্রদক্ষিণ করে রাঙ্গামাটি মারী স্টেডিয়ামে প্রবেশ করে। পরে সেখানে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন, সেনা রিজিয়ন, রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ, পুলিশ, রাঙ্গামাটি পৌরসভা এবং রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিরা তাদের অভিনন্দন ও সংবর্ধনা প্রদান করেন।

পরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সাফজয়ী এই খেলোয়াড়কে প্রশাসন, সংগঠন ও ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ফুল, উত্তরীয়, ক্রেস্ট এবং উপহার দেওয়া হয়। এ সময় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন খেলোয়াড়কে ১ লাখ টাকা করে তিন লাখ টাকা, জেলা পরিষদ থেকে ১ লাখ টাকা করে ৩ লাখ টাকা, সেনা রিজিয়ন থেকে ১ লাখ টাকা করে ৩ লাখ টাকা এবং রাঙ্গামাটি পৌরসভা থেকে ৫০ হাজার করে দেড় লাখ উপহার তুলে দেওয়া হয়।
রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মোশারফ হোসেন খানের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন রাঙ্গামাটি সেনা রিজিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শওকত ওসমান, রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কাজল তালুকদার, পুলিশ সুপার ড. এসএম ফরহাদ হোসেন, রাঙ্গামাটি জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মামুন এবং রাঙ্গামাটি জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির আব্দুল আলীম প্রমুখ। সভায় সাফজয়ী খেলোয়াড় রূপনা, ঋতুপর্ণা ও মনিকা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, সবাইকে অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা এই আয়োজন করার জন্য। আমরা সবসময় চেষ্টা করব দেশের জন্য কিছু করার। দেশের জন্য কিছু বয়ে আনতে পারলে আমাদেরও ভালো লাগে। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া ও আশীর্বাদ করবেন। 
অন্যদিকে ২৪ নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলায় ছয় নারী ফুটবলারকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। জনকণ্ঠের ময়মনসিংহের স্টাফ রিপোর্টার জানিয়েছেন, নারী সাফে শিরোপা জয়ী বাংলাদেশ দলের ছয় ফুটবলারকে নিজ গ্রামে সংবর্ধনা দিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে নারী ফুটবলার তৈরির কারিগর কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিনতী রানী শীল, সাবেক শিক্ষক ও কোচ মফিজ উদ্দিন ও কলসিন্দুর ফুটবল টিমের কোচ জুয়েল মিয়াকেও দেওয়া হয় সংবর্ধনা। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে এই সংবর্ধনার আয়োজন করে বিএনপি।

‘কীর্তিমান কিশোরী ফুটবলার সংবর্ধনা আয়োজক কমিটি’র ব্যানারে হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলা বিএনপির পক্ষ থেকে কলসিন্দুর গ্রামের কীর্তিমান এই কিশোরী ফুটবলারদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সাফজয়ী বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক মারিয়া মান্দাসহ সংবর্ধনা পাওয়া অন্য পাঁচজন হলেন সানজিদা আক্তার, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র ও শিউলী আজিম। এই ফুটবলকন্যারা প্রত্যন্ত গ্রাম কলসিন্দুরের বাসিন্দা এবং কলসিন্দুর সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

অনুষ্ঠানে উপজেলা বিএনপির সভাপতি মফিজ উদ্দিনের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স। তিনি বলেন, সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা অর্জন বাংলাদেশের জন্য গর্বের। এতে কলসিন্দুরের ছয় নারী ফুটবলার সম্পৃক্ত হয়ে পুরো ধোবাউড়াবাসীকে গর্বিত করেছে। তাদের নিয়ে আজ সারা বাংলাদেশের মানুষ গর্বিত।
বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক ফুটবলার ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমিনুল ইসলাম, বাংলাভিশন টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন। এ সময় ময়মনসিংহ দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক জাকির হোসেন বাবলু, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর মাহমুদ আলম, সদস্য সচিব রোকনুজ্জামান সরকার রোকন, উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য মোতাহার হোসেন তালুকদার, মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শামীম আজাদ, বিএনপি নেতা ব্রিগেডিয়ার শামস, উত্তর জেলা যুবদলের সভাপতি শামছুল হক শামছুসহ জেলা ও উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সহ-অধিনায়ক মারিয়া মান্দা বলেন, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বড় হয়েছি। মনে শক্তি আর সাহস নিয়ে খেলাধুলা করছি। মেয়ে হয়ে খেলাধুলা করায় প্রথমে গ্রামের অনেক লোকজন বাঁকা চোখে দেখলেও এখন তারাই আমাদের নিয়ে গর্ব করে। এতে অনেক ভালো লাগে।
তিনি বলেন, ফুটবলকে মন থেকে ভালোবেসে সর্বোচ্চ ভালো খেলার চেষ্টা করছি। ফলে, এর ফলাফলও ভালো হচ্ছে। নিজ এলাকার মানুষের ভালোবাসায় আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। যারা এমন সংর্বধনা আয়োজন করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। এতে আমাদের আত্মবিশ্বাস আরও বাড়বে। এদিকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ‘কনসার্ট ফর কলসিন্দুর’ শিরোনামে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে বিপুলসংখ্যক দর্শক উপস্থিত ছিলেন।

×