ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১

বেলা শেষে বিবর্ণ সাকিব আল হাসান

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:৩৫, ২ অক্টোবর ২০২৪

বেলা শেষে বিবর্ণ সাকিব আল হাসান

টেস্ট ক্রিকেটে এমন ভঙ্গিমায় সাকিব আল হাসানকে আর না দেখার সম্ভাবনাই বেশি

রেকর্ডে, পরিসংখ্যানে, অর্জনে, সম্মানে তিনি কেবল বাংলাশেরই নন, বিশ্ব ক্রিকেটেরই চলমান কিংবদন্তি। টাইগার ক্রিকেটের অবিস্মরণীয় যত সাফল্য, গর্ব করার মতো যত অনুসঙ্গ, প্রায় সর্বত্রই বিরাজমান সাকিব আল হাসান। তাই তো তিনি বাংলার জান। বাংলাদেশের কেউ বিশ্ব ক্রিকেট শ্বাসন করবেন, নাম লেখাবেন বিশ্বসেরাদের কাতারে, এক সময় যেটা ছিল শুধুই কল্পনা, সেটিই সত্যি করে দেখিয়েছেন মাগুরায় জন্ম নেওয়া ৩৭ বছর বয়সী এ অলরাউন্ডার।

একই সঙ্গে তিন ফরম্যাটের আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ওঠা, সবচেয়ে বেশি সময় শীর্ষস্থান ধরে রখা, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট আইপিএলে একাধিক শিরোপার অংশীদার হওয়া, আরও কত কী। কিন্তু প্রশ্ন যখন ব্যক্তি সাকিবকে নিয়ে, আলোচনা তখন দুই ভাগে বিভক্ত! লাইভ সম্প্রচারে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, বিতর্কিত বেটিং (বাজি) কোম্পানির স্পন্সর হওয়া, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, আরও কত কী...।

তবে সাকিব তার ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন আওয়ামী লগী সরকারের পতনের পর। কানপুরে টি২০ থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে জানিয়েছেন, ঘরের মাঠে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আসন্ন সিরিজই হবে টেস্টে তার শেষ অধ্যায়, যদি সেই সুযোগটা তিনি পান। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাকিবের দেশে ফেরাই যে অনিশ্চিত! 
‘দেখুন, এখন পর্যন্ত আমি তো অ্যাভেইলেবল। দেশে যেহেতু অনেক পরিস্থিতি আছে, স্বাভাবিকভাবেই সবকিছু অবশ্যই আমার ওপরে না। আমি বিসিবির সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করেছি। তাদেরকে বলা হয়েছে, আমার কী পরিকল্পনা টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে। ভারতে এই সিরিজ আর ঘরের মাঠের সিরিজটা আমি অনুভব করেছি যে, আমার শেষ সিরিজ হবে টেস্ট ক্রিকেটে। এটা আমার ইচ্ছা। যদি সেটা করা সম্ভব না হয় তাহলে এটাই সম্ভবত হবে আমার শেষ টেস্ট।’ ভারত সফরে কানপুরে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট শুরুর আগেরদিন সংবাদ সম্মেলনে বলেন সাকিব।

বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাগুরা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সাকিব। গত মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বদলে গেছে প্রেক্ষাপট। সাংসদ পদ হারিয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত এক পোশাককর্মী হত্যা মামলার খড়গ নিয়ে খেলতে হচ্ছে তাকে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সাকিব তো এখনো পর্যন্ত দেশেই আসেননি।

এছাড়া সম্প্রতি শেয়ারবাজার কারসাজির অভিযোগে তাকে ৫০ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সাকিবের বাস্তবতা বেশ প্রতিকূল। তিনি নিজেও সেটা বুঝতে পারছেন, ‘পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র। দেশে অনেক কিছু বদলে গেছে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না।’ একজন ক্রিকেটার হিসেবে, যেটা নিজেদের হাতে ছিল, বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা যে সে কাজটা ঠিকভাবে করে গেছেন বা যাচ্ছেন, সাকিব বলেছেন তা-ও, ‘আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে কেমন খেলছি, কেমন প্রস্তুতি নিচ্ছি, পাকিস্তানে কেমন খেলছি। ভাগ্য ভালো ছিল, ভালো ফল করেছি, যেমন ফলাফল চেয়েছি।’
দেশে রাজনৈতিক পালাবদলের পর মাসখানেক আগে তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয় রাজধানীর আদাবর থানায়। গার্মেন্টসকর্মী রুবেল হত্যার ঘটনায় তার বাবা রফিকুল ইসলামের দায়ের করা মামলায় ১৫৬ জন আসামির তালিকায় ২৮ নম্বরে আছে সাকিবের নাম। মামলাটি হওয়ার সময় সাকিব ছিলেন বাংলাদেশ দলের সঙ্গে পাকিস্তান সফরে। ওই সফরের পর তিনি আর দেশে ফেরেনি। পাকিস্তান থেকে ইংল্যান্ডে যান তিনি কাউন্টি ক্রিকেটে খেলতে।

সেখান থেকেই সরাসরি চলে যান ভারত সফরে। হত্যা মামলা মাথায় নিয়ে দেশে ফেরা ও পরে যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের কাছে ফেরা নিয়ে সাকিবের নিজেরও কিছুটা শঙ্কা আছে। বিসিবি সভাপতি ফারুক আহমেদ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। তবে সবকিছু তার হাতে আর নেই সেটিও জানিয়েছেন সাকিব,‘দেশে যেহেতু অনেক পরিস্থিতি আছে, সবকিছু অবশ্যই আমার ওপরে না। আমি বিসিবির সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করেছি। তাদেরকে বলা হয়েছে আমার কি পরিকল্পনা।

এই সিরিজ আর হোম সিরিজটা আমি ফিল করেছিলাম আমার শেষ সিরিজ হবে, টেস্ট ক্রিকেটে স্পেশালি। ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে ও নির্বাচকদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। যদি সুযোগ থাকে, আমি যদি দেশে যাই, খেলতে পারি, তাহলে মিরপুর টেস্ট হবে আমার জন্য শেষ। সেই কথাটা বোর্ডের সবার সঙ্গে বলা হয়েছে। তারা চেষ্টা করছেন কিভাবে সুন্দরভাবে আয়োজন করা যায়।’
এখানেই শেষ নয়। দেশে ফেরা ও সিরিজ শেষে যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের কাছে নির্বিঘেœ ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তাও চেয়েছেন সাকিব, ‘আমি যেন গিয়ে খেলতে পারি এবং নিরাপদ অনুভব করি। যখন দেশের বাইরে আসার দরকার হবে, দেশের বাইরে আসতেও যেন আমার কোনো সমস্যা না হয়। বোর্ড খেয়াল করছে। বিষয়গুলোর সঙ্গে যারা জড়িত তারা দেখছেন। তারা হয়তো

আমাকে একটা সিদ্ধান্ত দেবে, যেটার ভিত্তিতে আমি দেশে গিয়ে খুব ভালোভাবে খেলে অন্তত টেস্ট ফরম্যাটটা ছাড়তে পারব।’ কষ্ট কিংবা অভিমান থেকে কি টেস্ট ছাড়ছেন সাকিব? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন,‘কষ্ট কিংবা অভিমান থেকে নেওয়া নয়। আমার মনে হয় এটাই সঠিক সময়, সরে যাওয়ার জন্য এবং নতুনদের আসার সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার জন্য।’ অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলে ফেলতে চাই, টি-টোয়েন্টি নিয়েও আমার কথা হয়েছে। বোর্ডের সবার সঙ্গে, নির্বাচকদের সঙ্গে, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে।

টি২০ থেকেও আমি সরে যাই। আপাতত পরের যে সিরিজগুলো আছে, নতুন খেলোয়াড় আসুক, সুযোগ দেওয়া হোক। আমার তো মনে হয়, টি২০ তে আমার শেষ ম্যাচ খেলে ফেলেছি বিশ্বকাপে।’ ওয়ানডে ক্রিকেট নিয়ে সাকিব তার পরিকল্পনাও জানিয়েছেন। আগামী বছর পাকিস্তানে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলে ৫০ ওভারের খেলাটাও ছাড়তে চান।
মাঠের বাইরে দুঃসময়ের মধ্যে থাকা সাকিব মাঠের ভেতরও হারিয়ে খুঁজছেন নিজেকে। পাকিস্তান সফরে বোলিংয়ে মোটামুটি পারফর্ম করতে পারলেও ব্যাট হাতে ছিলেন সাদামাটা। ভারতের প্রথম টেস্টে ব্যাট হাতে একটু লড়াই করতে পারলেও বোলিংয়ে ছিলেন একদমই ধারহীন। সব মিলিয়ে তার পারফরম্যান্স সেরার ধারেকাছে নেই অনেক দিন ধরেই। গত বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপ থেকে চোখের সমস্যাও তাকে প্রবলভাবে ভোগাচ্ছে, যা বাজেভাবে প্রভাব ফেলছে তার ব্যাটিংয়ে।

তবে নিজের ক্যারিয়ার মূল্যায়ন করতে বলা হলে সাকিব হেসে উত্তরে বলেন, ‘আমি মনে করি, আমি রিজনেবলি ওকে করেছি। আমি খুশি। কোনো অনুশোচনা নেই। জীবনে কখনো অনুশোচনা ছিল না। এখনো নেই। যত দিন উপভোগ করেছি, আমি ক্রিকেট খেলেছি। আমার মনে হয়েছে, এটা বাংলাদেশ ক্রিকেট ও আমার জন্য সঠিক সময়, যে কারণে এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া। কোচ, অধিনায়ক, নির্বাচক, বোর্ডÑসবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া।’ 
২০০৭ সালের মে মাসে চট্টগ্রামে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে টেস্টে অভিষিক্ত সাকিব এই সংস্করণে এখনও পর্যন্ত খেলেছেন ৭০ টেস্ট। বাংলাদেশের ক্রিকেটে অসংখ্য রেকর্ড আর অর্জন তার সঙ্গী। দেশের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হিসেবে তিনি অবিসংবাদিত। বিশ্ব ক্রিকেটের পরিম-লেও তার রেকর্ডের কমতি নেই। তার টি২০ ক্যারিয়ার শেষ হলো ১২৯ ম্যাচে। এখানেও লম্বা সময় ছিলেন অলরাউন্ডারদের র‌্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরে।

×