
অনুশীলনে চৌকস গোলরক্ষক কোচ নুরুজ্জামান নয়ন
এই ক্রীড়া ভুবনের ক্রীড়ামঞ্চে অসংখ্য ক্রীড়ার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কোনটি? সবাই এক কথায় জবাব দেবেন ফুটবল। এ খেলার অনুরাগীদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে তাদের ওপর- যারা গোল করেন। কিন্তু গোলরক্ষক যদি বিপক্ষের আক্রমণকে প্রতিহত না করতেন, তাহলে দল হারবে। কাজেই স্ট্রাইকার-মিডফিল্ডার-ডিফেন্ডারদের চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নন একজন গোলরক্ষক।
গোলপোস্টের অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে যুগে যুগে খ্যাতিমান হয়েছেন অনেকেই। তাদের সাফল্যের নেপথ্যে থাকেন গোলরক্ষক কোচ। বাংলাদেশে আছেন এমনই এক সফল গোলরক্ষক কোচ। যার নাম নুরুজ্জামান নয়ন। যার বিশেষত্ব হচ্ছে ‘প্রথম’ কিছু করা (এ নিয়ে পরে বলা হবে)।
আগামী সেপ্টেম্বরে ভুটানের বিপক্ষে দুটি প্রীতি ম্যাচের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের গোলরক্ষক কোচের দায়িত্ব পেয়েছেন নয়ন। শুধু এই ফিফা উইন্ডোতেই জাতীয় দলের হয়ে কাজ করবেন তিনি। গত পাঁচ মৌসুম ধরে তিনি কাজ করছেন বসুন্ধরা কিংসের গোলরক্ষক কোচ হিসেবে। আসছে মৌসুমেও তিনি থাকছেন কিংসেই। এর মধ্যেই তাকে কাজ করতে হচ্ছে জাতীয় দলের সঙ্গেও।
এর আগেও চার মেয়াদে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। সর্বশেষ ২০২১ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেও তিনি ছিলেন গোলরক্ষক কোচের ভূমিকায়। তার আগে ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৮ সালেও জাতীয় দলের গোলরক্ষক কোচ ছিলেন তিনি।
৪৪ বছর বয়সী সুদর্শন নয়ন সর্বশেষ কোর্স করেছেন এএফসি গোলকিপিং এ-ডিপ্লোমা (১৬ অক্টোবর-২৯ নভেম্বর, ২০২৩, মালয়েশিয়া থেকে)। এটাই গোলকিপিং কোচিং কোর্সের সর্বশেষ ধাপ। এক্ষেত্রে প্রথম বাংলাদেশী কোচ তিনি। এ প্রসঙ্গে নয়নের একটু আবেগ আছে, ‘২০২৪ সালের ১০ জানুয়ারির সকালটা ছিল অন্যরকম। কারণ সেদিন আমি গোলকিপিং এ-ডিপ্লোমা লাইসেন্সটা পাই মালয়েশিয়া থেকে, ই-মেইলে। সেদিন মনে হয়েছিল আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী কোচ! এত আনন্দ লেগেছিল!
এই লাইসেন্সটা করার জন্য দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেক্ষা করেছিলাম। এর জন্য এক বছরের প্রস্তুতি লাগে। তারপর সাড়ে চার বছর ধরে চেষ্টা করেছি। প্যান্ডামিক আমাকে অনেক পিছিয়ে দিয়েছিল।’ নয়ন ছাড়াও এই কোর্সটি করেন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়ার ও তিমুর-লেস্তের মোট ১২ প্রশিক্ষণার্থী।
নয়ন ২০১১ সালে এএফসি সি-লাইসেন্স কোর্স (ইরান), ২০১২ সালে এএফসি ‘বি’ লাইন্সেস কোর্স (ভুটান), ২০১৬ সালে এএফসি গোলকিপিং লেভেল-১ কোর্স (নেপাল), ২০১৮ সালে এএফসি গোলকিপিং লেভেল-২ কোর্স (অস্ট্রেলিয়া, এটা বর্তমানে বি-ডিপ্লোমা কোর্স), ২০২০ সালে এএফসি এ-ডিপ্লোমা কোর্স করেন। একমাত্র প্রথম কোর্সটাই করেছেন এএফসি-বাফুফের সহায়তায়। বাকিগুলো করেছেন সব নিজের খরচে (প্লেন খরচসহ প্রায় ১০ লাখ টাকা)। আর প্রতিটি কোর্সই তিনি করেছেন ‘প্রথম’ বাংলাদেশী হিসেবে!
নয়নের গোলকিপিংয়ের প্রায় কোচিং কোর্সই করা শেষ। শুধু একটা কোর্স করা বাকি। সেটা আউটফিল্ড কোচদের ‘প্রো-ডিপ্লোমা’। নয়ন নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, ‘যদি ইউরোপ তথা উন্নত বিশ্ব ফুটবল দেশগুলোর দিকে তাকান, নির্দিষ্ট করে বললে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দিকে, তাহলে দেখবেন ওদের প্রায় সব কোচেরই এই প্রো-ডিপ্লোমা কোর্স করা। তবে এটা কিন্তু শুধুমাত্র গোলকিপিং কোর্স নয়।
কোচরা যদি প্রতিপক্ষ দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সবধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করতে চান, সেক্ষেত্রে এই কোর্স করার কোনো বিকল্প নেই।’ এই কোর্সটি করতে প্রায় বছর দুয়েক সময় লাগে। এই কোর্সটি করলে শুধু গোলকিপিং কোচ নয়, একজন হেড কোচ হিসেবেও অভিজ্ঞতা অর্জন করা যাবে। এক্ষেত্রে একজন হেড কোচের চেয়ে একজন গোলকিপিং কোচ অভিজ্ঞতায় এগিয়ে থাকবেন।
গোলকিপিংয়ের সর্বশেষ আপডেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা এবং কোচিং এডুকেটর হিসেবে কাজ করা ও গোলকিপিংয়ের বিভিন্ন ওয়ার্কশপ করাই হচ্ছে নয়নের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য। এ ছাড়া সুযোগ-সামর্থ্য থাকলে তৃণমূল পর্যায়ের বা সেমি-প্রফেশনাল লেভেলের গোলরক্ষকদের নিয়ে একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখেন তিনি, ‘তবে ঢাকায় জায়গার স্বল্পতার জন্য এমনটা বাস্তবায়তন করাটা অনেক চ্যালেঞ্জের। এক্ষেত্রে কেউ যদি এ ব্যাপারে সহযোগিতা করে অবশ্যই এটা করার চেষ্টা করব। আমি চাই এদেশের গোলরক্ষকরা অন্তত: টেকনিক-ট্যাকটিক্সটা জানুক। পারব কি না, সেটা সময়ই বলে দেবে।’
গত কয়েক বছরে বিদেশী কিছু ক্লাবে কাজ করার প্রস্তাব পেয়েছেন নয়ন (ভারতের আইএসএল, থাই লিগে, মালদ্বীপ প্রিমিয়ার লিগে)। ‘কিন্তু তখন কোর্সগুলো তেমন করা না থাকায় এবং নিজেকে পরিণত মনে না করায় সেই অফারগুলো গ্রহণ করিনি। কেননা ওই অবস্থায় সেখানে কাজ করলে ও ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের সুনাম ক্ষুণœ হতো। তবে আগামীতে পরিপক্ব হলে অবশ্যই বিদেশে কাজ করার প্রস্তাব এলে গ্রহণ করব।’
আন্তর্জাতিক ও ক্লাব ফুটবলে হেড কোচদের অনেকেই সাবেক খেলোয়াড় ছিলেন তারা ডিফেন্ডার, মিডফিল্ডার ও ফরোয়ার্ড পজিশনে। কিন্তু গোলরক্ষক ছিলেন, এমন হেড কোচ বলতে গেলে দেখাই যায় না। এর কারণ কি? নয়নের ভাষ্য, ‘রহমতগঞ্জের হেড কোচ মিলন ভাই কিন্তু গোলরক্ষক ছিলেন। এটা একটা ফ্যাসিনেশনের জায়গা।
গোলকিপার কোচরা সাধারণত স্পেশালাইজশনের দিকেই যায়, তারা সাধারণত হেড কোচের দিকে ঝোঁকেন না। তবে ব্যতিক্রম কিন্তু আছে। যেমন বাংলাদেশ দলের সাবেক ইতালিয় হেড কোচ ফ্যাবিও লোপেজ কিন্তু খেলোয়াড় জীবনে গোলকিপার ছিলেন। মোহামেডানের ইরানি কোচ নাসের হেজাজী (প্রয়াত)-ও তাই।’
নয়ন নিজেও হেড কোচ হতে চান না, ‘গোলকিপিং কোচ হিসেবে যেহেতু অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছি, তাই হেড কোচ হওয়ার ইচ্ছে নেই। যদিও গোলকিপিং কোচদের বেতন হেড কোচের চেয়ে কম। এটা জেনেও বলছি। তবে হেড কোচের দায়িত্ব ও চাপ কিন্তু অনেক বেশি।’
নয়ন জানালেন ইংল্যান্ডে কিন্তু বিভিন্ন পজিশনের জন্য আলাদা বিশেষজ্ঞ (যেমন ডিফেন্স, মিডফিল্ড, স্ট্রাইকিং) কোচ কাজ করে, ‘এর ফলে ওই স্পেসিফিক পজিশনগুলো অনেক স্ট্রং হয়। পুরো ক্রীড়াবিশ্বেই এখন সব ধরনের স্পোর্টসই কিন্তু এখন স্পেশালাইজড কোচের দিকে ঝুঁকছে।’
বর্তমান ফুটবলে যেমন কোচিং স্টাফে হেড কোচ, সহকারী কোচ, গোলকিপিং কোচ, ফিজিও, ফিটনেস ট্রেনার, ভিডিও এনালিস্ট, ম্যাসাজার, ডাক্তার থাকে, কিন্তু নব্বইয়ের দশকে নয়ন যখন ঘরোয়া ফুটবল খেলতেন, তখন কি এই পদগুলো ছিল? নাকি এক কোচই সব করতেন? ‘তখন প্রথম বিভাগই ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবল।
তখন আবাহনী, মোহামেডান মুক্তিযোদ্ধাতেই গোলকিপিং কোচ ছিল। সাবেক প্লেয়ারই তখন গোলকিপার কোচ হিসেবে কাজ করতেন। আমি যখন অনূর্ধ্ব-২০ জাতীয় দলে ট্রায়ালে ডাক পাই, তখন গোলকিপার কোচ হিসেবে সাবেক জাতীয় দলের গোলরক্ষক ছাইদ হাসান কানন ভাইকে পেয়েছিলাম (এখন মোহামেডানের গোলকিপার কোচ)। এছাড়া অন্য ক্লাবগুলোতে খেলার সময় গোলকিপার কোচ পাইনি। সেক্ষেত্রে নিজে নিজেই অনুশীলন করতাম। এক্ষেত্রে আদর্শ ছিলেন আমিনুল হক।
তখন তো ইন্টারনেট ছিল না যে ইউরোপের কাউকে দেখে শিখব।’ নয়ন ১৯৯৭-২০০৭ পর্যন্ত ফুটবলার হিসেবে খেলেছেন মিরপুর চলন্তিকা, ভিক্টোরিয়া, মিরপুর সিটি ক্লাব, শেখ রাসেল এবং ধানম-ি ক্লাবে। ছিলেন গোলরক্ষক। কোচ হিসেবে তার ঘরোয়া ফুটবলের ক্লাবগুলো হলো : ঢাকা মোহামেডান, মুক্তিযোদ্ধা, চট্টগ্রাম আবাহনী, মুক্তিযোদ্ধা ও বসুন্ধরা কিংস। এছাড়া ২০১২ সালে জাতীয় নারী ফুটবল দলেরও গোলরক্ষক কোচ ছিলেন। ২০১২-১৭ পর্যন্ত তৎকালীন গুলশান-১ এ অবস্থিত অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সাবেক হেলথ অ্যান্ড ফিজিক্যাল এডুকেশন টিচার ছিলেন নয়ন। অস্ট্রেলিয়ান স্কুলের স্থায়ী চাকরির প্রলোভন ত্যাগ করে ফুটবলের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাধার সিদ্ধান্ত নেন নয়ন।
২০০৭ সালে বিয়ে করা এবং দুই ছেলের জনক নয়ন গোলরক্ষক কোচ হিসেবে তার স্বপ্নগুলো কতটা বাস্তবে রূপ দিতে পারবেন, সেটা ভবিষ্যতই বলে দেবে।