ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

কে সেরা- সিআর সেভেন, নাকি এলএম টেন?

রুমেল খান

প্রকাশিত: ১৫:৪৫, ১৮ অক্টোবর ২০২৪; আপডেট: ১৫:৫৫, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

কে সেরা- সিআর সেভেন, নাকি এলএম টেন?

গত ১৫ বছর ধরেই চলে আসছে একটি বিতর্ক-মেসি না রোনাল্ডো সেরা

একটি মাঠ। একটি চর্মগোলক। ২২ ফুটবলার। হাজারো দর্শক। আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ। গতি ও স্কিলের অনুপম প্রদর্শনী। কখনও শৈল্পিক ও দৃষ্টিনন্দন ফুটবল। কখনও নেতিবাচক-বিরক্তিকর-ছন্দহীন ফুটবল। মাঝে মধ্যেই কঠিন সব ট্যাকল। এ নিয়ে দু’দলের মাঝে হাতহাতি-উত্তেজনা। পরিস্থিতি বুঝে রেফারির দুই রকম কার্ড দেখিয়ে দোষী ফুটবলারদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়া। প্রতিপক্ষের রক্ষণদুর্গ ভেঙ্গে আক্রমণ শাণিয়ে গোল করার চেষ্টা কখনও সফলতায়, কখনও আবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত। গোল হলে ও গোল মিস হলে প্রতি ক্ষেত্রেই দর্শকদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত। দল জিতলে তাদের উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া আর হারলে বেদনায় ভেঙ্গে পড়া। 
বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ... বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবলে এমনটাই চলে আসছে। ফুটবল খেলা কোন দেশে কখন প্রথম চালু হয়, এ নিয়ে ঐতিহাসিকরা কখনও একমত হতে পারেননি (কেউ বলেন চীন, কেউ গ্রিস, কেউ ইতালি, কেউবা ইংল্যান্ড)। তেমনি ফুটবলবোদ্ধারা কখনও একমত হতে পারেননি, সর্বকালের সেরা ফুটবলার কে। এখানে বেশকিছু নাম উঠে এসেছে কালের পরিক্রমায়। যেমন : আর্জেন্টিনার আলফ্রেড ডি স্টেফানো, হাঙ্গেরির ফেরেঙ্ক পুসকাস, পর্তুগালের ইউসেবিও, নেদারল্যান্ডের ইয়োহান ক্রুইফ, ব্রাজিলের রোমারিও, রোনাল্ডো নাজারিও, ফ্রান্সের মিশেল প্লাতিনি, জিনেদিন জিদান, জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারসহ আরও অনেকেই। তবে এদের ছাপিয়ে দুটো নাম সবচেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একজন ব্রাজিলের পেলে, অন্যজন আর্জেন্টিনার ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তবে এই দুই গ্রেট দুজনেই ভিন্ন যুগের হওয়ায় এবং কেউ কখনও পরস্পরের বিরুদ্ধে না খেলায় এই বিতর্কের সমাধান আজও হয়নি। 
পেলেকে সর্বকালের সেরা ফুটবলার মনে করা হতো মূলত ১৯৭০ বিশ্বকাপের পর থেকে। তবে ১৯৮৬ সালে অতিমানবীয় ও একক নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন করানোর পর থেকেই পেলের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ান ম্যারাডোনা। এই দুই ফুটবল কিংবদন্তী নিজেরাই নিজেদের সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে দাবি করলে এই বিতর্ক আরও ঝলসে ওঠে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকে ২০১০ সাল পর্যন্ত। ফুটবলের প্রায় বেশিরভাগ পরিসংখ্যানেই রোনাল্ডোর চেয়ে এগিয়ে মেসিএরপর ওই সময়কালে আরও দুটো নতুন নাম চলে আসে আলোচনায়। একজন পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো, আরেকজন আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি। দুজনেরই আবির্ভাব প্রায় একই সময়ে। দুজনেই দারুণ প্রতিভাবান, দুজনেই গোলমেশিন, দুজনেই ক্লাব ফুটবলে বিস্ময়করভাবে দুর্দান্তভাবে সফল। বিশ্ব ফুটবলে দুজনের এতটাই প্রভাব ছিল যে ফিফা বির্ষসেরা পুরস্কার এবং ব্যালন ডি’অর ... এই দুটি মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার এক দশকের মধ্যে দুজনেই ভাগাভাগি করে নেন। এমনটা বিরল ঘটনা। তাছাড়া পেলে-ম্যারাডোনার সময়ে তাদের কোন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী (কিছুটা কাছাকাছি মানের ফুটবলার অবশ্যই ছিলেন) ছিল না। কিন্তু ফুটবলপ্রেমীরা অবাক হয়ে দেখলো একই সময়ে সেরা ফুটবলার হিসেবে দুই ফুটবলারের আবির্ভাব ঘটেছে এবং সেটা বেশ দীর্ঘসময় ধরেই চলেছে। এমনটা অতীতে দেখা যায়নি!
সর্বকালের সেরা ফুটবলারের খেতাব পাওয়ার লড়াইয়ে পেলে-ম্যারাডোনার সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবতই যোগ হয় আরও দুটি নাম— মেসি-রোনাল্ডো। তবে একদল আবার এটাকে বাড়াবাড়ি হচ্ছে বলে মেসি-রোনাল্ডোকে সর্বকালের সেরার তালিকা থেকে আপাতত বাদ দিয়ে ‘বর্তমান সময়ের বা এক দশকের সেরা ফুটবলার’ হিসেবে গণ্য করার পরামর্শ দেন। তখন থেকেই মেসি-রোনাল্ডোর দ্বৈরথ শুরু। 
এলএম টেন মেসি যদি হন ফুটবলের সহজাত, ধ্রুপদী শিল্পী; সেক্ষেত্রে সিআর সেভেন রোনাল্ডো যেন ফুটবলের পরিশ্রমী ও রকস্টার। রোনাল্ডো দুই পায়েই সমান দক্ষ, উচ্চতায় বেশ লম্বা হওয়াতে হেডেও পারদর্শী। এক্ষেত্রে মেসি একটু পিছিয়ে। তিনি কেবল বাম পায়েই খেলেন। রোনাল্ডোর চেয়ে সাত ইঞ্চি ছোট হওয়াতে (৫ ফুট ৭ ইঞ্চি) হেড করার লড়াইয়ে বেশিরভাগ সময়েই বলের দখল পান না, এজন্য হেডে তার গোলও কম। তবে তার বাম পা এতটাই অসাধারণ যে, এই দুই ঘাটতি দারুণভাবে পুষিয়ে দেন তিনি (অনেকটা পূর্বসুরী ম্যারাডোনার মতোই)। এমনকি গোল করার স্ট্রাইক রেটেও রোনাল্ডোকে পেছনে ফেলে দিয়েছেন। 
ক্যারিয়ারের শুরুতে দুজনেই উইঙ্গার পজিশনে খেলতেন। পরে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেন। যদিও দুজনের কেউই প্রথাগত স্ট্রাইকার নন। তারপরও এই দুজনের গোলবন্যায় কখনও ঘাটতি হয়নি। একটা সময় টানা চারবার ব্যালন ডি’অর জিতে রোনাল্ডোকে বেশ পেছনে ফেলে দেন মেসি। তবে ক্লাব ফুটবলে সব ধরনের শিরোপা জিতলেও মেসি-রোনাল্ডো দুজনকেই “জাতীয় দলের হয়ে তারা ব্যর্থ” বলে সমালোচনার শিকার হতে হয়। যদিও মেসি যুব বিশ্বকাপ এবং অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতেছেন, কিন্তু এগুলোকে সাফল্য হিসেবে ধর্তব্যেই আনতে চাননি সমালোচকরা। 
তবে ২০১৬ সালে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে পর্তুগালের জার্সিতে প্রথম কোন আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করার পাশপাশি মেসির চেয়ে এগিয়ে যান রোনাল্ডো। নিজেকে তিনি মেসির চেয়ে আরও উঁচুতে নিয়ে যান, যখন ২০১৯ সালে উয়েফা নেশন্স লিগের শিরোপাও জেতেন। আর মেসির দুভার্গ্য— ২০০৭ সালের কোপা আমেরিকা, ২০১৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপ, ২০১৫ ও ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকা ... এই চারটি ফাইনালেই হেরে যান! অথচ ক্লাব ফুটবলে শিরোপা জেতার চেয়ে তিনি রোনাল্ডোর চেয়ে অনেক এগিয়ে। এগিয়ে ফিফা বর্ষসেরা ও ব্যালন ডি’অর পুরস্কার জেতার বেলাতেও। কিন্তু তাতে সমালোচকদের মন গলবে কেন!
ফলে মেসির সামনে বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়ায়-বর্তমান সময়ের বা এক দশকের সেরা ফুটবলার হতে গেলে আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই! এদিকে রোনাল্ডো ভক্তরা দাবি করতে থাকে—ক্লাব ও আন্তর্জাতিক ফুটবল মিলিয়ে, উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এবং আন্তর্জাতিক ফুটবলে গোল করায় ও জাতীয় দলের জার্সিতে আন্তর্জাতিক শিরোপা জেতায় রোনাল্ডো যেখানে শীর্ষে, সেখানে মেসির অবস্থান দ্বিতীয়, কাজেই সময়ের ফুটবলার হিসেবে রোনাল্ডোর আগে নয়, বরং রোনাল্ডোর পরেই মেসির অবস্থান হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে মেসিভক্তদেরও পাল্টা যুক্তি ছিল— রোনাল্ডোর চেয়ে মেসি দুই বছর চার মাসের ছোট। ফলে আন্তর্জাতিক ও ক্লাব ফুটবলেও রোনাল্ডোর চেয়ে মেসি অভিষেকটা হয়েছে দুই বছর দেরিতে। তারপরও মেসি প্রায় সমানতালেই রোনাল্ডোর সঙ্গে এক যুগ ধরে পাল্লা দিয়ে আসছেন। রোনাল্ডো গোল ও হ্যাটট্রিকের যেসব মাইলফলক আগে গড়েছেন, সেগুলো পরে মেসিও স্পর্শ করেছেন। কিন্তু দেখা গেছে সেসব মাইফলফলকগুলো মেসি গড়েছেন রোনাল্ডোর চেয়ে অনেক কম বয়সে ও অনেক কম ম্যাচ খেলে। সেক্ষেত্রে বরং ফিফা বর্ষসেরা, ব্যালন ডি’অর, লিগে সর্বাধিক সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়া, ইউরোপিয়ার গোল্ডেন বুট জেতাসহ আরও অনেক পুরস্কার জেতার ব্যাপারে এখনও রোনাল্ডোর চেয়ে এগিয়ে আছেন মেসি। যদি রোনাল্ডোর অবসরের পরও মেসি খেলা চালিয়ে যান, তাহলে রোনাল্ডোর রেকর্ডগুলো ভাঙ্গতে মেসির বেশি সময় লাগবে না, এতে কোন সন্দেহ নেই।
তবে এত যুক্তির পরেও মেসি বিরোধীরা এগুলো মানতে চাননি। তবে তাদের মুখে চুনকালি লেপে দিতে খুব বেশিদিন সময় নেননি ফুটবলের বিস্ময় মেসি। ২০২১ সালে তিনি জেতেন জাতীয় দলের জার্সিতে পরম আরাধ্য প্রথম কোন শিরোপা (কোপা আমেরিকা)। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, এই শিরোপা জেতার মাধ্যমে আর্জেন্টিনাও দীর্ঘ ২৮ বছরের শিরোপাখরা ঘোঁচায়! ২০২২ সালের জুনে আরেকটি মর্যাদাপূর্ণ শিরোপা জেতেন মেসি। সেটা কনমেবল-উয়েফা কাপ অব চ্যাম্পিয়ন্স (ফিনালিসিমা)। কিন্তু এত সাফল্যের পরও নিন্দুকরা বলতে শুরু করে, মেসি তো এখনও বিশ্বকাপ জেতেননি, তাহলে তিনি কিভাবে সেরা হলেন!
এই অপ্রাপ্তিও ঘুঁচিয়ে দিয়েছেন মেসি, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে কাতারে অনুষ্ঠিত ফিফা বিশ্বকাপের শিরোপা জিতে। আর এখানেই তিনি পেছনে ফেলে দেন সিআর সেভেনকে। এই এক বিশ্বকাপেই মেসি অসংখ্য রেকর্ড গড়ে পেছনে ফেলে দেন রোনাল্ডো, পেলে, ম্যারাডোনা, ম্যাথাউস, মালদিনি, এমবাপ্পে, বাতিস্তুতাসহ আরও অনেককেই। মেসিই একমাত্র ফুটবলার, যিনি দুবার বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি এক আসরে প্রতিটি পর্বের ম্যাচেই গোল করেছেন। পক্ষান্তরে কাতার বিশ্বকাপের আগে থেকেই ফর্ম হারিয়ে ধুঁকছিলেন রোনাল্ডো। ম্যান ইউর কোচের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে দলের একাদশে নিজের জায়গা হারান। পরে ম্যান ইউ তাকে বের করে দেয়। একই দৃশ্যপটের পুনরাবৃত্তি ঘটে কাতার বিশ্বকাপেও, পতুর্গালের কোচ বেন্তোর সঙ্গেও ঝামেলায় জড়িয়ে একাদশে জায়গা হারান। বিশ্বকাপ শেষে ইউরোপের কোন শীর্ষ ক্লাবে তার জায়গা হয়নি। না, বয়স বেশি বলে নয়, রোনাল্ডোর উগ্র আচরণও এক্ষেত্রে দায়ী। শেষমেষ বাধ্য হয়ে সৌদি আরবের একটি ক্লাবে (আল-নাসর) যোগ দেন তিনি। অথচ কয়েক বছর আগে জাভি-ইনিয়েস্তা-তেভেজদের ব্যঙ্গ করে কখনই এশিয়ার ক্লাবে না খেলার দাম্ভিক ঘোষণা দিয়েছিলেন রোনাল্ডো! অথচ মেসিকে দেখুন, এখনও তিনি অসাধারণ ফর্মে। 
মেসি তার পুরো ক্যারিয়ারেই আচরণের দিক থেকে রোনাল্ডোর পুরোপুরি বিপরীত—শান্ত, বিনয়ী, নিরহংকারী। রোনাল্ডোর বিরুদ্ধে যেখানে স্বার্থপরের মতো খেলার অভিযোগ আছে, সেখানে সতীর্থদের সঙ্গে মিলেমিশে খেলার দারুণ সুনাম আছে মেসির। 
বিশ্বকাপ জিতে, মাঠে ও বাইরের সু-আচরণ দিয়ে, সবার মন জয় করে লিওনেল অনেক আগেই পিছনে ফেলে দিয়েছেন ক্রিস্টিয়ানোকে। তিনিই এখন অবিসংবাদিতভাবে এই সময়ের সেরা ফুটবলার।

রুমেল খান/টূম্পা

×