ছাদখোলা বাসে টানা দ্বিতীয়বার সাফ চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল
এ এক অন্যরকম আবেগ, অন্যরকম ভালবাসা, অন্যরকম শিহরণ। পুরো বাংলাদেশ নিমিষেই এক বিন্দুতে মিশে গেছে। নারী ফুটবলারদের অবিস্মরণীয় সাফল্যের কারণেই এমন ভালোবাসার বন্ধন রচিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ রাজধানীর অনেক জায়গা ভালোবাসার স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। সোনার মেয়েদের বরণ করতে এসে বিমানবন্দরসহ বাফুফে ভবনে ক্রীড়াপ্রেমীরা স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করেন।
রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান সারাদেশের ক্রীড়াপ্রেমী জনতা। সবার মুখে ঐক্য আর ভালোবাসার সুর প্রতিফলিত হয়েছে। এভাবেই উৎসবমুখর পরিবেশে লাল-সবুজের বাংলাদেশকে একবিন্দুতে দাঁড় করিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী দলের ফুটবলাররা। ৩০ অক্টোবর নেপালে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরেন বাংলার বাঘিনীরা। এর আগে ২০২২ সালে প্রথমবার শিরোপা জয় করেন মেয়েরা। যে কারণে এবার টানা দ্বিতীয়বার শিরোপার স্বাদ পেয়েছেন বাঘিনীরা। দুই বছর আগে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মেয়েরা পেয়েছিলেন ঐতিহাসিক সংবর্ধনা, যা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উৎসবে পরিণত হয়েছিল।
এবার দুই বছর পর একই সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করেছেন সাবিনা-ঋতুপর্ণারা। বেতনাদি ঠিকমতো না পাওয়া, কোচ- খেলোয়াড়দের অন্তঃদ্বন্দ্ব ছাপিয়ে এমন সাফল্যে বিস্মিত অনেকে। দৃঢ় মনোবল আর দেশপ্রেমের কারণে এমন স্বর্ণসাফল্য এসেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য আগেরবারের মতো এবার অগ্নিকন্যাদের বরণ অনুষ্ঠান সেভাবে জমকালো হয়নি। তবে জনসাধারণের উৎসাহের কমতি ছিল না। তারা ঠিকই মেয়েরা যখন ছাদখোলা বাসে করে বাফুফে ভবনের দিকে যাচ্ছিলেন তখন আনন্দ প্রকাশ করেন। বিমানবন্দরেও উৎসুক জনতাকে খন্ড খ- মিছিল করতে দেখা গেছে। বাফুফে ভবনের সামনে জড়ো হয়েছিলেন অনেক ভক্ত-সমর্থক। সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকাতেও আনন্দ মিছিল হয়েছে।
ইতিহাস গড়া সাবিনা-ঋতু-মারিয়াদের বহনকারী বিশেষ বিমান নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে বৃহস্পতিবার দুপুর ২টা ৩২ মিনিটে। কাঠমান্ডু থেকে বিমানের ফ্লাইট বিজি৩৭২ এর মাধ্যমে দেশে পা রাখেন বাংলার বাঘিনীরা। এর পর নারী ফুটবল দলকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে বিমানবন্দরে অভিনন্দন জানানো হয়।
শুধু তাই নয়, বিমান বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সাফ জয়ী নারী ফুটবলার, কোচ ও অন্য কমকর্তাদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। এ সময় বিমানবন্দরে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে গ্রুপ ছবিতে অংশ নেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক জিএসই শাকিল মেরাজ, মহাব্যবস্থাপক এয়ারপোর্র্ট সার্ভিস মো. রাশেদুল করিমসহ বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে বুধবার রাতে রোমাঞ্চ ও উত্তেজনায় ঠাঁসা ফাইনালে স্বাগতিকদের ২-১ গোলে হারায় বাংলাদেশ। শিরোপা জয়ের পরের দিনই লাল-সবুজের দেশে আসেন বাংলাদেশের মেয়েরা। সাবিনা-ঋতুপর্ণাদের জন্য এবারও ছাদখোলা বাসের ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে সেখানে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
দুই বছর আগে প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে দেশে ফেরার পরও ছাদখোলা বাসে করে বিমানবন্দর থেকে বাফুফে ভবনে ফিরেছিল বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন বাংলার সোনার মেয়েদের। এবার বরণ করে নিতে আগেরবারের মতো জনতার জোয়ার না থাকলেও ক্রীড়াপ্রেমীদের আগ্রহের কমতি ছিল না।
বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলার বাংলাদেশের মানুষকে অভিবাদন জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এই টুর্নামেন্টে শিরোপা জিতেছে। তবে শিরোপা জেতাটা বড় কথা নয়। যে ধরনের ফুটবল মেয়েরা খেলেছে, সেটাই আনন্দের জায়গা। আর অবশ্যই এই শিরোপা বাংলাদেশের মানুষের। অধিনায়ক সাবিনা খাতুন এমন সাফল্য আরও উপহার দিতে চান দেশের মানুষকে। তিনি বলেন, আমরা ট্রফি জিততে পেরে খুব খুশি। আমরা দেশের মানুষের কাছে দোয়া চাই।
যেন এমন সাফল্য আরও উপহার দিতে পারি। বিমানবন্দরে সাবিনা, ঋতুদের জন্য একটি ছাদখোলা বাস আগেই প্রস্তুত ছিল। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে সেই বাসে চেপে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে মতিঝিলের বাফুফে ভবনের দিকে যাত্রা শুরু করেন বাংলার বাঘিনীরা।
বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে সাবিনাদের বহন করা ছাদখোলা বাস উঠে যায় এক্সপ্রেসওয়েতে। বাসটি এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার পর অনেকেই প্রশ্ন করেন, বিজয়যাত্রায় সাধারণ মানুষ ও ফুটবলপ্রেমীদের অংশ নেওয়ার সুযোগ কেন দেওয়া হলো না! এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) থেকে অবশ্য জানানো হয়, বিজয়যাত্রার কারণে যানজট সৃষ্টি হয়ে যেন সাধারণ মানুষ ভোগান্তিতে না পড়েন, এ কারণে বিজয়যাত্রার পথ ঠিক করে দেয় ডিএমপি।
যে কারণে বিমানবন্দর, এক্সপ্রেসওয়ে, এফডিসি, সাত রাস্তার মোড়, মগবাজার ফ্লাইওভার, কাকরাইল, পল্টন, নটরডেম কলেজ, শাপলা চত্বর হয়ে বাফুফে ভবনে যায় মেয়েদের বহনকারী ছাদখোলা বাস। বিজয়ী মেয়েদের বরণ করতে বাফুফে ভবনে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। বাংলার বাঘিনীরা বাফুফে ভবনে আসার পর চারিদিকে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে।
২০২২ সালে বাংলাদেশ প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বাফুফে ভবনে ছিল উপচে পড়া সমর্থক। ভবনের মাঠ প্রাঙ্গণ, পার্শ্ববর্তী টার্ফের সব জায়গায় ছিলেন সমর্থকরা। এবার অবশ্য সেই মাত্রা নেই। তবে বাফুফে সাজসজ্জায় কমতি রাখেনি। বাফুফের নবনির্বাচিত সভাপতি তাবিথ আউয়াল বর্তমানে দেশের বাইরে আছেন। ফলে সহসভাপতি সাব্বির আহমেদ আরেফ ক্রীড়া উপদেষ্টাকে বাফুফে ভবনে স্বাগত জানান। মন্ত্রণালয়, এনএসসির সচিবও সেখানে আসেন। ছিলেন বাফুফের নির্বাহী সদস্যরাও।
ঘড়ির কাঁটা তখন সন্ধ্যা প্রায় সাতটা। বাফুফে ভবনে পা থখন পা রাখেন সাফ চ্যাম্পিয়নরা। ততক্ষণে বাফুফে ভবনের সামনে অনেক সমর্থক ও গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড় ছিল। অনেকটা ঠেলাঠেলি করেই ভবনে প্রবেশ করেন সাবিনারা। ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়া বিকেল সোয়া পাঁচটায় আসেন বাফুফে ভবনে। সাবিনারা আসার পর বাফুফের তৃতীয় তলায় কনফারেন্স রুমে যান উপদেষ্টা। সেখানে খেলোয়াড়দের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করন উপদেষ্টা। দেশের মুখ উজ্জ্বল করায় ক্রীড়া উপদেষ্টা প্রাণঢালা অভিনন্দন জানান সাবিনা খাতুনের দলকে।