ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০২ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১

টি২০ থেকে কোহলির অবসর

রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে চ্যাম্পিয়ন ভারত

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ২৩:৫৪, ২৯ জুন ২০২৪; আপডেট: ১০:৩৮, ৩০ জুন ২০২৪

রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে চ্যাম্পিয়ন ভারত

বার্বাডোজে শনিবার দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৭ রানে হারিয়ে টি২০ বিশ্বকাপের ট্রফি নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেটারদের বাঁধভাঙা উল্লাস

কে বলবে সাত সমুদ্দুর তের নদীর ওপারে বার্বাডোজ! ব্রিজটাউনের কেনসিংটন ওভালে শনিবার স্থানীয় সময় সকাল থেকেই ভারতীয় সমর্থকদের সে কী উন্মাদনা। নীল জার্সি আর চার-ছক্কার প্ল্যাকার্ডে ভরা গ্যালারি। মাঠের বাইরেও একই চিত্র। ক্যারিবীয়দের আয়োজন তাতে বাড়তি মাত্রা যোগ করে। ছিল ব্যতিক্রম ঢংয়ের স্থানীয় নৃত্য।

ক্রিকেটের ভাগ্যবিধাতাও যেন সেই উৎসবে যোগ দিলেন! শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে ৭ রানের নাটকীয় জয়ে ১৭ বছর পর টি২০ বিশ্বকাপের শিরোপা পুনরুদ্ধার করল রোহিত শর্মার ভারত। উৎসবমুখর পরিবেশে টস ভাগ্যও হাসে রোহিতের হয়ে, জীবনের শেষ ইনিংসে হাসে বড় তারকা বিরাট কোহলির ব্যাট। আসরজুড়ে নিষ্প্রভ এ সুপারস্টার ফাইনালের মঞ্চে উপহার দেন ৭৬ রানের ঝলমলে এক ইনিংস। ২০ ওভারে ৭ উইকেটে ১৭৬ রানের ‘চ্যালেঞ্জিং’ স্কোর গড়ে ভারত।

জবাবে পরতে পরতে রং বদলানো ম্যাচে ৮ উইকেটে ১৬৯ রানে থামে দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রথমবার ফাইনালে উঠে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পোড়ে এইডেন মার্করামের দল। ম্যাচসেরার পুরস্কার হাতে কোহলি শিরোপজয়ের মঞ্চে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক টি২০ থেকে অবসরের ঘোষণা দেন।   
জাসপ্রিত বুমরাহ ও আর্শদীপ সিংয়ের দূর্ধর্ষ পেস আক্রমণের মুখে ৩ ওভারের মধ্যে ২ উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকা। ১ চারে ৪ রান করে বুমরাহর বলে বোল্ড রিজা হেনড্রিকস। ঠিক ১ চারে ৪ রান করা অধিনায়ক মার্করামকে তুলে নেন আর্শদীপ। ডি কক ও ত্রিস্তিয়ান স্টাবস মিলে দলকে পথে ফেরান। ৩১ বলে ৪ চার ও ১ ছক্কায় ৩৯ রান করে আউট হন ডি কক। তৃতীয় উইকেট জুটিতে ৩৮ বলে ৫৮ রান যোগ করেন দুজনে। ১০ ওভারে ১ উইকেটে ৮৩ রান তুলে নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা।

ইনিংসের মধ্যপথে ভারতের সংগ্রহ যেখানে ছিল ৩ উইকেটে ৭৫। ২১ বলে ৩১ রান করে স্টাপস আউট হওয়ার পর ক্লাসেন জুটি গড়েন ডি ককের সঙ্গে। আসে ২৩ বলে ২৩ রান। ক্লাসেন-ডেভিড মিলার মিলে মাত্র ২২ বলে ৪৫ রানের জুটিতে দলকে জয়ের খুব কাছে নিয়ে যান। ৫ উইকেট হাতে রেখে শেষ ৩ ওভারে, অর্থাৎ ১৮ বলে প্রয়োজন ছিল মাত্র ২২ রান। কিন্তু বুমরাহ, আর্শদীপ ও হার্দিক পান্ডিয়া মিলে ভারতকে এনে দেন অবিস্মরণীয় এক জয়।

১৮তম ওভারে মাত্র ২ রান দিয়ে মার্কো জানসেনকে (২) পরিষ্কার বোল্ড করেন বুমরাহ। ১৯তম ওভারে আর্শদীপ দেন ৪ রান। শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৬ রান। ৮ রান দিয়ে ২ উইকেট তুলে নেন হার্দিক! বিফলে যায় ২ চার ও ৫ ছক্কায় সাজানো ক্লাসেনের ২৭ বলে ৫২ রানের ঝড়ো ইনিংস। ১৭৭ রান করে জিততে হলে টি২০ বিশ্বকাপের ফাইনালে রান চেজের নতুন রেকর্ড গড়তে হতো প্রোটিয়াদের। ২০২১ আসরে নিউজিল্যান্ডের রান তাড়ায় ১৭৩ করে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া।

ওয়ানডে ও টি২০ মিলিয়ে সাত-সাতবার সেমি থেকে বিদায় নেওয়া দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম ফাইনালে উঠলেও শিরোপার স্বাদ পেল না। অসাধারণ বোলিংয়ে ২০ রান দিয়ে  পান্ডিয়া নিয়েছেন ৩ উইকেট, ১৮ রান দিয়ে বুমরাহ নিয়েছেন ২ উইকেট, ২০ রানে আর্শদীপেরও শিকার ২। 
এর আগে টস জিতে দক্ষিণ আফ্রিকান পেসার মার্কো জানসেনের প্রথম ওভারেই ৩টি চার হাঁকান আসরজুড়ে নিজেকে হারিয়ে খোঁজা বিরাট কোহলি। প্রথম ওভারে দলের ভান্ডারে যোগ হয় ১৫ রান। এর পরই বিপাকে পড়ে দশ বছর পর ফাইনালে ওঠা ভারত। পঞ্চম ওভারে স্কোর বোর্ডে ৩৪ রান যোগ করতে হারায় ৩ উইকেট। একে একে সাজঘরে ফেরেন রোহিত শর্মা, ঋষভ পন্থ ও সূর্যকুমার যাদব।

এ রিপোর্ট লেখার সময় ১০ ওভারে ৩ উইকেটে ভারতের রান ছিল ৭৫। কাট করে চার, রিভার্স সুইপে চারÑ দুটিই একই অঞ্চল ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে। দ্বিতীয় ওভারে  কেশব মহারাজকে এভাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন রোহিত। ৫ বলে ২ চারে ৯ রান করে চতুর্থ বলেই সাজঘরে ফেরেন ভারত অধিনায়ক! পা-বাড়িয়ে সুইপ করেছিলেন, কিন্তু সরাসরি ক্যাচ চলে যায় স্কয়ার লেগে থাকা হেনরিক ক্লাসেনের হাতে।

দুটি চারের পরও একটু গতি কমিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়ার মতো সাহসী বোলিং করেছেন মহারাজ, পুরস্কারও মিলেছে সেটির এবং  শেষ বলে আউট ঋষভ পন্থও! তিনিও সুইপ করেছিলেন, ক্যাচ ওঠে ওপরে। যেটি  নেন কুইন্টন ডি কক। অন্তত দক্ষিণ আফ্রিকানরা ভেবেছেন  তেমনই।  টেলিভিশন আম্পায়ারের কাছে যাওয়ার পর নিশ্চিত হয়েছে  সেটিই। ব্যাটের একেবারে  গোড়ায়  লেগেই উঠেছিল বল। ৩ বলের মধ্যে ২ উইকেট  নেই ভারতের। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভিত গড়ে দিয়েছিলেন  রোহিত ও সূর্যকুমার।  রোহিত ফিরেছেন আগেই, এবার ফেরেন সূর্যকুমারও, ৪ বলে ৩ রান করে।

কাগিসো রাবাদার লেংথ বলে ঘুরিয়ে খেলেছিলেন। ক্যাচ গেছে ডিপ স্কয়ার  লেগে। নিজের বাঁদিকে গিয়ে ভালো ক্যাচ নিয়েছেন হেনরিখ ক্লাসেন। রাবাদা শুরু  থেকেই করেছেন লেংথে।  শেষ বলে ঘুরিয়ে  খেলতে গিয়ে মিড অনে ক্যাচও তুলে দিয়েছেন সূর্যকুমার।
ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পাওয়া অক্ষর প্যাটেল ১ চার ও ৪ ছক্কায় খেলেন ৪৭ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। ১৬ বলে ৩ চার ও ১ ছক্কায় শিভম দূবের ব্যাট থেকে আসে ২৭ রান। নরকিয়া ছক্কার  চেষ্টায়  ডেভিড মিলারের হাতে লং-অফে ধরা পড়েন দুবে। কোহলির কথা আলাদা করে না বললেই নয়। চলতি বিশ্বকাপে নিজেকে খুঁজে ফিরছিলেন বড় তারকা। আগের ৭ ম্যাচের একটিও ফিফটি করতে পারেননি।

বিবর্ণ আসরের একেবারে  শেষ ম্যাচে এসে পঞ্চাশের  দেখা  পেলেন ভারতীয় ব্যাটিং  গ্রেট। ফাইনালে এসে দলের ভীষণ প্রয়োজনের সময় নিজেকে  মেলে ধরলেন কোহলি। ইনিংস শুরু করতে  নেমে এক প্রান্ত আগলে  রেখে ৪৮ বলে ফিফটি করেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক টি২০তে এটি তার ৩৮তম ফিফটি। আগের ৭ ম্যাচে  কেবল দুইবার দুই অঙ্ক ছুঁতে পারেন তিনি। তার মধ্যে একবার যেতে পারেননি চল্লিশের ঘরে। দুইবার আউট হয়েছেন তিনি রানের খাতা খোলার আগে।

ফিফটির পর দ্রুত রান  তোলায় মনোযোগ দেন  কোহলি। দারুণ কিছু শটে কয়েকটি চার-ছক্কাও মারেন তিনি। কিন্তু ইনিংস  শেষ করে ফিরতে পারেননি। বিদায় নেন ছক্কার  চেষ্টায়। ১৯তম ওভারে মার্কো ইয়ানসেনকে একটি চার ও ছক্কা মারেন  কোহলি। ওভারের পঞ্চম বলটি খানিকটা  টেনে দেন দক্ষিণ আফ্রিকান  পেসার। সজোরে মেরেও বাউন্ডারি পার করতে পারেননি তিনি। ধরা পড়েন ওয়াইড লং-অন বাউন্ডারিতে।

শেষ হয় ৫৯ বলে ৬ চার ও ২ ছক্কায় সাজানো ৭৬ রানের ইনিংস। শেষ ১০ ওভারে আসে ১০১ রান। ৭ উইকেটে ১৭৬ রানে থামে ভারত। প্রোটিয়াদের হয়ে ২টি করে উইকেট নেন পেসার এনরিখ নরকিয়া ও স্পিনার কেশভ মহারাজ। একটি করে শিকার মার্কো জানসেন ও কাগিসো রাবাদা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ডের পর দুটি টি২০ বিশ্বকাপ  জেতা দল এখন ভারত। একটি করে শিরোপা আছে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়ার। মহেন্দ্র সিং ধোনীর নেতৃত্বে ২০০৭ প্রথম টি২০ বিশ্বকাপ জিতে বাজিমাত করেছিল ভারত। আর ২০০৯ সালে দ্বিতীয় টি২০ বিশ্বকাপের সেমিতে পাকিস্তানের কাছে হারে প্রোটিয়ারা। ২০১৪ পঞ্চম আসরের সেমিতে হারে ভারতের কাছে। সেবার ফাইনালে উঠে শ্রীলঙ্কার কাছে হারে ভারত।

এবারের রোহিত-কোহিলদের সেটিই ছিল শেষ ফাইনাল। এরপর  ২০১৬ ও সর্বশেষ ২০২২Ñ দুই আসরের সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছিল ভারত। এছাড়া ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের সেমিতে নিউজিল্যান্ডের কাছে এবং গত বছর ঘরের মাঠে ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হারে মোড়ল দেশটি। সতের বছর পর টি২০ বিশ্বকাপ পুনরুদ্ধার করলেন রোহিত শর্মা। আলো ছড়ালেন কোহলি। পুরস্কার নিতে এসে বললেন,‘এটা আমার শেষ টি২০ বিশ্বকাপ এবং এটি আমরা অর্জন করতে চেয়েছি।

একদিন আপনার মনে হবে রানই করতে পারছেন না, তারপরে কিছু ঘটবে। ঈশ্বর মহান। এবং যে দিন গুরুত্বপূর্ণ, আমি দলের কাজটি করেছি। এখন অথবা কখনোই নয়-ভারতের হয়ে আমার শেষ টি-টোয়েন্টি—সবটুকু কাজে লাগাতে চেয়েছি।’ কোহলি আরও বলেন,‘এখন পরবর্তী প্রজন্মের এগিয়ে আসার পালা। কোহলি বলেন, ‘ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরতে চেয়েছি। পরিস্থিতিকে সম্মান জানাতে চেয়েছি জোর করার চেয়ে। এটা (অবসর) “ওপেন সিক্রেট” ছিল, এখন পরবর্তী প্রজন্মের দায়িত্ব নেওয়ার পালা।

দুর্দান্ত কিছু খেলোয়াড় দলকে এগিয়ে নেবে এবং পতাকা উঁচু করে ধরবে।’ ২০১০ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এ সংস্করণে অবসর নেওয়া কোহলি ক্যারিয়ারে ১২৫ ম্যাচ খেলে করেছেন ৪১৮৮ রান। রোহিত শর্মার পর এ সংস্করণে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক তিনি। ৪৮.৬৯ গড় ও ১৩৭.০৪ স্ট্রাইক রেটে ব্যাটিং করা কোহলি ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ৫০টি ম্যাচে।  
সংক্ষিপ্ত স্কোর: ভারত : ১৭৬/৭ (২০ ওভার; রোহিত ৯, কোহলি ৭৬, পন্থ ০, সূর্যকুমার ৩, অক্ষর ৪৭, দুবে ২৭, পান্ডিয়া ৫, জাদেজা ২; জানসেন ১/৪৯, মহারাজ ২/২৩, রাবাদা ১/৩৬, নরকিয়া ২/২৬)
দক্ষিণ আফ্রিকা: ১৬৯/৮ (২০ ওভার; হেনড্রিকস ৪, ডি কক ৩৯, মার্করাম ৪, স্টাবস ৩১, ক্লসেন ৫২, মিলার ২১, জানসেন ২, মহারাজ ২*, রাবাদা ৪, নরকিয়া ১*; আর্শদীপ ২/২০, বুমরাহ ২/১৮, আকসার ১/৪৯, পান্ডিয়া ৩/২০)
ফল: ভারত ৭ রানে জয়ী
ম্যাচসেরা: বিরাট কোহলি (ভারত)

×