
এখন বিশ্বকাপের ম্যাচ জয়ের উৎসবই যেন ব্রাজিল দলের নিত্য সঙ্গী
সুন্দর ফুটবলের ধারক ব্রাজিল। ফুটবল অভিধানে শব্দটি পরিচিত ‘জোগো বনিতো’ নামে। একটা সময় বলা হতো, ফুটবলই ব্রাজিলিয়ানদের প্রথম প্রেম। সেলেসাও ফুটবলের সাম্বার ছন্দে বিমোহিত হননি এমন ফুটবলপ্রেমী খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর! সাম্বা নৃত্যের সঙ্গে শৈল্পিক ফুটবলের সংমিশ্রণ ব্রাজিলকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়।
ফুটবলকেও যে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় তা গোটা দুনিয়াকেই দেখিয়ে দিয়েছে সেলেসাওরা। শিল্পের ফুটবল এবং ব্রাজিল যেন একে অপরের পরিপূরক। শুধু স্কিল আর নান্দনিকতার দিক থেকেই যে ব্রাজিল এমন তা নয়? তাদের অর্জনের তালিকাটাও বেশ লম্বা!
এতোটাই যা আজ পর্যন্ত অন্যসব দলের কাছে স্বপ্নের মতোই। এখন পর্যন্ত ব্রাজিলই একমাত্র দল, যারা সব বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছে। সর্বোচ্চ পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নও তারা। সেইসঙ্গে দখল করে আছে সব বিশ্বরেকর্ডের বড় অংশও।
তবে এর সবই এখন অতীত ইতিহাস! কেননা, পেলে-গারিঞ্চা কিংবা রোনাল্ডিনহোর দেশটি সর্বশেষ বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় ২০০২ সালে। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময়। শুধু তাই নয়? ২০০৭ সালের পর নেই কোনো ব্যালন ডি’অর জয়ী ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার।
রিকার্ডো কাকার পর এই অর্জনের প্রতিনিধি হতে পারেননি সেলেসাওদের আর কোনো ফুটবলার। বিশ্বফুটবলে সাফল্যের শীর্ষে থাকা ব্রাজিল এখন সংগ্রাম করছে ২০২৬ বিশ্বকাপের টিকিট কাটার জন্য! প্রথম ৬ ম্যাচ শেষে মাত্র ৭ পয়েন্ট নিয়ে এই মুহূর্তে লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের ছয় নম্বরে অবস্থান করছে তারা।
তাতেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, কতটা খারাপ সময়ে যাচ্ছে ব্রাজিল ফুটবলের বর্তমান অবস্থা! ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ব্রাজিল কিংবদন্তি পেলে। মৃত্যুর কিছুদিন আগেই দেখেছেন কীভাবে কাতার বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গিয়েছিল তার দেশ। পেলে মারা যাওয়ার পর আরও ছন্নছাড়া হয়ে গেছে সেলেসাও ফুটবল।
বিশ্বকাপের ব্যর্থতা কাঁধে নিয়ে কোচের দায়িত্ব ছেড়েছিলেন তিতে। এরপর এখন পর্যন্ত স্থায়ী কোনো কোচই নিয়োগ দিতে পারেনি ব্রাজিল। পাঁচবারের বিশ্বকাপজয়ী দলটি এখন যার তার কাছে হেরে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্রাজিলের ফুটবল যে এখন চরম দুরবস্থায় তা স্বীকার করেন পেলের বড় ছেলে এদিনিও।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘শীর্ষ মানের ফুটবলার তৈরির ক্ষেত্রে আমরা এখন একেবারেই তলানির দিকে। প্রকৃতপক্ষে আমরা পতন দেখছি, এখনো আমাদের ভালো খেলোয়াড় আছে। তবে আগে আমাদের খেলোয়াড়দের মান এখনকার চেয়েও বেশি ভালো ছিল।’
শুধু দেশটির জাতীয় দল নয়, ব্রাজিলের ক্লাব ফুটবলেও চলছে এখন দৈন্যদশা। এক সময়ে সাড়া জাগানো পেলে-নেইমারদের প্রিয় ক্লাব সান্তোসের অবস্থাও যে করুণ। ১১১ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম দ্বিতীয় বিভাগে নেমে গেছে সান্তোস!
কিন্তু কেন? একটা সময় গোটা দুনিয়াজুড়ে ফুটবলের দেশ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া সেলেসাও ফুটবলের কেন এই হাল? এর পেছনে অবশ্য একক কোনো কারণ দায়ী নয় বরং অনেক কারণেই ব্রাজিল ফুটবলে দীর্ঘ সময়ের শিরোপা-খরা। এর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো, ব্রাজিলের অনেক মাঠই এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাছাড়া, আগের মতো রাস্তা-ঘাটেও আর তেমনভাবে ছেলে-মেয়েদের খেলতে দেখা যায় না।
ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার জিকো-রোমারিওদের উত্থানই ঘটেছিল রাস্তায় ফুটবল খেলে। কিন্তু এখন আর সেইসব কোনো গল্পই চোখে পড়ে না আর। ব্রাজিলের বিশাল সংখ্যক ফুটবলার প্রতিনিধিত্ব করেন ইউরোপিয়ান ফুটবলে এটা সত্য। কিন্তু সেখান থেকে সত্যিকারের তারকা হয়ে জ্বলে উঠতে পারছেন না তারা। পেলে-রোনাল্ডো-কাকাদের পর দারুণ সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন নেইমার।
কিন্তু সেই নেইমারও ধীরে ধীরে নিভে গেছেন। ভক্ত-অনুরাগীদের বিশ্বকাপ উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবে এই মুহূর্তে ব্রাজিলকে নতুন করে আশা দেখাচ্ছেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র এবং নতুন সেনসেশন এনড্রিক। দেশটির এই দুই তারকাই এখন স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
দেশটির ফুটবল খেলার স্টাইলেও পরিবর্তন এসেছে। নিজস্ব সৃজনশীলতার চেয়ে এখন খেলোয়াড়দের মনোযোগ ভিন্ন কিছুতে। ফ্ল্যামেঙ্গোর যুব একাডেমির কোচ ভিক্টোর হুগো দ্য সিলভা বলেন, ‘আমাদের কৌশলগুলো এখন মার খেয়ে যাচ্ছে। ফুটবলের স্টাইলেও ব্যাপক পরিবর্তন এসে গেছে।
এটা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি যান্ত্রিক হয়ে গেছে।’ মোবাইল ফোন কিংবা টেলিভিশনের পর্দাও ব্রাজিলে ফুটবলার তৈরির ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ব্রাজিলের জনসংখ্যা ২০৩ মিলিয়ন। কিন্তু তার চেয়েও অধিকসংখ্যক মোবাইল ফোন রয়েছে দেশটিতে। এছাড়াও এক গবেষণায় দেখা গেছে, বয়সে ৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ছেলে মেয়ের তিন ভাগের এক ভাগই অত্যাধিক মোটা!
এছাড়া, এই মুহূর্তে বিশ্বে ফুটবল রপ্তানিতে শীর্ষ দেশ ব্রাজিল। কিন্তু সেই তুলনায় অর্থ আমদানি করতে পারছে না তারা। ফিফার এক সূত্রমতে, গত বছর ২৩৭৫ খেলোয়াড়ের ট্রান্সফার ফি বাবদ ৯৩৫.৩ মিলিয়ন ইউএস ডলার আমদানি করে ব্রাজিল। যা ২০১৮ সালের চেয়েও প্রায় ২০ শতাংশ কম!
ব্রাজিলের অন্যতম সেরা তারকা নেইমার এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন যে, জাতীয় দলকে নিয়ে তাদের দেশেই এখন আর খুব একটা মাতামাতি হয় না। তার ভাষ্যমতে, ‘এখন সেলেসাও এবং সমর্থকদের মাঝে বিশাল দূরত্ব তৈরি হয়েছে। আমি জানি না কেন এমন হলো; কিন্তু আমাদের খেলা নিয়ে এখন খুব আলোচনা হয় না। এটা দুঃখজনক যে, আমরা এমন একটা প্রজন্ম রেখে যাচ্ছি যারা ব্রাজিল জাতীয় দলের গুরুত্ব বুঝে না।’
তারপরও দীর্ঘ সময়ের শিরোপা-খরা ঘুচিয়ে আবারও বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন বুনছে ব্রাজিল। রোনালদো, রিভালদো আর রোনালদিনহোই ছিলেন সেলেসাওদের সর্বশেষ বিশ্বকাপের মূল তিন সারথি। সাম্বার ছন্দের শেষ সুরটা তাদের বদৌলতেই শুনেছিল ফুটবলবিশ্ব। এরপর সেলেসাওদের দুর্গে অনেকেই সেনানী হয়ে এলেও কেউ আর ফুটবলকে সেভাবে নাচাতে পারেননি।
নেইমারকে নিয়ে আশা দেখলেও বেরসিক চোট তাকে পিছিয়ে দিয়েছে কয়েক যুগ। এবার নতুন করে স্বপ্ন বুনা ব্রাজিলের আশার প্রতীক এনড্রিক। ১৭ বছরের এই তরুণকেই ভাবা হচ্ছে আগামীর তারকা। এরই মধ্যে দুটি প্রীতি ম্যাচে গোল করে নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন রিয়াল তারকা।
তার সঙ্গে ব্রাজিলের আক্রমণভাগের পুরনো দুই সৈনিক হিসেবে রয়েছেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র এবং রড্রিগো। এই তিন তারকাই ব্রাজিলের ২০২৬ বিশ্বকাপের অন্যতম ভরসার নাম। ফুটবলবোদ্ধারা বলছেন, রোনালদো-রিভালদো-রোনালদিনহোর পর এই ত্রয়ী-ই হতে পারেন সময়ের অন্যতম সেরা।
এরই মধ্যে ভিনিসিয়াস ও রড্রিগো অনেকটাই পরিণত হয়ে উঠেছেন। তাদের সঙ্গে এই জুলাইয়ে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেবেন এনড্রিক। এই তিন তারকাকে নিয়ে কোপা আমেরিকা জয়ের স্বপ্নেও বিভোর সেলেসাওরা।