ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১

দীর্ঘ অপেক্ষা আর পরিকল্পনার ফল

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:৪৬, ৩ জুলাই ২০২৪

দীর্ঘ অপেক্ষা আর পরিকল্পনার ফল

ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের তিন কারিগর বিরাট কোহলি, কোচ রাহুল দ্রাবিড় (মাঝে) ও রোহিত শর্মা (ডানে)

‘ঘরে বাঘ, বাইরে বিড়াল’ একটা সময় ক্রিকেটে উপমহাদেশের দলগুলো নিয়ে এটা ছিল কমন উক্তি। ১৯৮৩, ১৯৯২, ২০০৭; কপিল দেব-ইমরান খান-মহেন্দ্র সিং ধোনি বিদেশ থেকে বিশ্বকাপ নিয়ে ফেরার পরও সেই ধারণা বদলায়নি। কারণ দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলতে দেশের বাইরে গেলেই ক্রমাগত মুখ থুবড়ে পড়ছে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ। ব্যর্থতার সেই অতীত বদলানোর প্রথম পরিকল্পনাটা হাতে নেয় ভারত।

গত এক দশকে আমূল বদলে ফেলা হয় দেশটির ঘরোয়া ক্রিকেটের প্ল্যাটফর্ম, একচ্ছত্র স্পিন-ট্র্যাক থেকে বেরিয়ে স্পোর্টিং করা হয় উইকেট। মেলবোর্ন, লর্ডস, কেপটাউনের মতো ইডেনের পিচেও সাফল্য পেতে শুরু করে পেসাররা। মাঠের বাইরে বিরাট কোহলি, হার্দিক পান্ডিয়াদের ফিটনেসও হয়ে ওঠে অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। ফলও আসতে শুরু করে। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই আসতে থাকে সাফল্য। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট-সাফল্যে ইতিহাস গড়ে ধোনি, কোহলি, রোহিত-বাহিনী।

প্রথম দল হিসেবে একইসঙ্গে তিন ফরম্যাটের র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষস্থান দখল করে ভারত। ব্যাক টু ব্যাক টেস্টের ফাইনাল, ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালÑ সবই হচ্ছিল। হচ্ছিল না কেবল শিরোপা পুনরুদ্ধার। অবশেষে সতেরো বছর পর ক্রিকেটপাগল দেড়শ কোটির দেশে ফিরল টি২০ বিশ্বকাপের ট্রফি, সেটিও বিদেশ থেকে!
প্রতিটি বছরে, প্রতিটি মৌসুমে, প্রতিটি টুর্নামেন্টে পরিকল্পনা তো ছিলই, তার সঙ্গে এবারের পরিকল্পনায় বিশেষ মাত্রা যোগ করে ভারত। ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে দেশের বাইরে টুর্নামেন্ট খেলতে যায় চার-চারজন স্পিনার নিয়ে! যুক্তরাষ্ট্রে ‘ড্রপ ইন পিচে’ বাজিমাত করেন পেসার জাসপ্রিত বুমরাহ, আর্শদীপ সিং, মোহাম্মদ সিরাজ, হার্দিক পান্ডিয়া, সুপার এইটে এসে সেই উৎসবে যোগ দেন চায়নাম্যান কুলদীপ যাদব, দুই স্পিনিং-অলরাউন্ডার রবীন্দ্র জাদেজা আর অক্ষর প্যাটেল তো ছিলেনই।

ও হ্যাঁ বেঞ্চে কিন্তু যুবেন্দ্র চাহালও ছিলেন! যদিও তাকে গোটা আসরে একটি ম্যাচেও খেলানো হয়নি। বিশ্বকাপের আগেই রোহিত বলছিলেন, ‘আমি দলে চারজন স্পিনার চেয়েছিলাম। কারণটা আমি এখন বলব না।’ যে ৩ স্পিনার খেলেছেন তারা ১৯ উইকেট শিকার করেছেন। এতেই পরিকল্পনাটা পরিষ্কার। গ্রুপ পর্বে কোনো ম্যাচেই খেলানো হয়নি কুলদীপকে- খেলেছেন জাদেজা। সুপার এইট পর্ব থেকে তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজে এসে খেলতে শুরু করেই ম্যাজিক দেখিয়েছেন। ৪ ম্যাচে ১০ উইকেট নিয়েছেন তিনি।

ফাইনাল ব্যতীত কোনো ম্যাচেই তার বিরুদ্ধে সহজে রান করতে পারেননি কোনো ব্যাটার। অক্ষর ৭ ম্যাচ খেলে নিয়েছেন ৮ উইকেট। তবে জাদেজা ফর্মে নেই। তিনি একটি মাত্র উইকেট নিতে পেরেছেন। কিন্তু রান দেননি। ফলে ব্যাটারদের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। সেটার ফল পেয়েছেন বাকিরা। ৪ স্পিনার নেওয়াতেই রিঙ্কুর জায়গা হয়নি মূল স্কোয়াডে। 
রোহিতের পক্ষে সৌরভ গাঙ্গুলী দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘দলে চার স্পিনার নেওয়ার সিদ্ধান্ত একদম ঠিক আছে। ওয়েস্ট-ইন্ডিজে খেলা হবে। ওখানে স্পিনাররা সাহায্য পায়। ওখানকার পিচ একটু ধীর হয়। বল নিচু হয়ে যায়। মাঠগুলো বড়। স্পিনাররা গুরুত্বপূর্ণ হবে। বিশ^কাপ শেষে এখন পুরো ভারত একবাক্যে বলছে- রোহিতের পরিকল্পনাই ঠিক।’ মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে ২০০৭ সালে প্রথম টি২০ বিশ্বকাপ জয় করে ভারত, ২০১১ সালে ২৮ বছর পর পুনরুদ্ধার করে ওয়ানডের শিরোপা।

অবসান হয় সতেরো বছরের অপেক্ষার, ‘২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল থেকে বিদায়, গত বছর কয়েক মাসের ব্যবধানে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ও ওয়ানডে বিশ্বকাপে ফাইনালে হারের বেদনা, সব পেরিয়ে আরেকবার শিরোপা মঞ্চে নিজেদের তুলে এনেছিলেন তারা। অবশেষে এবার তারা পারলেন। তিনি পারলেন। প্রতিপক্ষের মুঠো থেকে জয় বের করে এনে নিজেদের রাঙালেন নেই কাক্সিক্ষত সাফল্যের আলোয়।

ম্যাচ শেষে ভারতীয় অধিনায়ক বললেন, এই শিরোপা তাদের প্রাপ্যই ছিল। ‘আমি বিশ্বাস করি, যা (ভাগ্যে) লেখা আছে, তা হবেই। আমার মনে হয়, এটা লেখা হয়েই ছিল। তবে অবশ্যই, ম্যাচ শেষ হওয়ার আগে তো আর জানা যায় না যে, এটাই আছে লেখা। খেলাটাই এমন। নইলে তো আমরা অনায়াসেই এসে বলতে পারি যে, এটা ভাগ্যেই ছিল।’ বলছিলেন রোহিত। ক্যারিয়ারের শুরুতেই তিনি টি২০ বিশ্বকাপ জিতেছেন। ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের অংশ হতে পারেননি। তবে ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের স্বাদ পেয়েছেন।

দুটি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলেছেন, গত বছর ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালও। ব্যক্তিগত অর্জন-রেকর্ডের তো অভাব নেই। তবে তার নিজের কাছে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত এটিই, ‘আমি বলতেই পারি, সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত এটিই। একমাত্র কারণ, কতটা মরিয়া হয়ে এটা জিততে চাইছিলাম। এত এত রান, এত বছর ধরে এত রান যা করেছি, সেসবেরও মূল্য আছে। তবে পরিসংখ্যান ও এসব নিয়ে আমার ভাবনা খুব বেশি নেই।

ভারতের হয়ে ম্যাচ জয়, দেশের হয়ে ট্রফি জয়ের দিকেই সবসময় তাকিয়ে থাকি।’ গত ওয়ানডে বিশ্বকাপ দিয়েই মূলত বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়ে গিয়েছিল কোচ রাহুল দ্রাবিড়ের। তবে বোর্ডের একান্ত অনুরোধে এই গ্রেট দায়িত্বে রয়ে যান। মেয়াদ যদিও তখন চূড়ান্ত হয়নি। পরে ফেব্রুয়ারিতে জানানো হয়, এই টি২০ বিশ্বকাপ পর্যন্ত থাকবেন তিনি। তাকে ধরে রাখতে বোর্ডের প্রচেষ্টা ছিল এরপরও।  

কিন্তু বিশ্বকাপের শুরুতেই দ্রাবিড় স্পষ্ট জানিয়ে দেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ব্যস্ততায় আর নিজেকে রাখতে চাইছেন না তিনি। তাই টুর্নামেন্টে ভারতের ফল যা-ই হোক না কেন, এরপর আর জাতীয় দলের দায়িত্বে থাকবেন না। আমি মনে করি, আমাদের যে কারও চেয়ে ট্রফিটি তারই (দ্রাবিড়) বেশি প্রাপ্য। 
গত ২০-২৫ বছর ধরে ভারতের ক্রিকেটের জন্য তিনি যা করেছেন, আমার মতে, তার অর্জনের ঝুলিতে এটিই (বিশ্বকাপ ট্রফি) শুধু বাকি ছিল। পুরো দলের পক্ষ থেকে তার জন্য এটি সত্যিই করতে পারায় আমি খুবই খুশি। আপনারা দেখেছেন, বিশ্বকাপ হাতে কতটা গর্বিত ও উচ্ছ্বসিত ছিলেন তিনি। এই উপলক্ষের জন্য সত্যিই কৃতজ্ঞ।’ কোচ রাহুলকে নিয়ে বলছিলেন রোহিত।

×