ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

নাহিদ রানা- দ্য নিউ স্পিড স্টার

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:৪৫, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

নাহিদ রানা- দ্য নিউ স্পিড স্টার

সম্প্রতি গতি দিয়ে পাকিস্তানি ব্যাটারদের নাকানি-চুবানি খাওয়ানো পেসার নাহিদ রানা এভাবেই হয়েছেন দলের মধ্যমণি

ফোর্থ স্ট্যাম্পে থাকা বল ফ্রন্টফুটে খেলতে চেয়েছিলেন বাবর আজম। সময়ের অন্যতম সেরা ব্যাটার টাইমিংয়ে গড়বড়, একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল; হবেই না বা কেন? বলের গতি যে ঘণ্টায় দেড় শ’ কিলোমিটার! ব্যাটের কানা ছুঁয়ে জমা হলো থার্ড স্লিপে। রাওয়ালপিন্ডিতে দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসের চিত্র এটি। যেখানে বোলার নাহিদ রানা।

ভয়ংকর এক স্পেলে অধিনায়ক শান মাসুদ, সুপারস্টার বাবর এবং ইনফর্ম সাউদ শাকিলকে সাজঘরে ফিরিয়ে মুহূর্তেই প্রতিপক্ষ শিবির নাড়িয়ে দেন ২১ বছর বয়সি ডানহাতি পেসার। যে ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি পাকিস্তান। ১৭২ রানে গুটিয়ে গিয়ে হার ৬ উইকেটে। নিজ আঙিনায় হোয়াইটওয়াশ ২-০ ব্যবধানে। নাহিদ ৪, হাসান মাহমুদ ৫ ও তাসকিন আহমেদ ১Ñ প্রতিপক্ষের ১০ উইকেটের সবকটি তুলে নিয়ে ইতিহাস গড়েন তিন টাইগার পেসার।

‘নাহিদ রানা রোমাঞ্চকর ক্রিকেটার। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের জন্যও’Ñ প্রথম টেস্টের পরই বলছিলেন চন্দ্রিকা হাথুরুসিংহে, ‘সে ১৪০+ গতিতে বল করে ধারাবাহিকভাবে এবং সে খুবই তরুণ। আমরা আরও অনেক কিছু দেখতে পারব নাহিদের কাছ থেকে। তার সেরাটা এখনো দেখতে বাকি।’ 
পাকিস্তান সফরে গোটা সিরিজেই ১৪৫ কিলোমিটারের ওপরে, ১৪৯-১৫০ কিলোমিটারের আশপাশে গতিতে বোলিং করেছেন নাহিদ। দ্বিতীয় টেস্টে তার একটি ডেলিভারি ছিল ১৬২ কিলোমিটার! বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসে যা রেকর্ড, ছড়িয়ে গেছেন রুবেল হোসেনকে (১৪৯.৫ কি.মি.)। সাধারণত একজন পেসার উইকেট পেলে যেমন উদযাপন করেন, নাহিদ তার উল্টো। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার এই পেসারের হাসি ঘিরেই যেন সব উদযাপন।

গতির ঝড় তোলা তরুণের ক্যারিয়ারের বয়স মোটে তিন টেস্টের। নিয়েছেন ১১ উইকেট। দেখিয়েছেন গতির খেলা। ‘আগে থেকেই জোরে বোলিং করতে পারতাম। চেষ্টা থাকে গতি ধরে রাখার। রেকর্ডের বিষয়টি আসলে ভাবিনি। ওসব নিয়ে অতবেশি চিন্তাও করি না। মাথায় একটা বিষয়ই রাখি, কিভাবে ভালো কিছু করতে পারব। রান কম দেব, উইকেট নেব। বাংলাদেশকে লম্বা সময় সার্ভিস দিতে পারব। চেষ্টা থাকবে লাইনলেন্থ মেনে গতিতে বোলিং করার।’ গতি প্রসঙ্গে সংবাদ মাধ্যমে বলছিলেন নাহিদ।

পাকিস্তান সফরের স্মৃতিটাও তার জন্য স্মরণীয়, ‘সত্যি বলতে সিরিজটি দারুণ কিছু পাওয়ার। অনেক ভালো লাগছে। দেশের জন্য ভালো কিছু আনতে পেরেছি ভেবে বেশি খুশি লাগছে। আলহামদুলিল্লাহ। নিজে ভালো কিছু করতে পেরেছি বলে সবাই খুশি। এই আনন্দ আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো না।’  দুই টেস্টে নাহিদের শিকার ৬ উইকেট। এর মধ্যে দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ৪৪ রানে ৪ উইকেট তাঁর ক্যারিয়ারসেরা বোলিং।

তবে সিরিজজুড়ে নাহিদের পারফরম্যান্সকে শুধু সংখ্যায় প্রকাশ করা যাবে না। বাংলাদেশের বোলিংয়ে এক্স-ফ্যাক্টর যোগ করেছে তাঁর গতি। যখন বোলিংয়ে এসেছেন, দর্শকদের একটা চোখ থেকেছে স্পিডোমিটারে। নাহিদ গতি দিয়ে এমন আলোড়নই তুলতে চেয়েছিলেন। 
পাশাপাশি দলের জয়ে অবদান রাখতে পারার সন্তুষ্টি তো আছেই, ‘ব্যক্তিগত লক্ষ্য ছিল, যদি একাদশে সুযোগ পাই, তাহলে যেভাবেই হোক, দলের জয়ে যেন কিছুটা হলেও অবদান রাখতে পারি। সেটা করতে পেরেছি। সেদিক থেকে সন্তুষ্টি আছে।’ পাকিস্তানের পেসারদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। প্রশংসা পেয়েছেন তাঁদেরও, ‘ওদের খেলোয়াড় সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। শাহিন শাহ আফ্রিদি বলছিল, মাশাল্লাহ, তোমার পেস অনেক ভালো।

নিজেকে মেনটেইন কর।’ বাংলাদেশ দলও নাহিদের কাছে ওই গতিটাই চায়। ছোট স্পেলে যত জোরে সম্ভব বোলিং করবেন। কাঁপন তুলবেন প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের শিরদাঁড়ায়। পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যান বাবর আজমের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দলের একই পরিকল্পনা ছিল। 
বাবর ক্রিজে এলেই নাহিদের হাতে বল তুলে দিয়েছেন অধিনায়ক। নাহিদ রানাও প্রতিদান দিয়েছেন সেই আস্থার। ৪ ইনিংসে ২ বার ফিরিয়ে দিয়েছেন বাবরকে। প্রতিপক্ষ দলের সেরা ব্যাটসম্যানকে আউট করার জন্য অবশ্য বিশেষ কোনো কৌশল কাজে লাগাননি। তাঁর মুখেই শুনুন, ‘বাবর তো বিশ্বের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। ওই মানের একজনকে বোলিং করলে নিজের সামর্থ্যটা বোঝা যায়। আমি বেশি কিছু চিন্তা করিনি।

একটা চিন্তা করেছি, আমি ওকে একেবারে সামনেও দেব না, একেবারে পেছনেও দেব না। মানে হাফ ভলিও না, শর্টও না। মানে একদম সহজ পরিকল্পনা ছিল। আমাকে এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে, এসব ভাবিনি। আমাকে শান্ত ভাই বলেছে, তুই তোর মন মতো বল কর। বেশি চিন্তা করতে হবে না।’ 
অধিনায়ক নাজমুলের সঙ্গে নাহিদের বোঝাপড়াটা খুব ভালো। দুজনই রাজশাহীর। নাহিদের প্রথম শ্রেণির অভিষেকে জাতীয় লিগে রাজশাহী বিভাগ দলের অধিনায়কও ছিলেন নাজমুল। ‘ওনার সঙ্গে আমার বোঝাপড়াটা অনেক ভালো। আমাকে শুরু থেকে দেখেছেন। বোলিংয়ের ক্ষেত্রে আমার আর তাঁর ভাবনা প্রায় একই।’ টেস্ট ক্যারিয়ার মাত্র শুরু। গত মার্চে সিলেটে অভিষেকের পর পাকিস্তানেই আবার নেমেছেন মাঠে। বিখ্যাত অনেক ফাস্ট বোলারের জন্মভূমিতে যে প্রতিশ্রুতির ছাপ রেখেছেন। 
বাংলাদেশ দল দুই টেস্ট ও তিনটি টি২০ খেলতে রবিবার ভারতের বিমান ধরবে। পাকিস্তান সফরকে পেছনে ফেলে নাহিদ রানা এখনই তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন, ‘সামনে খেলা আছে। বড় সিরিজ আছে। আমি রিল্যাক্স থাকার চেষ্টা করছি।’ পাকিস্তানে গতির ঝড় দেখিয়ে আসা নাহিদের ব্যক্তিগত লক্ষ্য কী? ‘আমার লক্ষ্য ওটাইÑ দলে সুযোগ পেলে ভালো কিছু কন্ট্রিবিউট করার চেষ্টা করব। কিছু দেওয়ার চেষ্টা করব।

টিমের জন্য কিছু করতে পারলে আলহামদুলিল্লাহ। ভারতের বিপক্ষে জিততে পারিনি আগে কখনো, তবে ওসব নিয়ে ভাবছি না। আশা করছি ওখানেও আমরা ভালো কিছু করব। স্বপ্ন একটাই খেলব। যখন যে ফরম্যাটে দেশের হয়ে সুযোগ পাব, সেখানেই ভালো করার চেষ্টা করব। টেস্ট ছাড়া অন্য ফরম্যাটে জায়গা পেলে নিজেকে মানিয়ে নেব। ভালো বোলিং করার চেষ্টা করব। দেশকে অনেক দিন সার্ভিস দিতে চাই।’

×