ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

উইন্ডিজ পরীক্ষায় পাসের চ্যালেঞ্জ টাইগারদের

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:২২, ২০ নভেম্বর ২০২৪

উইন্ডিজ পরীক্ষায় পাসের চ্যালেঞ্জ টাইগারদের

নতুন কোচ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফিল সিমন্সের অধীনে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের

২৬ বছরে মুখোমুখি ৪৪ ওয়ানডের যে ৪২টিতে ফল এসেছে তার ২১টি জিতেছে বাংলাদেশ, ২১টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আর গত দুই দশকে টেস্ট এবং টি২০তে সিরিজ জয় আছে দেশে-বিদেশ দুই জায়গাতেই। এরপরও এবারের সফরে স্বস্তি নেই। পাকিস্তানের মাটিতে স্মরণীয় সাফল্যের ঘোর কেটে গেছে ভারত সফরে। টেস্ট এবং টি২০ দুই সিরিজেই শান্ত-মিরাজদের বাস্তবতার জমিনে নামিয়েছে মোড়ল দেশটি। এরপর ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে দুই টেস্টেই লজ্জার হার। সর্বশেষ শারজায় আফগানিস্তানের কাছে ২-১এ ওয়ানডে সিরিজ হারের তিক্ত অভিজ্ঞতা সঙ্গী করে ওয়েস্ট ইন্ডিজে পাড়ি জমিয়েছে বাংলাদেশ।

তার ওপর ইনজুরির কারণে ছিটকে গেছেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। টাইগারদের কোচিং করাবেন, অনেক দিনের ইচ্ছা ফিল সিমন্সের। একাধিকবার এসে সাক্ষাৎকারও দিয়ে গেছেন। অবশেষে সেই স্বপ্নটা পূরণ হয়েছে এ উইন্ডিজ কোচের। দায়িত্ব পাওয়ার এক সিরিজ পরই শিষ্যদের নিয়ে নিজ দেশে পাড়ি জমানো সিমন্সের মনে বাড়তি আনন্দ থাকার কথা। কিন্তু এখন তিনি চিন্তিত, বলছেন, ‘সিরিজটা কঠিন হবে।’ অ্যান্টিগায় শুক্রবার শুরু প্রথম টেস্ট। জ্যামাইকায় দ্বিতীয় টেস্ট ৩০ নভেম্বর থেকে। 
টেস্ট শেষে তিন ওয়ানডে ও সমান তিন ম্যাচের টি২০ সিরিজ। ‘আমার মনে হয় সেন্ট কিটসে আমরা একই রকম কন্ডিশনে ওয়ানডে খেলব। সেন্ট ভিনসেন্টে টি-টোয়েন্টি কেমন হবে আমি জানি না, ওখানে অনেকদিন যাইনি। তবে অ্যান্টিগা ও জ্যামাইকায় টেস্ট ম্যাচ ভালো উইকেটে হবে, কঠিন ক্রিকেট হবে।’ বলছিলেন ফিল সিমন্স। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুই টেস্ট দিয়ে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের এবারের চক্র শেষ করবে বাংলাদেশ। তবে গুরুত্বপূর্ণ এই সিরিজে চোটের কারণে থাকতে পারছেন না নিয়মিত অধিনায়ক শান্ত ও অভিজ্ঞ ব্যাটার মুশফিকুর রহিম। তাদের বদলে যারা দলে আসছেন, তাদের জন্য একটা সুযোগ দেখেন সিমন্স, ‘আমার মনে হয় বেশিরভাগ ছেলে মুখিয়ে আছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু ইনজুরির সমস্যা আছে।

অন্য যারা সুযোগ পেয়েছে তারা কী করতে পারে সেটা দেখানোর বিষয়।’ ব্যর্থতায় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দলের জন্য আরও বড় দুঃসংবাদ হয়ে এসেছে শান্ত এবং অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিমের ইনজুরি। ‘গুরুত্বপূর্ণ দুজন ব্যাটার খেলতে পারবে না ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।’ বলছিলেন প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। শান্ত না থাকায় নেতৃত্বেও হাতবদল হচ্ছে। সহ-অধিনায়ক মেহেদি হাসান মিরাজের বাহুতে উঠতে যাচ্ছে আর্মব্যান্ড। প্রথমবার  আভিজাত্যের আঙিনায় অধিনায়কত্ব করতে যাচ্ছেন। টেস্ট দলে পঞ্চপা-বের একমাত্র প্রতিনিধি ছিলেন মুশফিক। তিনি না থাকায় ক্রিকেটারদের গড় বয়স কমে গেছে।

উইকেটরক্ষক এ ব্যাটারের তুলনায় মাহিদুল ইসলাম অঙ্কন, হাসান মুরাদ তরুণ ক্রিকেটার।  চট্টগ্রামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে অভিষেক অঙ্কনের। নাঈম হাসানের জায়গায় সুযোগ পাওয়া অফ স্পিনার হাসান মুরাদ প্রথম শ্রেণির ৩১টি ম্যাচ খেলে ১৩৯টি উইকেট শিকার করেছেন। ১২ বার পেয়েছেন পাঁচ উইকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কন্ডিশনের কথা মাথায় রেখেই দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের সর্বশেষ টেস্টের দলে থাকা হাসান মাহমুদ ও নাহিদ রানার সঙ্গে তাসকিন ও শরীফুলকে ফিরিয়ে চার পেসার নিয়ে দল সাজিয়েছে নির্বাচক কমিটি। প্রোটিয়াদের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে তাসকিনকে বিশ্রাম দেওয়া হয়, শরীফুল খেলেছেন জাতীয় লিগে। এবার তাঁদের ফিরিয়ে আনার ব্যাখ্যায় প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘ওয়ার্কলোড ম্যানেজমেন্টের অংশ হিসেবে ওদের রাখা হয়নি। এখন আবার তারা দলে ফিরেছে।’
চার পেসারের সঙ্গে ডান-বাঁহাতি দুজন স্পিনার ও একজন স্পিন অলরাউন্ডার নিয়ে করা হয়েছে দল। জাতীয় লিগের পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করেই টেস্টে নতুন প্রজন্মের এই সুযোগ। টেস্ট দলে এখন সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার মুমিনুল হক। তাইজুল ইসলাম ১০ বছর খেলে ফেলেছেন। দেখতে দেখতে লিটন কুমার দাসের ৯ বছর হয়ে গেছে। অধিনায়ক মিরাজ খেলছেন ২০১৬ সাল থেকে। এই তিন অভিজ্ঞ ব্যাটারের সঙ্গে বাকিরা নবীন। ওপেনিংয়ে সাদমান ইসলামের সঙ্গী মাহমুদুল হাসান জয়, জাকির হাসান বেশি দিন হয়নি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। সর্বশেষ শান্তর বদলি হিসেবে নেওয়া হয়েছে সাহাদাত হোসেন দিপুকে।

চলতি জাতীয় লিগে নিজের শেষ ইনিংসে ১১৬ রানের ইনিংস খেলেছেন তিনি। লিটন, মুমিনুল, মিরাজ, তাইজুল, তাসকিনদেরই নিতে হবে বাড়তি দায়িত্ব। দীর্ঘদিন পর সিনিয়র সহকারী কোচ হয়ে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়া ঘরোয়া ক্রিকেটের  গুরু মোহাম্মদ সালাউদ্দিন স্বপ্ন দেখতে চান, ‘এবার যে স্কোয়াড আছে, মোটামুটি একটা অনভিজ্ঞ দল। তবে সবচেয়ে যেটা ভালো লাগছে যে, ছেলেরা খুব উজ্জীবিত ভালো খেলার জন্য। সবাই সাদা জার্সিটা পরতে চায়। সবার ওয়ার্ক এথিকস দেখে আমার ভালো লাগল। ১৪ বছর পর আমি আবার এলাম ওয়েস্ট ইন্ডিজে, যেখান থেকে আমি শুরু করেছিলাম কোচিং। তাদের ওয়ার্ক এথিকস দেখে ভালো লাগছে।

এই জায়গায় আমার মনে হয় আগের চেয়ে এগিয়ে আছে।’ টেস্টে সম্প্রতি ভালো সময় যাচ্ছে না বাংলাদেশ দলের। পাকিস্তান সফরে ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের পর ভারতে এবং দেশের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে নাস্তানাবুদ হয়েছে বাংলাদেশ। এখন আবার বেশ কয়েকজনের অনুপস্থিতিতে দলের শক্তিও কমেছে। এ বিষয়ে সালাউদ্দিন বলেছেন, ‘এই ছেলেদের স্বপ্নও বড়। তারা বাধ্যবাধকতাটা ভেঙে আরও উপরে উঠতে চায়। আশা করি তারা খুব ভালো করবে। টেস্ট জাতি হিসেবে ভালো করব।’
অন্যদিকে অভিজ্ঞ জেসন হোল্ডারকে পাচ্ছে না ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২ টেস্টে ১৬ উইকেট, পরিসংখ্যানই বলে দেয়, বাংলাদেশের বিপক্ষে কতটা ভয়ংকর দীর্ঘদেহী এ পেস-অলরাউন্ডার। কাঁধের চোট থেকে সেরে ওঠেননি। অবশ্য চ্যালেঞ্জ খুব একটা কম থাকছে না বাংলাদেশের জন্য। শক্তিশালী পেস আক্রমণ নিয়েই এই সিরিজে নামছে স্বাগতিক ক্যারিবিয়ানরা। অভিজ্ঞ কেমার রোচের সঙ্গে আছেন আলজারি জেসোফ ও জেডেন সিলসের মতো বিপজ্জনক দুই পেসার। সঙ্গে উঠতি দুই পেসার শামার জোসেফ ও অ্যান্ডারসনও আছেন টেস্ট স্কোয়াডে। এই পাঁচ বিশেষজ্ঞ পেসার ছাড়াও দলে ফেরানো হয়েছে পেস বোলিং অলরাউন্ডার জাস্টিন গ্রিভসকে।

সবশেষ গত অগাস্টে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে খেলেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওই সিরিজের দল থেকে হোল্ডার ছাড়াও বাংলাদেশের বিপক্ষে নেই বাঁহাতি স্পিনার গুদাকেশ মোতি। তার জায়গায় ফিরেছেন অফ স্পিনিং-অলরাউন্ডার কেভিন সিনক্লেয়ার। এই বছরই অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডে দুটি টেস্ট খেলেছেন সিনক্লেয়ার। বাংলাদেশের বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের ভাবনায় রেখেই হয়তো ফেরানো হয়েছে ২৪ বছর বয়সী অফ স্পিনিং অলরাউন্ডারকে। স্পিন আক্রমণে আছেন বাঁহাতি স্পিনার জোমেল ওয়ারিক্যানও। বাংলাদেশের বিপক্ষে বেশ সফল তিনিও, চার টেস্ট খেলে নিয়েছেন ১৮ উইকেট।

ক্যারিবীয়দের ব্যাটিং লাইন আপে তেমন পরিবর্তন নেই। সাম্প্রতিক সময়ের নিয়মিতরাই আছেন দলে। ১০ বছরের মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজে বাংলাদেশের চতুর্থ সফর এবার। আগের তিন সফরে ছয় টেস্টে জয় নেই একটিও। এমনকি ড্র-ও নেই। জয়-ড্র তো বহুদূর, কোনো ম্যাচে বাংলাদেশ সেভাবে লড়াই জমাতেই পারেনি। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোচ আন্দ্রে কোলি আশা করছেন, এবার লড়াই জমতে পারে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে।
২০১৪ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশের সবশেষ দুটি ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেই প্রথম টেস্ট ছিল অ্যান্টিগায় এবং দুই বারই ভয়াবহ ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে ম্যাচ হারতে হয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের যে হালচাল, বিশেষ করে ব্যাটিংয়ের যা অবস্থা, তাতে এবারও ভালো কিছু আশা করা কঠিন। ক্যারিবিয়ানদের স্কোয়াড থেকে পরিষ্কার, এবারও সেখানে অপেক্ষায় থাকবে পেস সহায়ক উইকেট। দ্বিতীয় টেস্ট জ্যামাইকায়। এই ম্যাচ দিয়ে তিন বছরের বেশি সময় পর টেস্ট ক্রিকেট ফিরবে স্যাবাইনা পার্কে।

বাংলাদেশ এখানে সবশেষ খেলেছে ২০১৮ সালে। যথারীতি ক্যারিবিয়ান পেসের সামনে নতজানু হয়ে হারতে হয়েছিল সেই ম্যাচও। ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত ১০টি টেস্ট সিরিজ হয়েছে বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে। ৫ বারই ওয়েস্ট ইন্ডিজে মাটিতে হয়েছে, ৪ বার হয়েছে বাংলাদেশে। মাঠ ও মাঠের বাইরে সার্বিক পরিস্থিতি মিলিয়ে এবারের সফরটা মিরাজ-মুমিনুলদের জন্য সত্যিই অগ্নিপরীক্ষা।

×