১৭ বছরের ক্যারিয়ারে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক টি- টোয়েন্টি খেলবেন মাহমুদুল্লাহ
২০০৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর নাইরোবিতে কেনিয়ার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক টি২০-তে যাত্রা শুরু। এরপর নিজেকে দলে প্রতিষ্ঠিত করেছেন কার্যকর এক অলরাউন্ডার হিসেবে। খেলেছেন বাংলাদেশের হয়ে সর্বাধিক টি২০। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশকে সবচেয়ে বেশি ৪৩ ম্যাচে নেতৃত্বও দিয়েছেন এই ফরম্যাটে।
তবে ‘ফিনিশার’ নাম পাওয়া মাহমুদুল্লাহ পরবর্তীতে যেন বোঝা হয়ে ওঠেন এবং প্রথম ক্যাপ্টেন্সি ছাড়েন, পরবর্তীতে দল থেকেও ছিটকে যান। এরপর ফিরে এসে এবার বৈচিত্র্যময় টি২০ ক্যারিয়ারে থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন মাহমুদুল্লাহ।
সবমিলিয়ে হিসেব কষলে ১৭ বছর ৪২ দিন আন্তর্জাতিক টি২০ অঙ্গনে বিচরণ করে এই ফরম্যাটে থামছেন মাহমুদুল্লাহ। ৩৮ বছর বয়সী এই তারকা এখন বিশ্বের টেস্ট খেলুড়ে দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সী আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। তিনি মঙ্গলবার বিকেলে অরুন জেটলি স্টেডিয়ামে জানিয়ে দেন ভারতের বিপক্ষে চলমান ৩ ম্যাচের টি২০ সিরিজ শেষ করেই এই ফরম্যাটে আর বাংলাদেশের হয়ে খেলবেন না।
২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফি টি২০ আসরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ঐতিহাসিক এক ম্যাচ খেলেছেন মাহমুদুল্লাহ। দুই দলের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়া ও বেশ কিছুক্ষণ খেলা বন্ধ থাকার পর সেটি শুরু হওয়া মিলিয়ে বিশ্ব কাঁপানো এক লড়াই হয়েছে দুই দলের মধ্যে। সেই ম্যাচটিতে ছক্কা হাঁকিয়ে বাংলাদেশকে জিতিয়েছেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। ২ বলে ৬ রান দরকার থাকলেও ১ বল আগেই জিতে যায় টাইগাররা। চরম উত্তেজনাপূর্ণ সেই ম্যাচে জয় পাওয়াটাই মর্যাদার ব্যাপার হয়ে ওঠে এবং মাহমুদুল্লাহ শুধু ছক্কাই হাঁকাননি বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমী দর্শকদের অন্তরে ভালোবাসার সিলমোহর বসিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
কলম্বোর সেই ম্যাচটির আগেই ‘ফিনিশার’ হিসেবে নাম কামিয়েছেন মাহমুদুল্লাহ। কারণ ক্যারিয়ারের সিংহভাগ ম্যাচেই ৭ কিংবা ৮ নম্বর পজিশনে ব্যাট করতে হয়েছে তাকে। আর বেশ কিছু ম্যাচ জেতাতেও পেরেছেন গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলে। তাকে অনেকেই ‘ফিনিশার’ তকমা দিয়েছেন সেজন্য। তবে বেশকিছু ম্যাচে আবার দলকে জেতাতেও পারেননি গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে আউট হয়ে কিংবা ধীরগতির ব্যাটিং করে। এর মধ্যে অন্যতম ২০১৬ টি২০ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ব্যাঙ্গালুরুতে ১ রানে হারের ম্যাচটি।
৩৮ বছর বয়সী মাহমুদুল্লাহর সাম্প্রতিক ফর্ম এবং দীর্ঘদিন ধরে টি২০ ক্রিকেটের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ স্ট্রাইকরেট নিয়ে দীর্ঘদিন কথা হচ্ছিল। চলতি বছর মাহমুদুল্লাহ ১৮ টি২০ খেলেছেন। দুই ম্যাচে ফিফটি করেছেন। সর্বশেষ ৯ ম্যাচে করতে পেরেছেন মাত্র ৯৯ রান। ভারতের বিপক্ষে গোয়ালিয়রে প্রথম টি২০-তে করেন মাত্র ১ রান। এরপর তাকে নিয়ে অনেক সমালোচনা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন পরিমন্ডলে।
২০০৭ সালের জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে কলম্বোয় ওয়ানডে ক্রিকেট দিয়ে বাংলাদেশের জার্সিতে যাত্রা শুরু করেন মাহমুদুল্লাহ। নিজেকে প্রমাণ করে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন বাংলাদেশ দলে। আর ২১৮ সালে পেয়ে যান টি২০ ফরম্যাটের নেতৃত্ব। তবে ২০২১ বিশ্বকাপে তার অধিনায়কত্বে সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ কাটিয়েছে বাংলাদেশ। মাহমুদুল্লাহও তেমন ভালো করতে পারেননি।
স্ট্রাইকরেট ও ফর্ম নিয়ে সমালোচনার মধ্যে পড়েন মাহমুদুল্লাহ। শেষ পর্যন্ত ২০২২ সালের মাঝামাঝি টি২০ ফরম্যাটের অধিনায়কত্ব ছাড়তে বাধ্য হন। এরপর দল থেকেই বাদ পড়েন এবং ২০২২ সালের টি২০ বিশ্বকাপের দলে জায়গা হয়নি তার। সে সময় বিসিবি থেকে তাকে অবসর নেওয়ার আহ্বান জানানো হলেও তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং পারফর্ম করে ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
মাহমুদুল্লাহর অনুপস্থিতিতে বেশ কয়েকজনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলেও তারা ভালো করতে পারেননি। দেশের ক্রিকেট ভক্ত-সমর্থকরা তখন মাহমুদুল্লাহকে ফেরাতে মানববন্ধন, সমাবেশ ও মিছিলও করে। ঘরোয়া ক্রিকেটেও ভালো করছিলেন। শেষ পর্যন্ত দলে ফেরেন মাহমুদুল্লাহ। এরপর বেশ ভালো পারফর্ম করছিলেন। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে দলের চরম ব্যর্থতার মধ্যেও উজ্জ্বল ছিলেন এবং একটি সেঞ্চুরিও করেন।
ফেরার পর টি২০ ফরম্যাটে কিছু ম্যাচ ভালো করলেও চলতি বছর একেবারে ভালো যায়নি তার। বিশেষ করে এ বছর জুনে অনুষ্ঠিত টি২০ বিশ্বকাপে চরমভাবে ব্যর্থ ছিলেন, দলও আহামরি কিছু করতে পারেনি। চারদিকে আলোচনা শুরু হয় দুই অভিজ্ঞ সাকিব ও মাহমুদুল্লাহ হয়তো অবসর নেবেন বিশ্বকাপ শেষে। তবে সেটি তারা করেননি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ফিল্ডিংয়েও শিথিলতা আসে মাহমুদুল্লাহর। সবমিলিয়ে তার টি২০ ফরম্যাটে খেলা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে তৈরি হয় সমালোচনা।
অনেক সমালোচনা থাকলেও সরে যাওয়ার কোনো আভাস দেননি মাহমুদুল্লাহ। কিন্তু সাকিব আল হাসান এবার ভারত সফরে ২ টেস্টের সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচের আগে অবসর ঘোষণা দেন। এতেই মাহমুদুল্লাহও সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পেরেছেন। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক ১৩৯ টি২০ খেলেছেন মাহমুদুল্লাহ। ২৩.৪৮ গড় ও ১১৭.৭৪ স্ট্রাইকরেটে ২৩৯৫ রান করেছেন ৮ ফিফটি হাঁকিয়ে।
বল হাতেও বেশ কার্যকর ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে নানা সময়ে ডানহাতি অফস্পিনে ভালো ব্রেক থ্রু দিযেছেন। সবমিলিয়ে তিনি উইকেট নিয়েছেন ৪০টি। দেশকে সর্বাধিক ৪৩ টি২০-তে নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। তার নেতৃত্বে ১৬ জয় পাওয়ার পাশাপাশি ২৬ পরাজয় দেখেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে সাকিবের সঙ্গে যৌথভাবে সবচেয়ে বেশি জয় তিনিই পেয়েছেন।
মামুন/এসআর