অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু
একটা সময় দিনের অধিকাংশ সময় তার কাটত মোহামেডান ক্লাবে। মঙ্গলবারও জাকারিয়া পিন্টু এলেন প্রিয় সাদা কালো ক্লাব প্রাঙ্গণে। কিন্তু নিথর দেহে! ১৯৭১ সালে ফুটবল খেলে মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে অর্থ দেওয়ায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যদের মতো মুক্তিযোদ্ধার সম্মান পেয়েছিলেন এই অধিনায়ক। তাই ঢাকা জেলা প্রশাসন এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক প্রিয় জাকারিয়া পিন্টুকে মোহামেডান ক্লাবে চিরবিদায় জানাতে এসেছিলেন বহু ক্রীড়াবিদ, সংগঠকরা। প্রিয় ক্লাব থেকেই রাজসিক বিদায় ঘটল কিংবদন্তি এই ফুটবলারের। শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় অন্তিম শয়ানে শায়িত হলেন পিন্টু।
ক্লাব প্রাঙ্গণের মাঠে ছোট্ট মঞ্চে রাখা ছিল পিন্টুর মরদেহ। জানাজার আগে ঢাকা জেলা প্রশাসন থেকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানানো হয়। এরপর ক্লাব, বিভিন্ন ফেডারেশন, অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন, সাবেক খেলোয়াড়দের পক্ষ থেকে পিন্টুর কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। মোহামেডানের স্থায়ী সদস্য এবং ক্লাব মসজিদের ইমাম আওলাদ হোসেন কিংবদন্তি পিন্টুর জানাজা পড়ান।
মোহামেডান ক্লাবের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ছিলেন পিন্টু। বর্ষীয়ান এই ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক সম্পর্কে ক্লাবের বর্তমান পরিচালক ও ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মো. আলমগীর বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব নিয়েছি বছর তিনেক। এর আগে ক্লাব সংকটময় পরিস্থিতিতে ছিল। সেই সময় বাদল রায়ের সঙ্গে পিন্টু ভাইও বৃদ্ধ বয়সে ক্লাবের পাশে ছিলেন।’ পিন্টুর জানাজায় এসেছিলেন তার অন্যতম সতীর্থ মেজর (অব.) হাফিজ। মোহামেডান ও পাকিস্তান জাতীয় দলে এক সঙ্গে খেলেছেন তারা। প্রিয় সতীর্থ পিন্টু সম্পর্কে হাফিজ বললেন, ‘তিনি ছিলেন মোহামেডানের চীনের প্রাচীর।
মোহামেডান ক্লাবের অনেক জয় ও ড্রয়ে ছিল তার অবদান। তিনি কত বড় মাপের খেলোয়াড় ছিলেন তা এই সময়ে অনেকের পক্ষে বোঝা খুব দুরূহ হবে। পাকিস্তান জাতীয় দলে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় ছিলেন তিনি। পাকিস্তান দলের চেয়ে মোহামেডানের জার্সিতে খেলা কঠিন ছিল। সেই সময় সে টানা আট বারের অধিনায়ক ছিলেন। ফলে খেলোয়াড় হিসেবে তার উচ্চতা কোন পর্যায়ের তা বলার অপেক্ষা রাখে না।’
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক রকিবুল হাসান মোহামেডানের সাবেক খেলোয়াড়। অগ্রজ পিন্টুকে শ্রদ্ধা জানাতে এসে তিনি বলেন, ‘ষাটের দশক থেকে পিন্টু ভাইকে দেখছি। তার মতো শৃঙ্খল খেলোয়াড় বাংলাদেশে তেমন নেই। বর্তমান সময় তো একেবারেই নেই।’ মোহামেডানের সাবেক খেলোয়াড় সাজেদ আদেল বলেন, ‘পিন্টু ভাই মোহামেডান হকি দল নিয়েও নানা সময় নানা পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি চাইতেন ষাটের দশকে ফুটবলের মতো সকল ডিসিপ্লিনেই মোহামেডান এক নম্বর থাকুক।’ মোহামেডান ক্লাব থেকে পিন্টুর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় প্রেস ক্লাবে।
এই ক্লাবের অন্যতম সদস্য ছিলেন জাকারিয়া পিন্টু। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এই অধিনায়কের সতীর্থ ও সমবয়সী ছিলেন সাংবাদিক কামরুজ্জামান। ঠিকমতো হাঁটতে না পারলেও প্রিয় বন্ধুর জানাযায় অংশ নিতে প্রেস ক্লাবে চলে আসেন বর্ষীয়ান এই ক্রীড়া সাংবাদিক। জানাজা শেষে কামরুজ্জামান বলেন, ‘পিন্টু আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। আমরা একই বছরে (১৯৩৮) সালে জন্মেছিলাম। যদিও সার্টিফিকেটে কম দেওয়া আছে আমাদের। ওর সঙ্গে ৬৭ বছরের সম্পর্ক আমার।
১৯৫৭ সালে একসঙ্গে ফুটবল দলে খেলেছি। বিদেশেও খেলেছিল। সর্বশেষ দুই সপ্তাহ আগেও প্রেস ক্লাবে পিন্টুর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। এক সঙ্গে কতকথা বলেছি। পরে অবশ্য ওর ভাগ্নে নিয়ে গেছে অনেক কষ্টে রিক্সায় করে। পৃথিবীতে জাকারিয়া পিন্টু একটাই জন্মে। সেই পিন্টুও চলে গেল। মুক্তিযুদ্ধ যেমন গৌরবের, তেমনি পিন্টুও আমাদের গৌরবের। সেই গৌরব চলে গেল। আর ফিরে আসবে না!’