সাফজয়ী বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল
আহ কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে। আরও একবার হিমালয়ের চূড়ায় উঠেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দ্বিতীয়বার অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাসের পাতায় সোনার হরফে নিজেদের নাম লিখেছেন সাবিনা খাতুন, মনিকা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমারা। গত ৩০ অক্টোবর সপ্তম নারী সাফের ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ২-১ গোলে হারিয়ে অবিস্মরণীয় শিরোপা জয়ের গৌরবে ভেসেছে বাংলাদেশ।
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে বাংলার বাঘিনীদের গর্জনে কেঁপেছে দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবল। এর আগে ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর আগের সাফের ফাইনালেও এই নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। সেবার বাংলার মেয়েরা প্রথম জয়ের স্বাদ পায়। এবার একই প্রতিপক্ষকে হারিয়ে শিরোপা ধরে রাখার দারুণ কীর্তি গড়েছেন বাংলার অদম্য মেয়েরা।
২০২২ সালে প্রথমবার মেয়েদের সাফে শিরোপা জয়ের কীর্তি গড়েন বাংলার অদম্য মেয়েরা। এর ফলে পুরুষ কিংবা মেয়েদের ফুটবলে যে কোনো ফরম্যাটে ২০০৩ সালের পর সাফ শ্রেষ্ঠত্ব পায় বাংলাদেশ। পুরুষ দল সবশেষ ২০০৩ সালে দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ২০২২ সালে বাংলার সোনার মেয়েদের হাত ধরে ১৯ বছর পর দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে শিরোপা জয়ের স্বাদ পায় লাল-সবুজের দেশ। শুধু তাই নয়, ১৯৯৯ সালে নেপালেই প্রথমবার দক্ষিণ এশিয়ার সেরা হয়েছিল বাংলাদেশ পুরুষ ফুটবল দল।
সুদীর্ঘ ২৩ বছর পর সেই নেপালেই দক্ষিণ এশিয়ার সেরার মুকুট পরেন মেয়েরা। সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এবারো সাফের শিরোপা জয় করেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। সেই সঙ্গে দেশের ফুটবলরকে তারা নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়। বিদেশের মাটিতে দেশের পতাকার মানও সমুজ্জ্বল করেছেন বাংলার বাঘিনীরা।
২০২২ সালে সাফল্যের পর ক্রীড়া সংশ্লিষ্টরা বলেন, বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংবর্ধনা ও উৎসবমুখর আয়োজন ছিল মেয়েদের বরণ করে নেওয়া। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফিজয়ী ক্রিকেট দল ও ২০২০ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ বিজয়ী দলকেও দেওয়া হয়েছিল সংবর্ধনা। কিন্তু মেয়েদের সাফ জয়ের সংবর্ধনা ও উৎসব অতীতের যে কোনো কিছুকে ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংবর্ধনা ও সবচেয়ে বেশি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন সাবিনা-সানজিদা-মারিয়া-স্বপ্নারা। এবার আরেকবার সাবিনারা ছাদখোলা বাসে সংবর্ধনা পেয়েছেন বাংলার অদম্য মেয়েরা।
দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে দীর্ঘদিন ধরে দাপট দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নারী দল। ২০২২ সালে মেয়েদের জাতীয় দলও সাফের সেরা হয়। ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এবার টানা দ্বিতীয়বার দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে সেরা হয়েছে বাংলার বাঘিনীরা। বিভিন্ন অনূর্র্ধ্ব পর্যায়ে সাফল্য পাওয়া তো ডালভাতে পরিণত হয়েছে। গত এক দশক ধরে এমন সাফল্য আসছে। যে কারণে এই পর্যায়ে ফুটবলকে সাফের গ-ি পেরিয়ে এশিয়ার লেভেলে নিয়ে যেতে কাজ করা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ধারাবাহিক সাফল্য পেলেও মেয়েদের ফুটবল দাঁড়িয়ে আছে দুর্বল ভিতের ওপর। ঘরোয়া লিগ ঠিকমতো হয় না।
বসুন্ধরা কিংস একসময় বড় বাজেট নিয়ে এসেছিল মেয়েদের ফুটবলে। কিন্তু গত মৌসুমে তারা দল গঠন করেনি। শুধু তাই নয়, বড় দলগুলোর তেমন আগ্রহ নেই নারী ফুটবল নিয়ে! যেভাবে মেয়েরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশকে সাফল্য এনে দিচ্ছেন তাতে প্রতিযোগিতামূলক লিগ আয়োজন করা জরুরি। এতে করে পারফরমেন্সের উন্নতি ঘটবে। বর্তমানে নারী লিগের নামে তামাশা চলছে। আবাহনী, মোহামেডান, শেখ জামাল, শেখ রাসেলের মতো বড় দলগুলোকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে বলে মনে করেন ফুটবল সংশ্লিষ্টরা। লিগ জমজমাট করতে পারলে মেয়েদের পারফরমেন্সের আরও উন্নতি হবে। সেক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার গ-ি পেরিয়ে এশিয়ার পথে পা বাড়ানো সম্ভব হবে।
এবার নেপালে সাফ চলাকালীন সময় মেয়েদের খেলা নজর কেড়েছে ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবের। আসরের সেরা খেলোয়াড় ঋতুপর্ণা চাকমাকে ঘিরে আগ্রহ আছে অনেকের। বাংলাদেশ কোচ পিটার বাটলারের মতে, ডিফেন্ডার আফাঈদা খন্দকারের অমিত সম্ভাবনা আছে আরও বড় পর্যায়ে যাওয়ার। তার খেলার গুণমুদ্ধ ইংলিশ কোচ। সঠিক পরিচর্যা পেলে আফঈদা এশিয়ান লেভেলে ভালো করবেন বলে বিশ্বাস বাংলাদেশ কোচের। দুর্দান্ত সাফল্যের পর মেয়েদের বেতনের বিষয়টি সামনে এসেছে। ঠিকমতো বেতন পান না সাবিনা-মারিয়া-মনিকারা।
যে কারণে আরও ভালো ফলাফল পেতে মেয়েদের আর্থিক নিশ্চয়তা নিশ্চিত করতে হবে বলে সবার মতামত। আর্থিকভাবে লাভবান হলে মেয়েদের পারফরমেন্সে আরও উন্নতি হবে। ২০২২ সালে মেয়েদের জাতীয় দল সাফে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয়। কিন্তু অবাক করা বিষয়, দেশের ইতিহাসের সেরা সাফল্যের পর তখন মেয়েদের দীর্ঘ নয় মাস বসে থাকতে হয়। এখনো খুব বেশি খেলতে পারছেন না সানজিদা-সাবিনারা। এবার তিনমাস মাঠের বাইরে থেকে মুকুট ধরে রাখার মিশনে নেপাল যায় বাংলার বাঘিনীরা। এরপরও দুর্দান্ত নৈপুণ্যে শিরোপা ধরে রেখে ঘরে ফিরেছেন বাংলার অদম্য সোনার মেয়েরা।
অনেক চ্যালেঞ্জ জিতে, অনেক বাধা পেরিয়ে, মনস্তাত্বিক লড়াই উতরে সাফের শিরোপা ধরে রাখা বাংলাদেশ জাগিয়েছে দলকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার আশা। একটু চওড়া হচ্ছে এশিয়ান কাপে খেলার স্বপ্ন। গতবার বাছাইয়ে দল যেভাবে বিধ্বস্ত হয়েছিল, তাতে বোঝা গেছে পথটা মোটেও সহজ নয়। তবে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে টানা দুইবারের জয়ী দলের বড় মঞ্চে নিজেদের সামর্থ্য দেখানোর প্রত্যয় থাকতেই হবে বলে মতো সংশ্লিষ্টদের। ঠিক এই ব্যাপারটি নিয়েই বলেছেন কোচ পিটার বাটলার। তার মতে, দলের লক্ষ্য হওয়া উচিত আরও বড়।
এ প্রসঙ্গে বাটলার বলেন, ‘সবাই শুধু সাফ, সাফ করে। কেন স্বপ্নটা আরও বড় করে না? এশিয়ান পর্যায়ে খেলার কথা কেন ভাবে না?’ এশিয়ান কাপের মূলপর্বে এখনো খেলার সুযোগ হয়নি বাংলাদেশের। সবশেষ ২০২২ এর বাছাইয়ে ইরান ও জর্দানের বিপক্ষে দুটি ম্যাচেই হেরেছিল ৫-০ ব্যবধানে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে মহাদেশীয় টুর্নামেন্টে ভারত ছাড়া এখন পর্যন্ত খেলতে পেরেছে কেবল নেপাল (১৯৯৯ সালে শেষবার)। এবারের সাফ দিয়ে একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়েছে। ভারত ও নেপালের চেয়ে এখন কিছুটা এগিয়ে বাংলাদেশ। এই অগ্রগামিতা ধরে রেখে এশিয়ান চ্যালেঞ্জ নেওয়ার এখনই উত্তম সময় বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম ছিল না। অন্তত ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। ওই বছর আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জনের পর রাতারাতি এদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। বিপরীতে ধস নামে ফুটবলে। এজন্য অবশ্য বেশকিছু কারণ আছে। এরপরও দেশের ফুটবল ও ক্রিকেটের সাফল্যের তুলনা করা হয়, তাহলে পরিসংখ্যানের বিচারে দেখা যাবে ক্রিকেটের চেয়ে এগিয়ে আছে এখনো সেই ফুটবলই! এরপরও এই খেলাটি অনেকক্ষেত্রে অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত। জাতীয় দলের নারী ফুটবলাররা নিয়মিত বেতন পান না। দলের হেড কোচেরও বেতন বকেয়া থাকে মাস তিনেকের! অথচ বহু বছরের একটি পুরনো চিত্র হচ্ছেÑ কাড়ি কাড়ি অর্থ পেয়েও ক্রিকেটাররা ব্যর্থ চরমভাবে।
সিনিয়র পর্যায়ে জাতীয় পুরুষ ফুটবল দল সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ যেখানে একবার (২০০৩) জিতেছেন, সেখানে নারী জাতীয় ফুটবল দল সেই ট্রফি জিতেছে দু’বার (২০২২ ও ২০২৪)। পুরুষ ফুটবল দল এসএ গেমস ফুটবলেও স্বর্ণপদক জিতেছে দু’বার (১৯৯৯ ও ২০১০)। এছাড়া একবার প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ (১৯৮৯) এবং একবার জিতেছে চার জাতি আমন্ত্রণমূলক টাইগার ট্রফি (১৯৯৫)। বিপরীতে বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ক্রিকেট দল কোনো বৈশ্বিক ট্রফি দূরে থাক, এশিয়া কাপের মতো কোনো আঞ্চলিক ট্রফিও জিততে পারেনি। তবে এশিয়া গেমস ক্রিকেট একবার (২০১০) ও এসএ গেমসে দু’বার (২০১০ ও ২০১৯) স্বর্ণপদক জিতেছে।
১৯৮৬ সালে ওয়ানডে, ২০০০ সালে টেস্ট ও ২০০৫ সালে টি২০ স্ট্যাটাস পাওয়ার এত বছর পরেও সব ধরনের ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের এমন ব্যর্থতা বেশ দৃষ্টিকটুই বটে। সে তুলনায় বরং জাতীয় নারী ক্রিকেট দলই বেশি সফল। ওমেন্স এশিয়া কাপের শিরোপা জিতেছে তারা (২০১৮ সালে)। এছাড়া এসএ গেমসে জিতেছে স্বর্ণপদক (২০১৯)।
বহু বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে পুরুষ ক্রিকেট দল কোনো ওয়ানডে বা টেস্ট ম্যাচ জিতলে বা সিরিজ জিতলে এ নিয়ে ব্যাপক মাতামাতি করা হয়। ক্রিকেটারদের তখন প্রশংসা-অভিনন্দনে সিক্ত করে ফেলা হয়। তাদের টাকা, বাড়ি, গাড়িসহ বিভিন্ন আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্পন্সর প্রতিষ্ঠান। সে তুলনায় ফুটবলাররা এত সমস্যা-সীমাবদ্ধতা নিয়েও দেশের জন্য স্বর্ণালী সাফল্য কুড়িয়ে আনছেন।
ক্রীড়ামোদিরা মনে করেন এমন অবস্থার পরিবর্তন হওয়া উচিত। আন্তর্জাাতিক গুরুত্বের নিরিখে শুধু ফুটবল নয়, বরং সব খেলার সফল খেলোয়াড়দেরই যোগ্য মূল্যায়ন করতে হবে। গত আগস্টে পটপরিবর্তনের পর ক্রীড়াঙ্গনেও এসেছে পরিবর্তন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ আপ্রাণ চেষ্টা করছে দেশের ঘুণেধরা খেলাধুলাকে সংস্কারের মাধ্যমে চাঙ্গা করার। সবার প্রত্যাশা, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সব খেলা ও খেলোয়াড়দের সঠিক ও যোগ্য মূল্যায়ন করবে।