চতুর্থ দিনে উইকেট লাভের পর তাইজুলের উল্লাস
জয়ের তীব্র সুবাসে ম ম করছে লাক্কাতুরা। চা বাগানের মাঝে সবুজ গালিচার নয়নাভিরাম সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আজ অতিপ্রাকৃত কিছু না ঘটলে অবিস্মরণীয় একটি জয় পেতে চলেছে বাংলাদেশ দল। নিউজিল্যান্ডের মতো শক্তিধর প্রতিপক্ষকে আরেকবার টেস্টে হারানোর মোক্ষম সুযোগ। সেজন্য মাত্র ৩ উইকেট নিতে হবে কিউইরা টার্গেটে পৌঁছার আগেই। সেই লক্ষ্যটা লাক্কাতুরা টিলার চেয়ে অনেক উঁচুতে পৌঁছে হিমালয়সম হয়ে গেছে ইতোমধ্যে সফরকারীদের জন্য। কারণ সিরিজের চলমান এই প্রথম টেস্টের চতুর্থ দিন দারুণ বোলিং নৈপুণ্যে বাংলাদেশকে ৩৩৮ রানে দ্বিতীয় ইনিংসে গুটিয়ে দিয়েছে তারা। কিন্তু এরপর ৩৩২ রানের জয়ের লক্ষ্যে নেমে তাইজুল ইসলামের ঘূর্ণিজালে বিপর্যস্ত নিউজিল্যান্ড ৭ উইকেটে ১১৩ রান নিয়ে শেষ করেছে। আজ বাকি থাকা ৩ উইকেটে জিততে হলে আরও ২১৯ রান করতে হবে তাদের। তাই ম্যাচের পঞ্চম দিনের ভেঙে যাওয়া উইকেটে স্পিন শক্তিতে বলীয়ান বাংলাদেশের জন্য কাজটা যতখানি সহজ, তারচেয়েও দুরুহ নিউজিল্যান্ডের জন্য। কিন্তু অবিশ্বাস্য কিছু করার আশা ছাড়ছে না তারা, এমনটাই এজাজ প্যাটেল জানিয়েছেন।
৩ উইকেটে ২১২ রান নিয়ে সিলেট টেস্টের তৃতীয় দিনশেষেই চালকের আসনে পৌঁছে যায় বাংলাদেশ। ২০৫ রানে এগিয়ে থাকা দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত ১০৪ রানে এবং অভিজ্ঞতম ব্যাটার মুশফিকুর রহিম ৪৩ রানে তখনো ক্রিজে। তা ছাড়া উইকেটরক্ষক ব্যাটার নুরুল হাসান সোহান, শাহাদাত হোসেন দিপু ও মেহেদি হাসান মিরাজ থাকার কারণে নিশ্চিতভাবেই চতুর্থ দিন লিডটাকে অনেক বড় করার সব রসদই মজুত স্বাগতিকদের মধ্যে। কিন্তু এদিন দুর্দান্ত বোলিং করেছে কিউইরা। বিশেষ করে সফরকারী স্পিনাররা ঝলসে উঠেছেন। সেটি অবশ্য সুখকর ব্যাপারই বাংলাদেশের জন্য। অবশ্য দিনের দ্বিতীয় ওভারেই শান্ত আগের দিনের সঙ্গে মাত্র ১ রান যোগ করে ১০৫ রানে বিদায় নেন টিম সাউদির পেসে। সেখানেই শেষ পেসারদের সাফল্য। এরপর বাকি বিপর্যয় ডেকে এনেছেন স্পিনাররা। বিশেষ করে বাঁহাতি এজাজ প্যাটেল ও লেগস্পিনার ইশ সোধি বিধ্বংসী হয়ে উঠেছেন। তাদের যুগপৎ আক্রমণে অভিষিক্ত শাহাদাত ১৯ বলে ৪ বাউন্ডারিতে ১৮ রানে সোধি ও নুরুল হাসান সোহান ২৭ বলে ১০ করে গ্লেন ফিলিপসের স্পিনে সাজঘরে ফেরেন। তবে মুশফিক আগের মতোই ধৈর্য রেখে ব্যাট চালিয়ে গেছেন। তাই ক্যারিয়ারে ২৭তম ফিফটিও পেয়ে যান এবং বাংলাদেশের লিডও আড়াইশ’ পেরিয়ে যায়। কিন্তু সেই মুশফিকও ১১৬ বলে ৭ চারে ৬৭ রান করে এজাজের শিকার হন। এরপর তার বাঁহাতি স্পিনের দাপটেই ধস নেমেছে। পরবর্তী ৫টি উইকেট মাত্র ৬০ রানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে এজাজ একাই নিয়েছেন ৩টি। শুধু এককভাবে লড়াই চালিয়ে দুর্দান্ত ব্যাট করেছেন মিরাজ। তিনি ক্যারিয়ারের পঞ্চম অর্ধশতক পেয়ে যান। মিরাজ ৭৬ বলে ৫ চারে ৫০ রানে অপরাজিত থাকলেও বাকিরা হয়েছেন ব্যর্থ। তাই ৩৩৮ রানে গুটিয়ে যায় বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংস। এটি ঘরের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ দলীয় রান। উভয় ইনিংসে ৩ শতাধিক রান এই প্রথম নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করতে পেরেছে বাংলাদেশ দল। আর সেজন্যই সিলেট টেস্টে ভালো অবস্থান তাদের।
বাংলাদেশ দল ৩৩২ রানের টার্গেট দিতে পেরেছে নিউজিল্যান্ডকে। সেটি আরও অসম্ভব একটি জায়গায় পৌঁছুতে পারেনি এজাজ-সোধির দুর্দান্ত ঘূর্ণি বলে। এজাজ ১৪৮ রানে ৪টি ও সোধি ৭৪ রানে ২টি উইকেট নেন। এই উইকেটে স্পিনাররা দুর্বার হয়ে উঠবেন তা নিশ্চিত হয়েছে কিউইদের বোলিংয়ে। তাই হয়েছে। যদিও প্রথম ওভারে সাফল্য এনে দেন বাঁহাতি পেসার শরিফুল। স্পিন ট্র্যাকে পরিণত হওয়া সিলেটে তিনি নতুন বলে বেশ ভালো সুইং আদায় করে নিয়ে টম লাথামকে (০) সাজঘরে ফেরান। দ্রুতই বোলিংয়ে আনা হয় তাইজুলকে। তিনি দশম ওভারেই ফিরিয়ে দেন প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান কেন উইলিয়ামসনকে (১১)। মিরাজও সাফল্য পান দ্রুত, ফিরে যান হেনরি নিকোলস (২)। পরবর্তীতে ডেভন কনওয়ে (২২) ও টম ব্লান্ডেল (৬) তাইজুলের ঘূর্ণিতে বিপর্যস্ত হয়ে সাজঘরে ফেরেন। তাই ৬০ রানেই ৫ উইকেট খুঁইয়ে বিপাকে পড়ে নিউজিল্যান্ড। কিন্তু সেই বিপদ তাদের কাটেনি। কারণ দারুণ বোলিং করা অফস্পিনার নাঈম বেশ কিছু সুযোগ সৃষ্টি করে সফল হতে না পারলেও শেষ পর্যন্ত গ্লেন ফিলিপসকে (১২) এলবিডব্লিউ করে দেন। তাই ৮১ রানেই ৬ উইকেট হারিয়ে নিউজিল্যান্ড চতুর্থ দিনেই গুটিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় পড়ে। তবে একপ্রান্তে মাটি কামড়ে থাকেন ড্যারিল মিচেল। ইংল্যান্ড সফরে টানা ৩টি টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন তিনি গতি ও সুইংয়ের রাজ্যে। এবার সিলেটের টার্নিং উইকেটে যেখানে তাইজুল ভয়ানক হয়ে উঠেছেন সেখানেও প্রতিরোধ গড়ে দক্ষতা দেখান। কিন্তু তার সঙ্গী কাইল জেমিসন টিকতে পারেননি। ২৮ বলে ৯ রান করা জেমিসনকেও এলবিডব্লিউ করে দেন তাইজুল। এর কিছুক্ষণ পড়েই দিনের খেলায় সমাপ্তি টানা হয় আলোর স্বল্পতায়।
এখনো কিউইদের জিততে দরকার ২১৯ রান। ফ্রন্টলাইন ৬ ব্যাটার মাত্র ৮১ রানের মধ্যে সাজঘরে ফিরেছেন। এখন স্বীকৃত ব্যাটার হিসেবে শুধু মিচেল সংগ্রাম করছেন ৮৬ বলে ৫ চারে ৪৪ রানে। তার সঙ্গী সোধি ২৪ বলে ৭ রানে অপরাজিত। কিন্তু আজ পঞ্চম দিনে এই উইকেট হবে আরও কঠিন, স্পিনারদের জন্য হয়ে উঠবে স্বর্গোদ্যান। সেখানে বাকি ৩ উইকেটে কতদূর এগিয়ে যাবে কিউইরা। তাদের জন্য পরাজয় এড়ানো এখন এভারেস্ট জয়ের মতোই কঠিন। কিন্তু দিনশেষে প্রত্যয়ী এজাজ দাবি করেছেন, ‘আরও কিছু ব্যাটিং বাকি আছে। ডাজলার (ড্যারেল মিচেল) এখনো আছে, যে কিনা আজ খুব ভালো ব্যাট করেছে। আমরা জানি ইশ ব্যাট হাতে কতটা ভালো। আমার মনে হয় পুরোটা সময় লড়াই চালিয়ে যাব। কাল খুব আকর্ষণীয় দিন হতে যাচ্ছে। আমরা ঘুরে দাঁড়িয়ে লড়াই চালাব, দেখা যাক কি হয়।’ এই অসম্ভব কাজটা যদি সত্য করতে পারে কিউইরা তাহলে ক্রিকেট ইতিহাসই পাল্টে যাবে। কিন্তু সেটা কি হতে দেবে ঐতিহাসিক এক জয়ের মোক্ষম সুযোগ পাওয়া বাংলাদেশ দল? ঘরের মাটিতে আগের ৬ টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩টি হেরেছে ও ৩টি ড্র করেছে বাংলাদেশ। সবমিলিয়ে তাদের বিপক্ষে ১৮ টেস্টে জয় একটিই- গত বছর মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে। এবার সেই স্মৃতি সিলেটে ফেরাতে উন্মুখ হয়েই আজ নামবে টাইগাররা।