ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

aiub
aiub

বাংলার তুরুপের তাস সাগরিকা

রুমেল খান

প্রকাশিত: ০১:০৩, ২৬ জুলাই ২০২৪

বাংলার তুরুপের তাস সাগরিকা

সাগরিকা

‘সাগরিকা’ নামটি নিঃসন্দেহে লাস্যময়ী। এই নামে কলকাতায় ১৯৫৬ এবং ঢাকায় ১৯৯৮ সালে দুটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ঢাকার সিনেমায় সাগরিকাকে উদ্দেশ করে একটি গানও আছে। এই নামটি আমাদের দেশে বেশ জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এটি ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ, আধুনিক ও উচ্চারণে আভিজাত্যের লক্ষণ বিদ্যমান। ‘সাগরিকা’ নামের অর্থ সাগরের বেলা, সমুদ্রের মেঘ।

এ ছাড়াও সাগরিকা নামের অন্য একটি প্রতিশব্দ হলো সমুদ্র, প্রশংসনীয়, মহান, প্রাচুর্য, অতুলনীয় প্রাণী। বাংলাদেশের চট্টগ্রামে সাগরিকা নামে একটি স্থান আছে। সাগরিকা এক্সপ্রেস (ট্রেন নং ২৯-৩০) বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল দ্বারা পরিচালিত একটি মিটারগেজ যাত্রীবাহী ট্রেন। এ ছাড়া কে-১৫ বা বি-০৫ সাংকেতিক নামেও পরিচিত ‘সাগরিকা’ একটি ভারতীয় ডুবোজাহাজ হতে উৎক্ষিপ্ত নিক্ষেপী ক্ষেপণাস্ত্রও বটে! 
সাগরিকা নামের এত গুণগান গাইবার একটিই কারণ- বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলে এই নামের একটি ‘ক্ষেপণাস্ত্র’ আছে! আগামী অক্টোবরে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ উপলক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে ভুটানে গেছে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল।

উদ্দেশ্য স্বাগতিক ভুটানের বিপক্ষে দুটি ফিফা আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলা। বুধবার থিম্পুর চাংলিমিথাং স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচে বড় জয়ে শুভসূচনা করেছে বাংলার বাঘিনীরা। তারা ৫-১ গোলে হারায় ভুটানকে। যদিও প্রথমার্ধে ০-১ গোলে পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। ফলে তখন আশঙ্কা হচ্ছিল আগের চারবারে মোকাবিলায় শতভাগ জয়ের মুখ দেখা লাল-সবুজ বাহিনী আবার না ভুটানের কাছে প্রথমবারের মতো হেরে লজ্জার সাগরে নিপতিত হয়!

কিন্তু এমনটা হয়নি। দ্বিতীয়ার্ধে দাপটের সঙ্গে খেলে একে একে হালি চারেকেরও বেশি গোল করে বড় জয়ই কুড়িয়ে নেয় পিটার বাটলারের শিষ্যারা। দ্বিতীয়ার্ধে ৫ মিনিটের মধ্যে তিন গোল করে ফেলে বাংলাদেশ। ফরোয়ার্ড সাগরিকা ৪৯, ৭৬ ও ৯০ মিনিটে একাই করেন তিনটি গোল। দলের জয়ের বড় ভূমিকা ছিল তারই।
বাংলাদেশের ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলারের এটি ছিল প্রথম জয় (এর আগে ঢাকায় চাইনিজ তাইপের বিরুদ্ধে কোচের দায়িত্ব নিয়ে টানা দুই ম্যাচেই হেরেছিলেন)। এ ছাড়া প্রথমবার ভুটানে গিয়ে ভুটানের বিপক্ষে জয় কুড়িয়ে নিল বাংলাদেশ। আর এই দুই ‘প্রথম’-এর সঙ্গে যোগ হলো সিনিয়র দলে সাগরিকার প্রথম গোল ও প্রথম হ্যাটট্রিকের সুখস্মৃতি ও গৌরব।
গত ফেব্রয়ারিতে এই সাগরিকারই প্রশংসনীয় নৈপুণ্যে কমলাপুর স্টেডিয়ামে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাটিও জিতেছিল বাংলাদেশ। ৪ গোল করে হয়েছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা ও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়। 
অথচ ঠাকুরগাঁওয়ের লাজুক এই মেয়েটির ফুটবলে আসারই কথা ছিল না। বাবা লিটন আলী দরিদ্র এক চায়ের দোকানদার। তিনি ও তার স্ত্রী চাইতেন না ফুটবল খেলুক সাগরিকা। কেননা, গ্রামের লোকজনও ফুটবল খেলাকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখত। কিন্তু সাগরিকার এক খালার জেদ ও ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক তাজুল ইসলামের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সাগরিকা শেষ পর্যন্ত ফুটবলের পথেই হাঁটতে সক্ষম হন। দুর্দান্ত ফুটবল খেলে মা-বাবার ভুল ভেঙে দেন সাগরিকা। সমুচিত শিক্ষা দেন গ্রামবাসীদেরও। লজ্জিত গ্রামবাসীরা এখন সাগরিকার খেলা দেখে বরং গর্ব করে।

দারিদ্র্যের কশাঘাতে বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারেননি সাগরিকা। বরং এক সময় পরিবারের অন্ন জোগাতে ইটভাঁটিতে শ্রমিকের কাজও করতে হয়েছে তাকে। ২০২৩ সালের সিঙ্গাপুরে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের খেলেন সাগরিকা। করেন ১ গোল। নারী ফুটবল লিগে ভালো খেলার পুরস্কার পান লাল-সবুজ জার্সিতে খেলে (এফসি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হয়ে খেলেন, সেবার লিগে করেন ১০ গোল)। বাংলাদেশ দ্বিতীয় পর্বে উঠলে ভিয়েতনামে গিয়েও খেলেছিলেন। গত বছর কমলাপুর স্টেডিয়ামে অনূর্ধ্ব-১৭ নারী সাফে ওই আসরেও ভুটানের বিপক্ষে ১ গোল করেন সাগরিকা। 

সাবিনা খাতুনের বয়স হয়েছে। কৃষ্ণা রানী সরকার ইনজুরিতে। ফর্মে নেই তহরা, সানজিদা, শামসুন্নাহার জুনিয়ররা। ফলে স্ট্রাইকিং জোনে এখনই দলের ভরসার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন সাগরিকা। ফর্মের ধারাবাহিকতা থাকলে আগামীতে হয়তো জাতীয় দলের টপ গোলস্কোরার তিনিই হবেন।

×