বৃহস্পতিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাফজয়ী নারী দলের ফুটবলাররা, ডানে ছাদখোলা বাসে মারিয়া-সুমাইয়ারা
‘সফলতা ঐ আসছে- অপেক্ষায় থেকো/মনে তোমার একটুÑ ধৈর্য সহ্য এঁকো!/কাঁটা পথে পা মাড়িয়ে- কত হেঁটে চলা/শত কষ্ট বুকে তবু হয়নি সে বলা।/ক্ষীণ আশার আলোয়-খুঁজে নাও পথ/ভাঙ্গবে না নিরাশায়- করো তো শপথ!/আজ হলো না, কি হলো- আগামীর আশা/চলার পথে দেখবে- সফলতা ঠাসা।’ কোনো প্রস্তুতি ম্যাচ খেলা হয়নি। আগের আসরের ৯ ফুটবলার এবার নেই, দলে প্রায় সমসংখ্যক নতুন মুখ। তার ওপর কোচের সঙ্গে সিনিয়র খেলোয়াড়দের মানসিক দ্বন্দ্ব... যে দলে এত সমস্যা, সে দল সফল হয় কি করে?
কিন্তু না, বিস্ময়করভাবে এর উল্টোটিই ঘটেছে। সদ্যসমাপ্ত সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল। শুধু তাই নয়, শিরোপা অক্ষুণœ রাখার কঠিন চ্যালেঞ্জেও উতরে গেছে তারা। বুধবার কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালায় অনুষ্ঠিত জমজমাট ফাইনালে লাল-সবুজ বাহিনী ২-১ গোলে স্বাগতিক নেপালকে হারায়। সেই সাফল্যকে সঙ্গী করেই বৃহস্পতিবার তারা আকাশপথে উড়াল দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিতে অবতরণ করেছে। তারপর আগের মতোই বিশেষ ছাদখোলা বাসে চড়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) ভবনে গিয়ে পৌঁছে।
সেখানে তাদের জন্য আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। নারী ফুটবলাররা সেখানে পৌঁছালে আসিফ তাদের সঙ্গে কথা বলেন তাদের শুভেচ্ছা-অভিনন্দন জানান এবং সংবর্ধনা দেন। আগেরদিনই অবশ্য ফোনে বাঘিনীদের কথা বলে তাদের অভিনন্দিত করেছিলেন ক্রীড়া উপদেষ্টা।
দুপুর সোয়া ২টায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান থেকে নামার কথা ছিল সাফজয়ী নারী দলের। কিন্তু বিমান আসতে ১৭ মিনিট দেরি হয়। বিমানবন্দরে নারী দলকে বরণ করতে এসেছিলেন বাফুফের নবনির্বাচিত সহসভাপতি ফাহাদ এ করিম, সদস্য মনজুরুল ইসলামসহ অন্য কর্মকর্তারা। বাফুফের নবনির্বাচিত সভাপতি তাবিথ আউয়াল, সদস্য মাহফুজা আক্তার কিরণ এবং সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন তুষার এএফসির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দক্ষিণ কোরিয়ায় আছেন।
সাবিনাদের জন্য আগেই বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিল সুসজ্জিত ছাদখোলা বাস। সেখান থেকে বাফুফে ভবনে আসেন মনিকারা। তাদের রুট ছিল এ রকম-বিমানবন্দর> এক্সপ্রেসওয়ে> এফডিসি>সাত রাস্তার মোড়> মগবাজার ফ্লাইওভার> কাকরাইল> পল্টন> নটরডেম কলেজ> শাপলা চত্বর> বাফুফে ভবন।
বাসযাত্রার আগে বিমানবন্দরেই সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন বাংলাদেশ কোচ পিটার বাটলার আর অধিনায়ক সাবিনা খাতুন।
কোচ পিটার বললেন, ‘এই শিরোপা বাংলাদেশের মানুষেরই। বাংলাদেশ এই টুর্নামেন্টে শিরোপা জিতেছে, তবে শিরোপা জেতাটা বড় কথা নয়, যে ধরনের ফুটবল মেয়েরা খেলেছে, সেটাই আনন্দের জায়গা। আমি খুবই আনন্দিত যে কথা রাখতে পেরেছি। বাফুফে সভাপতি ও নারী উইংয়ের প্রধানকে বলেছিলাম শিরোপা নিয়ে দেশে ফিরব। সেটা করতে পেরেই ভালো লাগছে। তবে তার চেয়েও বেশি ভালো লাগছে যে আমরা যেভাবে শিরোপা জিতেছি সেটি।’
অধিনায়ক সাবিনা বলেন, ‘আমরা এই শিরোপা জিততে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত, আমরা দেশের মানুষের কাছে আশীর্বাদ চাই, যেন এমন সাফল্য আরও উপহার দিতে পারি।’ সাবিনা আরও বলেন, ‘প্রথমেই ধন্যবাদ দিতে চাই দেশের মানুষকে যারা এই জয়ের জন্য অধীর আগ্রহী ছিলেন। সকলকে খুশি করতে পেরে, দলের সকল সদস্য ও বাফুফের সকলে অনেক আনন্দিত। সর্বপ্রথম ধন্যবাদ দিতে চাই সাবেক প্রেসিডেন্ট কাজী সালাউদ্দিন স্যার ও উইমেন্স কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট তাবিথ আওয়াল স্যার ও নতুন কমিটিকে। সকলের দোয়া ও সমর্থনে আজ এই সফলতা এসেছে।’
সাবিনা এরপরই জানান নিজের অনুভূতির কথা, ‘দ্বিতীয়বারের মতো এই আনন্দ প্রথম ট্রফি জয়ের মতোই লাগছে। এত মানুষের সমাগম প্রমাণ করে বাংলাদেশের মানুষ ফুটবলকে কতটুকু ভালোবাসে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। সকল কোচিং স্টাফ, যারা কঠোর পরিশ্রম করেছে তাদেরও ধন্যবাদ জানাই।’
টুর্নামেন্ট সেরা গোলরক্ষক রূপনা চাকমা বলেন, ‘এখানে আসার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। সবাই আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’ জয়সূচক গোলদাতা, টুর্নামেন্ট ও ফাইনালসেরা ঋতুপর্ণা চাকমা বলেন, ‘সকলকে ধন্যবাদ এখানে আসার জন্য। এই ট্রফিটা দেশবাসীকে উপহার দিতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত। আপনারা আমাদের আশীর্বাদ করবেন যাতে ভবিষ্যতে আরও ভালো ট্রফি উপহার দিতে পারি।’
বিকাল ৪টার দিকে ছাদখোলা বাসে উঠলেও ধীরগতির কারণে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি হয় ফুটবলারদের। দীর্ঘক্ষণ বাসে থাকার ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েন মারিয়ারা।
এদিকে সমালোচিত হয়েছে বাফুফে। কারণ মেয়েরা বাফুফে ভবনের আসার আগে ফেডারেশনের চারপাশ ঠিকমতো ও পর্যাপ্তভাবে সাজাতে পারেনি তারা। কোন ব্যানায়, প্ল্যাকার্ড ও পোস্টার ছিল না (পরে দেরি করে এগুলো আনা হয়)। অথচ ২০২২ সালে একই পটভূমিতে ঠিকই ব্যানারে ছেয়ে গিয়েছিল গোটা এলাকা।
সানজিদাদের ছাদখোলা বাসটির চালক মেহেদী হাসান। প্রায় ১০ বছর ধরে বিআরটিসি বাস চালাচ্ছেন তিনি। মেহেদীর সহযোগী হিসেবে ছিলেন মো. নাজমুল (আরেক চালক) ও মো. সুজন (কারিগর)।
বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে হঠাৎ করেই যে সাবিনাদের বহন করা ছাদখোলা বাস উঠে যায় এক্সপেসওয়েতে। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেন সাধারণ মানুষকে দেওয়া হলো না রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে সাবিনাদের অভিনন্দন জানানোর সুযোগ? পরে জানা গেছে এটা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সিদ্ধান্ত। সাবিনাদের বিজয়যাত্রার কারণে যানজট সৃষ্টি হয়ে যেন সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে না পড়ে, এ কারণে বিজয়যাত্রার পথ ঠিক করে দিয়েছে ডিএমপি। ছাদখোলা বাসের স্বপ্নদ্রষ্টা সানজিদা।
২০২২ সালে সাফের ফাইনালের আগে আবদার করেছিলেন, চ্যাম্পিয়ন হতে পারলে যেন ছাদখোলা বাসের ব্যবস্থা করা হয়। তার সেই স্ট্যাটাসের পরই ছাদখোলা বাসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এবারও সাফের শিরোপা জিতেছেন বাংলার বাঘিনীরা। এবার সরাসরি ছাদখোলা বাস না চাইলেও ফাইনালের আগে দুই বছর আগের সেই অভ্যর্থনার স্মৃতিচারণ করেন সানজিদা। সেই ছাদখোলা বাসে উঠেই দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন সানজিদা। নিজের ফেসবুকে সানজিদা লিখেন, ‘ছাদখোলা বাসে। স্বপ্নীল যাত্রা। ধন্যবাদ দেশবাসী।’