ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১

বিদায়বেলায় বিবর্ণ সালাউদ্দিন

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০১:০০, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বিদায়বেলায় বিবর্ণ সালাউদ্দিন

কাজী মো. সালাউদ্দিন

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সেই কবে লিখেছিলেন, ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেই দিন হব শান্ত।’ তেমনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিনও বলতে পারেন, ‘আমি সালাউদ্দিন রণক্লান্ত, অবশেষে হলাম শান্ত!’ ফিফার আইন তার পক্ষে থাকায় জোর গলায় ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি পদত্যাগ করবেন না, বরং বাফুফের নির্বাচনে আবারও অংশ নেবেন। এও বলেছিলেন, নির্বাচন করাটা তার অধিকার এবং পারলে নির্বাচনে কেউ তাকে হারিয়ে দেখাক। তার এমন দৃঢ়প্রত্যয়ে ফুটবলপ্রেমীরা ধরেই নিয়েছিলেন সালাউদ্দিন আগামী ২৬ অক্টোবরে বহুল আলোচিত বাফুফের নির্বাচনে সভাপতি পদে আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
কিন্তু গত ১৪ সেপ্টেম্বর পাল্টে যায় সব দৃশ্যপট। সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাফুফে ভবনে ক্রীড়া সাংবাদিকদের ডেকে টানা চার মেয়াদে বাফুফের সভাপতির দায়িত্ব পালন করা সালাউদ্দিন ঘোষণা দেন নির্বাচন করবেন না তিনি (আওয়ামী সরকার পতনের পর বাফুফে ভবনে এই প্রথম এলেন তিনি)! এবং সেটা পারিবারিক কারণে। তবে ফুটবলপ্রেমীরা মনে করছেন কারণটা ভিন্ন।
বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের পদত্যাগ বা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার বিষয়ে সাবেক ফুটবলার ও নানা শ্রেণি আন্দোলন-প্রতিবাদ করছিল। কোনো চাপে এই সিদ্ধান্ত কি নাÑ এ বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি। অথচ এক মাস আগেও সালাউদ্দিন আবারও নির্বাচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তবে বিদায়বেলায় সালাউদ্দিনের আক্ষেপÑ তার আমলে বাংলাদেশ সিনিয়র সাফ জিততে পারেনি।
গত ১৬ বছরে দেশের ফুটবলকে হাস্যরস আর তামাশার বস্তুতে পরিণত করেছিলেন সালাউদ্দিন। তার সময়েই র‌্যাঙ্কিংয়ের সবচেয়ে তলানিতে চলে যায় দেশের ফুটবল, এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাটিয়েছে দুই বছরের নির্বাসন। পাশাপাশি মারাত্মক রকমের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও আছে বাফুফে সভাপতির বিরুদ্ধে। এজন্য ফিফা থেকে নিষিদ্ধ হয়েছেন তার সাধারণ সম্পাদক, জরিমানা গুনেছেন সিনিয়র সহসভাপতিও।
২০২২ বিশ্বকাপে খেলবে বাংলাদেশ! দ্বিতীয়বারের মতো বাফুফে সভাপতি নির্বাচিত হয়ে এমন বড় স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন কাজী সালাউদ্দিন। সময়ের ব্যবধানে এটাই এখন সবচেয়ে বড় কৌতুক। সালাউদ্দিনরা শুধু ফুটবল নয়, হাস্যরস করেছেন এই খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা গণমাধ্যমকর্মী নিয়েও। নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে গণমাধ্যমের গঠনমূলক সমালোচনাগুলো নিয়েছেন তির্যকভাবে। অনেক সংবাদকর্মী হয়েছেন তাদের প্রকাশ্য শত্রু। অথচ দেশের ফুটবল নিয়ে কাজ করার জন্য পেয়েছিলেন প্রায় দেড় যুগের কাছাকাছি সময়।
সালাউদ্দিনের গায়ে বড় কোনো আর্থিক কেলেঙ্করির সরাসরি দায় না থাকলেও বাফুফের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অর্থ লোপাটের অভিযোগ আছে তীব্রভাবে। সিলেট বিকেএসপিতে একাডেমির জন্য ৭ লাখ মার্কিন ডলার অর্থ সহায়তা দিয়েছিল ফিফা। বাফুফের সেই প্রোজেক্ট চলেছিল মাত্র কয়েক মাস। অথচ কোনো অডিট রিপোর্টেই একাডেমি পরিচালনার জন্য ফিফার দেওয়া ৭ লাখ ডলারের কথা উল্লেখ করা হয়নি।

২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের খরচ নিয়েও উঠেছিল নয়-ছয়ের অভিযোগ। পাঁচ কোটি টাকার বাজেট নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ১৫ কোটিতে। সরাসরি খেলা সম্প্রচারে যন্ত্রপাতি ভাড়ার নামে দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে। প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার ভুয়া খরচ দেখিয়ে ভারতীয় একটি কোম্পানির সহযোগিতায় ওই টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠে কাজী সালাউদ্দিনের যোগসাজশে।
ফুটবল উন্নয়নের জন্য ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাফুফেকে ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। একটি বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সেটি স্থায়ী আমানত করে রাখা হলেও বছর না ঘুরতে তা খরচ করে ফেলে বাফুফে। এমন আরও বহু ঘটনার জন্ম দিয়েছেন সালাউদ্দিন বাফুফের সভাপতি থাকা অবস্থায়। আর এসব অনিয়মের ফলে ফিফা থেকে নিষিদ্ধ হন তার সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ। বড় অঙ্কের জরিমানা গুনেছেন সিনিয়র সহসভাপতি সালাম মুর্শেদী।
সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল টিমস কমিটি প্রায় ১৬ বছরে জাতীয় দলের কোচ পরিবর্তন করে ২৩ বার। বাফুফেতে লম্বা সময়ে তার সফলতার কেচ্ছা বলতে নারী ফুটবলের সাফ জয়।
সালাউদ্দিন দেশের ফুটবলের জন্য কোনো বিকল্প মাঠও তৈরি করতে পারেননি। এখনো দেশের ফুটবল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামকেন্দ্রিক। বয়সভিত্তিক নারী সাফে আরও দুটি শিরোপা রয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু এরপরও দেশের নারী ফুটবল হেঁটেছে উল্টোপথে। তেমন উন্নতি হয়নি তাদের। উল্টো নিজেদের সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা নিয়ে রীতিমতো কর্মবিরতিতে যেতে হয়েছে নারী ফুটবলারদের। বেতন বৃদ্ধি করে চুক্তির আওতায় আনলেও নিয়মিত বেতন মেলেনি নারী ফুটবলারদের। অর্থের সংকটের কথা বলে নারী দলকে অলিম্পিক বাছাই খেলতে বিদেশেও পাঠাননি তিনি। 
দেশের লিগ নিয়মিত করলেও লিগের মানোন্নয়ন করতে পারেননি। ক্লাবগুলোকে একাডেমি, বয়সভিত্তক দলগঠন কিংবা নারী ফুটবলে অংশগ্রহণের জন্য আনতে পারেননি তিনি।
দায়িত্ব নিয়ে কোটি টাকার সুপার কাপ আয়োজন করে চমক দেখিয়েছিলেন সালাউদ্দিন। তবে এরপর আর সেই সুপার কাপ আয়োজন করতে পারেননি তিনি। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফের নিয়মিত করার ঘোষণা দিয়ে কথা রাখতে পারেননি। নতুন বঙ্গমাতা গোল্ডকাপও এক আসরেই সীমাবদ্ধ। তার শেষ মেয়াদে আর্থিক অনিয়ম আর অসঙ্গতির কথা বারবার সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। ক্রিকেট বোর্ড সভাপতিকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য দিয়ে নিজেকে আরও নিচে নামান ফুটবল সভাপতি। জেলাগুলোর সঙ্গে গত দুই বছরে কোনো সভা করেননি তিনি। 
তার আমলে আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয়ের জন্য হাহাকার ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দল হতে পারেনি বাংলাদেশ। ভুটান ট্র্যাজেডি হয়েছে দু-দুবার। র‌্যাঙ্কিংয়ে শুধুই অবনমন। ২০১৬ সালে সভাপতি হয়েই ঘোষণা দেন সভাপতি পদে আর কখনো লড়াই না করার। কিন্তু চতুর্থ দফায় ফের প্রার্থী হয়ে সভাপতি হয়েছিলেন। 
বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফের নিয়মিত করার ঘোষণা দিয়ে কথা রাখতে পারেননি। নতুন বঙ্গমাতা গোল্ডকাপও এক আসরেই সীমাবদ্ধ। ২০১৯-এ বলেছিলেন তার দৃষ্টিতে ৫০ বছরের সেরা জাতীয় দল এটিই। অথচ অপেশাদার সিশেলসের কাছে হারে বাংলাদেশ লজ্জার সাগরে ডুবেছে তার সময়েই।

×