গোলাম সারোয়ার টিপু ও হাসানুজ্জামান খান বাবলু
বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের কিংবদন্তি-কীর্তিমান পুরুষ জাকারিয়া পিন্টু সোমবার পাড়ি জামিয়েছেন না ফেরার দেশে। মঙ্গলবার সবার শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় অন্তিম শয়ানে শায়িত হয়েছেন তিনি। তার সঙ্গে খেলেছেন এমন দুই গুণী-তারকা ফুটবলারের সঙ্গে কথা বলেছে দৈনিক জনকণ্ঠ। একজন গোলাম সারোয়ার টিপু, অন্যজন হাসানুজ্জামান খান বাবলু।
টিপু বলেন, ‘পিন্টু ভাই আমার সিনিয়র। উনি আমার ক্যাপ্টেন ছিলেন। একজন লিজেন্ডারি খেলোয়াড়। তিনি খেলোয়াড় হিসেবে কেমন ছিলেন, সেটা তাঁর চেয়ে সিনিয়র বা সমসাময়িক যারা আছেন, তাদের কাছে জানতে চাওয়াই ভালো। তার পার্সোনালিটিই ছিল ভিন্ন। আর মানুষ হিসেবে শুরুর দিকে তাঁকে একটু গম্ভীর মনে হতো। সেটা হয়তো বয়সের কারণে। তবে তিনি অনেক মিশুক ছিলেন। বিশেষ করে প্লেয়ারদের সঙ্গে অফ দ্য ফিল্ড অনেক ফান করতেন। জুনিয়র-সিনিয়র সবার সঙ্গেই। অনেক হাসিখুশি থাকতেন। যেমন ফুর্তিবাজ ছিলেন, তেমনি ছিলেন ভোজনরসিকও বটে। যেমন পরিশ্রম করতেন, তেমনি খেতেনও।’
টিপুর মতেÑ‘স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন’Ñ এই একটি বাক্যেই পিন্টু ভাইকে আইডেন্টিফাই করা যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশ ন্যাশনাল টিমেরও ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। মোহামেডানের আট বছরেরও ক্যাপ্টেন। সব সত্ত্বাকে ছাপিয়ে তার ‘ক্যাপ্টেন’ সত্ত্বাটাই ছিল আসল।
টিপু আরও বলেন, ‘পিন্টু ভাই আর প্রতাপদা (হাজরা শঙ্কর প্রতাপ) ছিলেন সেই বিরল ফুটবলার, যারা পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এই দুই জাতীয় দলেই খেলেছেন। পিন্টু ভাই আর প্রতাপদা ছিলেন যেন মানিকজোড়-হরিহর আত্মা। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে পিন্টু ভাই ছিলেন অধিনায়ক, প্রতাপদা ছিলেন সহআধিনায়ক। তেমনি বাংলাদেশ দলেও পিন্টু ভাই ছিলেন অধিনায়ক, প্রতাপদা এখানেও ছিলেন সহঅধিনায়ক। আজ পিন্টু ভাইয়ের জানাজায় এসে প্রতাপদাকে দেখলাম। তিনি এখনো বেশ সুস্থই আছেন। দেখে ভালো লাগল।’
তবে কিছুটা ক্ষোভ নিয়েই টিপুর ভাষ্য, ‘আমরা তো আসলে গুণীজনদের সম্মান করতে জানি না। অশ্রদ্ধাই করি। পিন্টু ভাইকে ফুটবলাঙ্গনে রাখা উচিত ছিল। ফুটবল ফেডারেশনের যারাই ছিলেন, তাদের উচিত ছিল তাকে কাছাকাছিই রাখা। কোন পরামর্শক বা উপদেষ্টা হিসেবে না, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়কের সম্মান দিয়েই রাখা উচিত ছিল। আজ মারা যাওয়ার পর তাঁকে সম্মান দেয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি তো সেটা দেখে যেতে পারেননি। বেঁচে থাকতেই সেটা তাঁকে দেয়া উচিত ছিল। এগুলো বলে এখন আর কি লাভ!’
হাসানুজ্জামান খান বাবলু বলেন, ‘সবকিছুর ঊর্ধ্বে পিন্টু ভাই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমার খেলোয়াড়ী জীবনের শুরু থেকেই পিন্টু ভাইয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাঁর সঙ্গে ফুটবল খেলেছি। পাকিস্তান আমল থেকেই তাঁকে আমার আদর্শ মানি। তাঁকে অনুপ্রেরণা মেনেই আমার ফুটবলের যাত্রা শুরু। বাঙালি জাতির ইতিহাসে অনেক বড় ও নামি-দামি ফুটবলার এসেছে, জন্ম নিয়েছে, হয়তো আরও জন্ম নেবে; কিন্তু জাকারিয়া পিন্টুর মতো দ্বিতীয় কেউই আসবে না। তাঁর মতো কেউ হতেও পারবে না। তাঁর অবস্থান-অর্জনও কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। তিনি যেমন ঐতিহাসিক স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক, তেমনি পাকিস্তান জাতীয় দলে যে অল্প কজন বাঙালি খেলেছেন, তাদেরও একজন তিনি। স্বাধীনতার পর প্রথম বাংলাদেশ দলের অধিনায়কও তিনি।’
বাবলু আরও বলেন, ‘পিন্টু ভাই আর মোহামেডান ক্লাব যেন সমার্থক। আট বছরই ক্লাবটিতে অধিনায়কত্ব করেছেন, দীর্ঘ ১৪ বছর ক্লাবটিতে খেলেছেন। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে একাধিক কিংবদন্তি হয়তো আছে, কিন্তু পিন্টু ভাইয়ের মতো কেউ নন। এটাই ঐতিহাসিক সত্য। পরবর্র্তী প্রজন্ম যেন তাঁর সম্পর্কে জানতে পারে, সেজন্য আমার চাওয়া পিন্টু ভাইয়ের নামে কোনো ফুটবল স্টেডিয়ামের কর্নারের নামকরণ করা হোক।’
স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে যখন বাবলু ব্রাদার্স ইউনিয়নের হয়ে খেলা শুরু করেন, তখন পিন্টু মোহামেডানের হয়ে শেষবারের মতো লিগ শিরোপা জিতেছিলেন। বাবলু ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন, ‘সে সময় পিন্টু ভাই আমাকে কি পরিমাণ যে আদর করতেন, তা বলে বোঝাতে পারব না। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিÑ পিন্টু ভাইয়ের মতো একজনকে অভিভাবক হিসেবে পেয়েছি। তিনি ছিলেন এমনই এক সাদামনের মানুষ, যিনি রাজনীতি বুঝতেন না। তার হৃদয়জুড়ে ছিল শুধুই ফুটবল। তিনি বাফুফের যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। আমার বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। পাকিস্তানি মিলিটারির হাত থেকে বাবাকে বাঁচাতে তাকে নিয়ে দেশজুড়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি।
তাই একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে যেতে পারিনি। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল দেশ-বিদেশে যেখানেই খেলতে গেছেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। বলতেন, ‘বাবলু, তোকে যেতে হবে। বলতাম, আমি তো এই দলের সদস্য না। তিনি বলতেন, তোকে এই দলের সহযোগী সদস্য করে নেব। আমার প্রতি তাঁর ছিল এতটাই ভালোবাসা। পিন্টু ভাইয়ের যে কজন প্রিয় ফুটবলার ছিল, আমি ছিলাম তাদের একজন। ১৯৯৯ সালে মোহামেডানকে চ্যাম্পিয়ন করালাম কোচ হিসেবে। পিন্টু ভাই সবার আগে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে খেলেছি, তাঁকে সংগঠক হিসেবেও পেয়েছি (এশিয়ান কাপের চূড়ান্তপর্বে বাংলাদেশের হয়ে ১৯৮১ সালে কুয়েতে খেলতে গিয়েছিলেন বাবলু। পিন্টু ছিলেন সেই দলের ম্যানেজার)। এটা আমার অহংকার। তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল।’
সারাজীবন পিন্টু ফুটবল নিয়েই ছিলেন। অন্য কোন কিছুই চিন্তা করেননি। গত ৫৩ বছরে এই দেশে যত সরকার এসেছে, তাদের কেউই পিন্টু ভাইকে তাঁর যোগ্য মর্যাদা-সম্মান দেয়নি।’