ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩১

ব্যর্থতার বেড়াজালে দেশের ক্রিকেট

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:৪৮, ১৬ অক্টোবর ২০২৪

ব্যর্থতার বেড়াজালে দেশের ক্রিকেট

নারী টি২০ বিশ্বকাপে ব্যর্থতার হতাশায় মুষড়ে পড়েন বাংলাদেশ অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতি

উল্টে গেছে পাশার দান। এখন তো মনে হচ্ছে পাকিস্তানের মাটিতে পাওয়া টেস্টের সাফল্য ‘ফ্লুক’ ছিল! হোক না ভিন্ন ফরম্যাট, তাই বলে ভারতে নাজমুল হোসেন শান্তর দল যে ক্রিকেট খেলল, এটা কোনো খেলার মধ্যে পড়ে? প্রথম টি২০তে মাত্র ১২৭ রান তুলে ৭ উইকেটের হারের পরই অধিনায়ক বলেছিলেন, কিভাবে ১৮০ রান করতে হয় জানা নেই তার! অথচ টি২০ এখন দুই শ’ রানের খেলা। পরের দুই ম্যাচে ৮৬ ও ১৩৩ রানের লজ্জার হারে হোয়াইটওয়াশ ৩-০’ ব্যবধানে।

ওদিকে সেমিফাইনালের লক্ষ্য নিয়ে আমিরাতে পাড়ি জমানো মেয়েরা টি২০ বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে জয় পেলেও পরের তিন ম্যাচে হেরে বিদায় নিয়েছে গ্রুপ-পর্ব থেকে। অধিনায়ক নিগার সুলতানা জ্যোতির স্বীকারোক্তি, ‘দু-একটা ব্যক্তিগত পারফর্ম্যান্স দিয়ে এ পর্যায়ে (বড় টুর্নামেন্ট) এসে ভাল কিছু আশা করা যায় না।’ গোয়ালিয়ার থেকে হায়দরাবাদ, শারজাহ থেকে দুবাই, ছেলেদের থেকে মেয়েদের ক্রিকেট, স্থান বদলেছে বদলায়নি দৃশ্যপট। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাফল্যের যত স্মৃতি তার বেশিরভাগই এসেছে বোলারদের হাত ধরে, বিপরীতে ব্যর্থতার গল্পটা কেবলই হতাশার ব্যাটিংয়ে ঘেরা। আরও একবার উঠে আসল সেই চিত্র। 
টি২০ বিশ্বকাপের বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ভারত দেখিয়ে দিয়েছে টি২০ আসলে কিভাবে খেলতে হয়। রেকর্ডের বন্যা বইয়ে ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছেন সঞ্জু স্যামসন, হার্দিক পান্ডিয়া, সূর্যকুমার যাদব। সিরিজের শীর্ষ তিন রান সংগ্রাহকই ছক্কা হাঁকিয়েছেন সমান ৮টি করে। আগ্রাসি ক্রিকেটে নাস্তানাবুদ করেছেন বাংলাদেশের বোলারদের। বিপরীতে লিটন দাসের ২৫ বলে ৪২ রানের ইনিংস বা তাওহীদ হৃদয়ের ৪২ বলে ৬৩ রানের ইনিংস বাদ দিলে খুব একটা টি২০ সুলভ ব্যাটিং দেখা যায়নি বাংলাদেশের ব্যাটারদের কাছ থেকে।

দ্বিতীয় টি২০র পর মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ থেকে ৩৯ বলে ৪১ রানের ইনিংস নিয়ে এসেছে আলাদা পোস্ট। এমনকি ক্রিকেটারদের কোচ নিক পোথাস ভারত সফর করতে পারাটাকেই বেছে নিয়েছেন সৌভাগ্যের মানদ- হিসেবে! সঙ্গে উল্লেখ করেছেন শেখার কথাও। আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেটে বিশ্বের সবদেশই যাত্রা শুরু করেছিল সমসাময়িক সময়ে। তবু ভারত সফরে বাংলাদেশ জানান দিলো শেখার কথা। আর সফরকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে সৌভাগ্য হিসেবে। মানসিকতার দিক থেকেও বাংলাদেশ ক্রিকেট ঠিক কতটা পিছিয়ে, তা হয়ত আলাদা করে উল্লেখ না করলেও চলে।
সিরিজের শেষ ম্যাচে টর্নেডো সেঞ্চুরির পথে স্যামসনের (৪৭ বলে ১১ চার ও ৮ ছক্কায় ১১১) ব্যাকফুটে খেলা ছক্কাটার কথা একবার চাইলে স্মরণ করতে পারেন। মুস্তাফিজুর রহমানের বলে এক্সট্রাকাভারের ওপর দিয়ে হাঁকানো সেই ছক্কা স্তব্ধ করেছিল সবাইকে। কিংবা দ্বিতীয় টি২০ তে হার্দিক পান্ডিয়ার আলোচিত সেই ‘নো লুক শট’। দুইবারই বাংলাদেশসহ পুরো ক্রিকেট দুনিয়া বিস্মিত চোখে দেখেছে এভাবেও ছক্কা হাঁকানো যায়।

বিপরীতে বাংলাদেশের ছক্কা হাঁকানোর প্রবণতা নেই বললেই চলে। পুরো সিরিজে ১২টি ছক্কা মেরেছেন টাইগার ক্রিকেটাররা। প্রতি ম্যাচে ৪টা হিসেবে। গড় কিংবা সামন্তরিক ধারার গণিত ক্লাসের আদর্শ উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশের ছক্কা নিয়ে এই পরিসংখ্যান! অথচ, এক ম্যাচেই ১৭৩ রানের জুটি গড়তে গিয়ে সূর্যকুমার যাদব আর সাঞ্জু স্যামসন মেরেছিলেন ১৩ ছক্কা! শুধু এই সিরিজে নয়, সর্বোপরি বাংলাদেশের ছক্কার রেকর্ডই বেশ খারাপ। নিয়মিত টেস্ট খেলুড়ে ১০ দেশের মাঝে টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশের চেয়ে কম ছক্কা আছে কেবল জিম্বাবুইয়ের।

শর্টার ফরম্যাটের ক্রিকেটে বাংলাদেশ ১৭৯ ম্যাচে মেরেছে ৭০১টি ছক্কা। প্রায় ৪০ ম্যাচ কম খেলা আফগানিস্তানের ছক্কা ৮৩৩টি। বিগ শট খেলতে না পারার এই অদক্ষতাই মোটা দাগে টি২০তে বাংলাদেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে অনেকখানি। ভারত তাদের আন্তর্জাতিক টি২০ ক্রিকেটে ২৩৮ ম্যাচে গড়ে ৬টির বেশি ছক্কা হাঁকিয়ে ১৪৭০টি ছক্কা আদায় করেছে।
কি বলছেন শান্ত?, ‘আমাদের সামর্থ্য আছে। সামর্থ্য অবশ্যই আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। তবে দক্ষতা উন্নতির অনেক জায়গা আছে। কিন্তু এই উন্নতি কিভাবে হবে? আমি যদি গত ১০ বছর দেখি, আমরা এ রকমই ব্যাটিং করে যাচ্ছি। মাঝেমধ্যে হয়তো ভালো ব্যাটিং করি।’ কিভাবে ব্যাটিংয়ে উন্নতি আনা যায়, সেটা জানাতে গিয়ে অধিনায়ক বলছেন, ‘এটার জন্য আমরা ঘরের মাঠে যখন অনুশীলন করি, তখন উইকেটের পরিবর্তন...কিছু না কিছু একটা পরিবর্তন আনতে হবে।

আমরা যখন ঘরের মাঠে খেলি, তখন ১৪০-১৫০ রানের উইকেটই হয়। ব্যাটসম্যানরা ওই রানটা কিভাবে করতে হয়, সেটা জানে। কিন্তু আমরা জানি না কিভাবে ১৮০ করা যায়। ওই ধরনের উইকেট অনুশীলন করলে হয়তো আমাদের আরেকটু উন্নতি হবে। তবে আমি শুধু উইকেটের দোষ দেব না। এখানে মানসিক অনেক ব্যাপার থাকে।’ এদিকে আমিরাতে নারী টি২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের চার ম্যাচের একটিতেও দলের রান স্পর্শ করেনি ১২০। ফিফটির দেখা পাননি একজন ব্যাটারও।

সোবহানা মোস্তারি ও নিগার সুলতানা ছাড়া ব্যাট হাতে বলার মতো পারফরম্যান্স নেই একজনেরও। প্রথম ম্যাচের জয় ছাড়া কোনো ম্যাচে লড়াই জমেনি তেমন একটা। সব মিলিয়ে অনেক ঘাটতি দলে দেখতে পাচ্ছেন জ্যোতি। সামনে তাকিয়ে সেসব ঘাটতি পূরণের পথ খুঁজছেন অধিনায়ক। দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে ৭ উইকেটের হার দিয়ে শেষ হয়েছে নারী টি২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের অভিযান। আসর শুরুর আগে বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল বিশ্বকাপে ১০ বছরের জয়খরা কাটানো।

সেই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। প্রথম ম্যাচেই স্কটল্যান্ডকে হারায় তারা। ম্যাচ জয়ের পর অধিনায়ক জ্যোতিসহ দলকে দেখা যায় আবেগময় উদযাপন করতে। টুর্নামেন্ট থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি ওখানেই শেষ। প্রথম ম্যাচ জিততে পারলে সেমি-ফাইনালে খেলতে চাওয়ার কথাও বলেছিলেন সবাই। তৃতীয় ম্যাচের আগে পর্যন্ত সেই স্বপ্নের কথা শোনা গেছে দলের কাছ থেকে। কিন্তু একের পর এক ম্যাচে হতশ্রী ব্যাটিংয়ে স্বপ্নপূরণের সামান্যতম সম্ভাবনাও জাগাতে পারেনি মেয়েরা। 
বরাবরই বাংলাদেশের যেটি মূল সমস্যা, সেই ব্যাটিংয়ের দুর্বলতা আরও প্রকট হয়ে ফুটে উঠেছে এই আসরে। প্রথম ম্যাচে স্কটিশদের বিপক্ষে ১১৯ রান করেও বোলারদের দারুণ পারফরম্যান্সে জয় ধরা দিয়েছে। পরের ম্যাচগুলোর অবস্থা যাচ্ছেতাই। ইংল্যান্ডকে ১১৮ রানে আটকে রাখতে পেরেছিল বোলাররা। সেই রান তাড়ায় ব্যাটাররা করতে পেরেছে কেবল ৯৭। পরের দুই ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে রান এসেছে ১০৩ ও ১০৬। ম্যাচ কার্যত শেষ প্রথম ইনিংসের পরই।

অথচ ওই দিন পর্যন্ত আসরের সেরা চার রান স্কোরারের দুই জনই ছিল বাংলাদেশের। চার ইনিংসে ১৩৪ রান করেছেন সোবহানা, ১০৪ নিগার। কিন্তু অন্যদের অবস্থা এতটাই সঙ্গীন যে ধুঁকতে হয়েছে দলকে। এমনকি সোবহানা ও নিগারের রানও আদতে খুব কাজে লাগেনি দলের। বড় ইনিংস খেলতে পারেননি কেউ, খুব গতিময় ব্যাটিংও করতে পারেননি তারা। সোবহানার স্ট্রাইক রেট ৮৮.৭৪, নিগারের ৮৬.৬৬। চার ইনিংসে ছক্কা এসেছে মোটে দুটি। ৮০ ওভার ব্যাট করে চার হয়েছে স্রেফ ৩০টি।

এক-দুই রান নিতে না পারার চিরন্তন সমস্যা তো ছিলই। প্রতি ম্যাচের পরই ব্যাটিংয়ে উন্নতির তাড়নার কথা বলা হয়েছে দল থেকে। কিন্তু উন্নতির কোনো ছাপ পারফরম্যান্সে পড়েনি। চার ম্যাচে এক জয় নিয়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ার পর সেই পুরনো সমস্যার কথাই আবার তুলে ধরেন জ্যোতি, ‘সমস্যাটি খুবই দৃশ্যমান যে, ব্যাটিং ইউনিট হিসেবে আমরা ধুঁকছি। যদি পাওয়ার প্লেতে আমরা ভালো শুরু পাই, তাহলে মিডল অর্ডারে ধুঁকতে হয়।

কখনো কখনো সেভাবে শেষ করতে পারি না, যেভাবে করা উচিত। অনেক প্রশ্ন নিয়েই তাই আমরা যাচ্ছি। সামনের পথচলায় প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের। বোলাররা ভালো করেছে, ব্যাটাররা রান করতে পারেনি। ইংল্যান্ড ১১৯ রান করেছে, আমরা সেটা তাড়া করতে পারিনি। এটা তো আমাদেরই ব্যর্থতা।’  
গত প্রায় এক বছর ধরেই ক্রিকেটারদের মানসিক শক্তির ঘাটতির কথা নানা সময়ে বলে আসছিলেন কোচ হাশান তিলাকারতেœ ও অধিনায়ক জ্যোতি। বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পেছনেও এটিকে মূল কারণ বলছেন অধিনায়ক, ‘এসব পর্যায়ে আসলে ক্রিকেটারদের মানসিক দিকটা আরও শক্তিশালী হওয়া উচিত। দল যথেষ্টই অভিজ্ঞ, বলব আমি। তবে এরকম টুর্নামেন্টে এসে যদি দলীয় প্রচেষ্টা না হয় বা কোনো পারফরম্যান্স না হয়, তাহলে সেটা ম্যাচ জেতার দিকে যায় না।

দু-একটি ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স এত বড় পর্যায়ে এসে ম্যাচ জেতায় না।’ এই বিশ্বকাপ হওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশে। কিন্তু দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর অস্থিরতার কারণে আসরটি চলে যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বাংলাদেশ দল প্রস্তুতি নিচ্ছিল দেশের মাঠে খেলার কথা ভেবেই। ভিন্ন দেশে বিশ্বকাপ চলে যাওয়ার প্রভাব পারফরম্যান্সে পড়েছে কি না, এমন প্রশ্নও উঠেছে।

তবে বাজে পারফরম্যান্সের পরও অন্তত একটা ইতিবাচক দিক যে, উইকেট-কন্ডিশনকে ঢাল বানাতে চাননি অধিনায়ক জ্যোতি, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে শারজাহর উইকেটের পার্থক্য খুব একটা ছিল না। স্পিন সহায়ক উইকেট ছিল। স্পিনাররা ভালো করেছে। ব্যাটাররা নিজেদের মেরে ধরতে পারেনি। ভেন্যু তাই কোনো কিছু নয়। দল হিসেবে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ভেন্যুকে দোষ দিয়ে লাভ নেই।’

×