কিংবদন্তী ফুটবলার এনায়েত
একজন পরিপূর্ণ ফুটবলার বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন ঠিক তাই। মূল পরিচয় ফরোয়ার্ড হলেও দলের প্রয়োজনে খেলতেন গোলকিপিং বাদে যেকোন পজিশনেই। ছিলেন প্লেমেকার। প্রচুর গোল করলেও সতীর্থদের দিয়েই গোল করিয়ে বেশি চিত্তসুখ অনুভব করতেন। গোলার মতো প্রচণ্ড জোরে শট নিতে পারতেন। একবার তো পোস্টের জালই ছিঁড়ে ফেলেছিলেন! ছিলেন প্রচণ্ড জেদী-মেজাজী-অভিমানী। ফুটবল ক্যারিয়ারের স্বীকৃতি হিসেবে যিনি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির সেরা ফুটবলার এবং ২০০৪ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছিলেন।
গ্রেট এবং কিংবদন্তী ফুটবলার হিসেবে যিনি এদেশের কোটি ফুটবলপ্রেমীদের মধ্যে করে নিয়েছিলেন নিজস্ব স্থান, সেই এনায়েতুর রহমান খান একরাশ ক্ষোভ-অভিমান নিয়ে ১৯৯৪ সালে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। পরে থিতু হন কানাডায়। অভিমান ভুলে ২৭ বছর পর ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর দেশে ফেরেন।
তিন দিন পর ২১ নভেম্বর (শনিবার) রাতে ঢাকা ক্লাবের লাউঞ্জে বসে এনায়েত দীর্ঘ চার ঘণ্টা অপ্রথাগত ইন্টারভিউ দেন দৈনিক জনকণ্ঠকে। একপর্যায়ে তিনি স্বীকার করেন জীবনে কোন সাংবাদিককে তিনি এত সময় দেননি। অন্তরঙ্গ আলাপনে এই প্রখ্যাত ফুটবলার এতটাই আবেগে আপ্লুত হয়েছেন যে বেশ কবার অশ্রু ঝরিয়েছেন, আবার মজা করতে গিয়ে হাসিতে ফেটে পড়েছেন বার বার, মাঝে মাঝেই তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন! আলাপচারিতায় এমন অনেক কথা বলেছেন, যা গত ২৭ বছরে কোন সাংবাদিককে বলেননি! একেবারেই ভিন্ন স্বাদের এই আলাপনে এনায়েত জানিয়েছেন কেন তিনি বাংলাদেশে এসেছেন, জানিয়েছেন নিজের শৈশবের ফুটবল, ক্লাব ও আন্তর্জাতিক ফুটবলের অনেক অজানা কথা। দেশের ফুটবলের সমস্যা-প্রতিকারের উপায়, নিজের নানা স্মরণীয় অভিজ্ঞতা, দেশ ছাড়ার কারণ, ক্ষোভসহ আরও অনেক কথার ঝাঁপি উজার করে দিয়েছেন। জনকণ্ঠ পাঠকদের জন্য সেই অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হলো ...
দীর্ঘ ২৭ বছর পর দেশে ফিরলাম। দেশে নিজের কোন বাড়ি নেই। ইচ্ছে করলেই পরিবার-পরিজনদের বাসায় উঠতে পারতাম। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি এবং অন্য সবকিছু বিবেচনা করেই ঢাকা ক্লাবের গেস্ট হাউসে এসে উঠলাম।আলাপচারিতার শুরুটা এভাবেই করেন সেই এনায়েত, যিনি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ইতিহাসের প্রথম গোলদাতা।
২০২১ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই এনায়েতের বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। কিন্তু নানা ঝামেলায় সেটা পিছিয়ে যায়। দেশের ফুটবলবোদ্ধা থেকে শুরু করে ক্রীড়া সাংবাদিকদের মধ্যে পর্যন্ত এনায়েতের আগমন নিয়ে তীব্র আলোড়ন ওঠে। কারণটা সহজেই অনুমেয়, বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফুটবলারকে দেখতে কে না চায়। এজন্যই এনায়েত ঢাকায় আসতেই তাকে দেখতে আসছেন সবাই। এসব দেখে বিস্ময়ে বিমুগ্ধ এনায়েত, কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম আমাকে দেখতে একটু লোকজন আসবে। কিন্তু এত বেশি আসছে যে, আমার ধারণা পাল্টে গেছে। মিডিয়াতেও আমার আসার খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে। এটাই হয়তো কারণ (এনায়েতের আসার আগেই জনকণ্ঠতে ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়)। এটা জেনেছি মোহনের (ব্রিজ ফেডারেশনের সভাপতি মুশফিকুর রহমান মোহন) কাছ থেকে। আমাকে কানাডা থেকে বাংলাদেশে আনানোর বেসিক্যালি উদ্যোগটা মোহনেরই। তার প্ররোচনায় বাংলাদেশে এসেছি। সে আমার আত্মীয় নয়, কিন্তু আত্মীয়ের চেয়েও বেশি! তার সঙ্গে আমার পারিবারিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। মোহন বিয়ে করেছে আমাদের গাজীপুরে। তার স্ত্রী আমাকে ভাই ডাকে। ফলে সে হয়ে যায় আমার বোনের জামাই! হা হা হা!
বহু বছর আগে ঢাকাতেই মোহনের সঙ্গে পরিচয় ব্রিজ খেলতে গিয়ে। এনায়েত বলেন, অনেকেই জানে না, আমি খুব ভালো ব্রিজ খেলোয়াড়। ব্রিজ এমন একটা বৈচিত্র্যপূর্ণ খেলা, যে এটা না খেলেছে, সে তা বুঝতে পারবে না। আপনি মুক্তিযোদ্ধা, দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আপনার অবদান আছে, অথচ গেজেটে আপনার নাম নেই ... এটা মেনে নেয়া যায় না, আপনি না চান, কিন্তু জাতির তো আপনার নাম জানার দরকার আছে, পরবর্তী প্রজন্মের তো আপনার কথা জানার অধিকার আছে, আপনার সন্তানদেরও তো জানার দরকার আছে ... এসব বলেই মোহন আমাকে প্রভাবিত করেছে দেশে আসতে।
এনয়েত স্মরণ করেন একসময়কার অনুজ সতীর্থকে, বাদল (প্রয়াত ফুটবলার বাদল রায়) যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে আমি দেশে আসলে ও তো আমার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তো। তবে সমপরিমাণ আগ্রহ নিয়ে দেশে ফেরার বিষয়টা নিয়ে যখন গাফফারের (সাবেক ফুটবলার আবদুল গাফফার) সঙ্গে আলোচনা করলাম, তখনও সে-ও আমাকে অনেক উৎসাহিত করলো। তখন তান্নাকে (স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের ম্যানেজার তানভীর মাজহার তান্না) করলাম টেলিফোন, দোস্ত, ঢাকায় আসতে চাই। তান্না বললো, আমার বাসায় ওঠ। আমি মানা করলে তান্না পরামর্শ দিল, তাহলে ঢাকা ক্লাবে ওঠ।
ঢাকায় আসার পর মানুষজনের তার প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখার পর এনায়েতের ভাষ্য, তাতে বুঝলাম তারা আমাকে এখনও মনে রেখেছে। কেন মনে রেখেছে জানি না।এনায়েত হঠাৎই দুষলেন মিডিয়াকে, এখানে আসার পর অনেক পত্রিকা আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। কিন্তু সবগুলোতেই দেখেছি যেসব কথা বলেছি, সেগুলো সেভাবে ছাপা হয় না। দ্যাটস নট এ গুড সাইন। সাংবাদিকরা তাদের মতো করে প্রশ্ন করবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি তাদের মতো করে উত্তর দেব কেন? আমি তো আমার মতো উত্তর দেব। সেটা দিই না বলেই হয়তো এই সমস্যা!
একটা ব্যাপারে বেশ বিরক্তই হয়েছেন এনায়েত, সবাই আমাকে বারবার একটাই প্রশ্ন করেছে, কাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে আমার তুলনা নিয়ে। আমি বলেছি, আমি আমার খেলা খেলেছি, সে তারটা খেলেছে। কে বেশি গ্রেট ফুটবলার, সেটা তো জানি না। শুনেছি কোন এক জরিপে সালাউদ্দিন নাকি বাংলাদেশের সেরা ফুটবলার হয়েছে ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে। আমি সেখানে দ্বিতীয় ২৫ শতাংশ ভোট পেয়েছি। এটা তো অস্বীকার করতে পারি না। সে অনেক বড় ফুটবলার। আমিও চেষ্টা করেছি তার মতো হতে, পারিনি। এখন যদি বলি আমিই সেরা, তাহলে তো এটা ছাগলামি ছাড়া কিছুই না!
প্রবাস জীবনে কখনই দেশের ফুটবলের খোঁজ-খবর রাখতেন না বলে জানান এনায়েত। এমনকি বাংলাদেশের কোন খেলাও দেখেননি।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে নিজেকে নিয়ে নিজেই যেন ব্যঙ্গ করেন এনায়েত, বড় খেলোয়াড়রা নাকি ঘুমের মধ্যে ফুটবল খেলতে গিয়ে লাথি মারে। কিন্তু আমার কখনও এমন হয়নি। সেই অর্থে আমি তো বড় ফুটবলার নই! আরও বলেন, আমি হচ্ছি এই জাতির ফুটবল ইতিহাসে “ধাক্কার বা ব্যাকিং প্লেয়ার। ব্যাখ্যা করি। বাহাত্তরে বরদুলই ট্রফির জন্য ঘোষিত ঢাকা একাদশ দলে আমার নাম ছিল না। ঢাকা একাদশ ফাইনালে উঠলো। কিন্তু টিম ম্যানেজমেন্ট যখন বুঝলো ফাইনালে তারা টিকতে পারবে না, তখন ঢাকায় টেলেক্স পাঠালো, এনায়েতকে পাঠাও।আমার কাছে যখন খবর নিয়ে আসলো, তখন বলে দিলাম, শরীর খারাপ, খেলতে পারবো না। তিয়াত্তরে প্রথম আন্তর্জাতিক আসর মারদেকা কাপে অংশ নিতে ৪০ জনকে জাতীয় দলের প্রাথমিক দলে ডাকা হলো। তার মধ্যে ফরোয়ার্ডই ১৯ জন। অথচ টপ ফর্মের আমি সেই দলেই নেই! খবর পেলাম নির্বাচকদের একজন এর নেপথ্যে। তার নাম বলতে চাই না, মারা গেছেন। কি দরকার! যাহোক, তিন দিন পর ফাইনাল টিম সিলেকশন। তখন শেষ মুহূর্তে আমাকে ধাক্কা দিলেন পল্টু ভাই (প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও ক্রীড়া সংগঠক মোজাফফর হোসেন পল্টু)। তার হস্তক্ষেপে দলে ঢুকলাম। তাহলে বলুন আমি কি ধাক্কার প্লেয়ার নই?
মুক্তিযুদ্ধের সনদপত্র নিতেই মূলত বাংলাদেশে এসেছেন এনায়েত। এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ফুটবল খেলেছে, এটা পৃথিবীর ইতিহাসে অত্যন্ত বিচিত্র ও বিস্ময়কর ঘটনা। আর সেটার অংশ আমি, অথচ কোন অবস্থান নেই। তাই মোহনের প্ররোচনাতেই নিজের অবস্থান গড়ে নিতেই এসেছি। কি জানি, হয়তো দেখা গেল, গেজেটে নাম না থাকায় হয়তো আমাকে সনদ দেয়াই হবে না! আমি জানি, আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি, কিন্ত এটা এখন প্রমাণ কিভাবে করবো জানি না। হয়তো মোহন-গাফফাররাই এ ব্যাপারে হেল্প করবে।
আলাপনে সাইদুর রহমান প্যাটেলের নাম ওঠায় তেলে-বেগুণে জ্বলে ওঠেন এনায়েত, প্যাটেল কিভাবে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রস্তাবক হয়? সে তো আমাদের অনেক জুনিয়র। এটা তো ইতিহাস বিকৃতি! এই দলের মূল উদ্যোক্তা লুৎফর রহমান (গেন্ডারিয়া নিবাসী), মজিবুর রহমান এবং মোহসিন আলী (ট্রেজারার)। কিন্তু এটাকে ফর্মেশন করেছে প্রবাসী সরকার। প্যাটেল কিছুদিন দলের সঙ্গে থেকে ফিরে যায়। কেন, তা জানি না। তখনকার ১৮-২০ বছরের ছেলে কিভাবে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রস্তাবক বা উদ্যোক্তা হয়, তা আমার বুঝে আসে না!
এনায়েত যখন বিদেশ চলে যান, তখনও দেশের ফুটবলের অবস্থা ভাল ছিল। আর এখন তো দুরবস্থার একশেষ। এ প্রসঙ্গে বলার অনুরোধ জানালে শুরুতে স্রেফ মানা করে দিলেন এনায়েত। কিন্তু একটু পরেই বললেন, যারা এটা পরিচালনা করে, তারাই এটা ভাল বলতে পারবে কেন অবস্থা খারাপ। এমন হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাই না। এখনও যদি জরিপ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যুবকদের ৬০-৭০ শতাংশই ফুটবলকে ভালবাসে। ফুটবলের যে ক্রেজ এখনও আছে, তাতে এত তাড়াতাড়ি মাত্র ৫০ বছরে তো নিচে নামার কথা না, বরং ৫০ বছর লাগবে এই ক্রেজ থেকে বের হয়ে আসতে। সেই ফুটবলপাগল জাতির ফুটবলে ডেভেলপমেন্ট কেন হয়নি, সেটা ফুটবল যারা পরিচালনা করে, তারাই বলতে পারবে। আমি কিভাবে বলবো, যেখানে ২৭ বছর ধরে বিদেশ থাকি।
তীব্র আবেগী কণ্ঠে এনায়েত বলেন, অনেকেই বলে এদেশের তরুণ প্রজন্ম নাকি ফুটবলবিমুখ। কিন্তু আপনাদের কাছেই শুনেছি তারা নাকি রাত জেগে ইউরোপিয়ান ফুটবল দেখে, বিশ্বকাপের সময় মাতামাতি করে, এত মাতামাতি তো বিশ্বকাপে খেলা সেসব দেশের সমর্থকরাও করে না। এটা তো গল্প নয়, বাস্তবতা। তাহলে এ জাতি কিভাবে ফুটবলবিমুখ হলো? তারা তো ফুটবলের সঙ্গেই আছে। ভুল কথা তাহলে। এটা আমার-আপনার ভুল। ফুটবলের ভুল না। তরুণরা ফুটবলের সঙ্গেই আছে। কেবল অন্য জায়গায় তারা ফুটবলটা দেখছে আর স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখে না। যারা ফুটবল চালায়, তাদের খুঁজে বের করা উচিত কেন এমনটা হচ্ছে? এখন যদি এটা না পারে, তাহলে সেটা তো তাদের ব্যর্থতা, জাতির ব্যর্থতা না। জাতির ব্যর্থতা এত সোজা না। জাতি কোন না কোনভাবে ... (কথা থামিয়ে ফুঁপিয়ে কাদঁলেন অনেকক্ষণ) কি আর বলবো!
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলেন, আমাদের সময় ফুটবলের প্রকৃতি যেমনটা ছিল, এখন আর তেমনটা নেই। আপনার অবশ্যই পরিকল্পনা থাকতে হবে। সেই সঙ্গে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি জোর দিতে হবে শিশুদের ফুটবল নিয়ে। অগ্রসর হতে হবে যোগ্যতার প্রেক্ষিতে।
মাশরাফি সারা ক্রিকেট দুনিয়ার সেরা অধিনায়কদের একজন, সাকিব বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার। তারা তো বাংলাদেশের। তারা যদি সেরা হতে পারে, তাহলে ফুটবলে কেন হতে পারবে না? যদিও ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখনও সেরকম আহামরি সাফল্য পায়নি। জরিপ করে দেখেন, এদেশের ক্রিকেট ফ্যানদের সংখ্যা ৩০ ভাগও হবে না! যদি হয়, তাহলে আমাকে বলবেন।চ্যালেঞ্জ করেন এনায়েত।
যদি জাতীয় বা ক্লাব থেকে এনায়েতকে যেকোন ভূমিকায় ফুটবলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবার প্রস্তাব দেয়া হয়? যার যোগ্যতা আছে তাকেই প্রস্তাব দেয়া উচিত। আমি বিদেশে অবসর জীবন যাপন করি। বয়সও হয়ে গেছে ৭০। নিজেই জানি না আমার কতটা যোগ্যতা আছে।এনায়েতের জবাব।
যখন ফুটবলার ছিলেন, তখন ঢাকার মাঠে খেলতে গিয়ে (মোহামেডান-ভিক্টোরিয়া ম্যাচে) প্রখ্যাত রেফারি দলিল খানকে মেরে অজ্ঞান করে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন এনায়েত। পরিণামে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন বাফুফে কৃর্তক। পরে সমর্থকদের তীব্র আপত্তির মুখে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারও করা হয়। মজার ব্যাপার-দলিল খান ছিলেন এনায়েতের আত্মীয়, দূর সম্পর্কের চাচা! সেই ঘটনা মনে করিয়ে দিলে এনায়েতের ভাষ্য, খেলার মাঠে তিনি আমার আত্মীয় নন। ওই ম্যাচে ১৪ মিনিটের মধ্যে আমাকে ১৮ বার ফাউল করা হয়। পেনাল্টি বক্সের ভেতরে ফাউল করলে পড়ে যাই। তখন রেফারি বলেন, আমি নাকি পেনাল্টি পেতে এ্যাডভান্টেজ নিচ্ছি! এই প্রেক্ষিতেই উত্তেজিত হয়ে যা করেছিলাম, তা পৃথিবীর সমস্ত প্লেয়াররাই করে।
হঠাৎই আবার উত্তেজিত হয়ে পড়েন এনায়েত, কিন্তু আমার এসব গল্প তো এদেশের ফুটবলের কোন উপকারে আসবে না। ফুটবলের দুর্দশায় এগুলোর প্রয়োজন নেই। আমি তো নিজের প্রচারণার জন্য আসিনি। তবে হ্যাঁ, এখানে এসে মানুষদের যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা ভুলবো না (আবেগে আবারও কান্না)!
কিন্তু আপনার কথা তো এ প্রজন্ম জানে না। আপনার গল্প শুনলে তারা অনুপ্রাণিত হবে, ফুটবলের প্রতি আগ্রহী হবে ... এ কথা শুনে আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললেন এনায়েত।
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রথম ম্যাচ ছিল ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই। ভেন্যু ভারতের কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম। প্রতিপক্ষ নদীয়া একাদশ। সেই ম্যাচের স্মৃতিচারণ করেন এনায়েত, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টি করাই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। সেদিন ম্যাচটা খেলতে আমরা অনেক বাধাগ্রস্ত হয়েছিলাম। ম্যাচটা আদৌ হবে কি না, বাংলাদেশের পতাকা উঠবে কি না, এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম। এ নিয়ে অনেক সময় ব্যয় হয়। শেষ পর্যন্ত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আমরা মাঠের বাইরের এই লড়াইয়ে জয়ী হই। আমাদের পতাকা ওড়ানোর অনুমতি দেয়া হয়। খেলাও শুরু হয়। তবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বেজেছিল কি না, সেটা এখন আর স্মৃতিতে নেই। এটা আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখবেন। ম্যাচটা ২-২ গোলে ড্র হয়। শাহজাহান ভাই প্রথম গোলটি করেন। দ্বিতীয় গোলটা করি আমি। কিন্তু কিছু পত্রিকা লিখেছে প্রথম গোলটি নাকি আমার! এটা ভুল। খেলার রেজাল্টের চেয়ে বড় ছিল আমাদের দেশের পতাকা ওড়ানো, বাংলাদেশের নাম, মুক্তিযুদ্ধের কথা সবার কাছে পৌঁছে দেয়া। একটা দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে ফুটবল জড়িত ... এসব বিস্ময়কর ইতিহাস শুধু এদেশের বর্তমান প্রজন্ম নয়, সর্ব প্রজন্মেরই জানা উচিত।
ফুটবলের প্রতি কিভাবে আকৃষ্ট হলেন? এমন প্রশ্নে এনায়েতের সপ্রতিভ জবাব, ছোটবেলায় দেখতাম আমার চারপাশের সবাই ফুটবল খেলছে। যে একটু কম দৌড়াতে পারতো, অকর্মণ্য ও বেক্কল টাইপের ছিল, তাকেই সবাই গোলকিপার বানাতো। আমি ওপরেই খেলতাম। ফুটবলে লাথি মারাটাই ছিল আমার আনন্দ। আমাদের সময় একটা প্রক্রিয়া ছিল ফুটবলার তৈরি করার। সেটা পাড়া ফুটবল, স্কুল ফুটবল, আন্তঃস্কুল ফুটবল, আন্তঃকলেজ ফুটবলের মাধ্যমে। তারপর ধাপে ধাপে জাতীয় পর্যায়।এরপরই কাউকে যেন খোঁচা দিলেন, এগুলো যারা না বোঝে, তারা পৃথিবীর অন্য দেশ থেকে বুদ্ধি নিয়ে এলেও ফুটবলের উন্নয়ন করতে পারবে না!
কোন প্রশ্ন বাদেই নিজ থেকেই এনায়েত দৃঢ়প্রত্যয়ী কণ্ঠে বলেন, একটা খেলোয়াড় যদি তার নিজের জীবনের বিশ্লেষণ করে, সে যদি এটাকে প্রেক্ষাপট হিসেবে দাঁড় করায়, তাহলেই একটা প্রসিকিউর হবে। শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আমাদের দেশে এ পর্যন্ত যত ভালো ফুটবলার এসেছে আগে-পরে, কারোর বাড়ির ৫০০ গজ বেশি দূরে ফুটবল মাঠ ছিল না। এটা হতেই পারে না। এটা প্রমাণ করে দিতে পারি। ভুল হলে আমাকে বলবেন। কারণ সহজলভ্য প্রক্রিয়া না হলে কোন জিনিষের উন্নতি সম্ভব না। বাড়ির ৫০০ গজের মধ্যে মাঠ থাকতে হবে, বাবার সামর্থ্য থাকতে হবে ছেলের জন্য ফুটবল ও বুটের টাকা দেয়ার, একজন সিনিয়র প্লেয়ার জুনিয়রদের ট্রেনিং করাবেন। এসব যখন পরিপূর্ণতা পাবে, তখনই ফুটবল বিকশিত হবে। সমাজের ভেতরে পরিকল্পিত একটা প্রক্রিয়া। এটা একদম সাধারণ কথা। সমস্ত গ্রেট ফুটবলারের জীবনী পড়লে ঠিক সেটাই পাবেন। এগুলো বিশ্লেষণ করলেই ফুটবল কিভাবে এগুবে, সেটা বোঝা যায়। এর জন্য ফিফা-এএফসি থেকে কোচ আনার দরকার নেই। উন্নতির কোন শেষ নেই। ইন্টারনেশন কো-অপারেশনের কোন বিকল্প নেই ফুটবল ডেভেলপমেন্টের ক্ষেত্রে। কিন্তু আমি এসব কথা বললে সাজে না (আবারও কান্না)!
ধাতস্থ হয়েই বললেন, আমি যে ফুটবলটা খেলেছি, সেটা বিশ্লেষণ করলে যেটা পাই, সেই কাজটা করলেই কিন্তু ফুটবলের উন্নয়ন করা যায়। এখন এটার জন্য এএফসির কাছে যদি যাওয়া লাগে, তাহলে সেটা তো মূর্খতা! তবে আমার এসব কথা হয়তো অনেকেরই পছন্দ হবে না। আমার চিন্তা হচ্ছে আমার কাছে অন্যের সাথে নাও মিলতে পারে।
বহু বছর আগে তৎকালীন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী সাদেক হোসেন খোকাকে এনায়েত বলেছিলেন, ফুটবলই পারে দেশের অর্থনীতিকে সাপোর্ট দিতে। এ কথা শুনে খোকা ও তার আশেপাশের সবাই হেসেছিলেন। তারা ভেবেছিলেন, আবোল-তাবোল কথা বলছেন এনায়েত।অথচ বর্তমান ফুটবলবিশ্বের দিকে তাকালেই আমার কথার সতত্যা পাবেন।
আড্ডায় উঠে আসে ফুটবলের বাইরের গল্পও। কাজী সালাউদ্দিন বিটিভিতে প্রচারিত লাইফবয় সাবানের বিজ্ঞাপন করে প্রচুর খ্যাতি পেয়েছিলেন। অনেকেই জানেন না, সেই এ্যাডটি করার কথা ছিল এনায়েতের! তার কাছে প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন এশিয়াটিকের কর্মকর্তারা। সেই অজানা গল্পের স্মৃতিচারণ করেন এনায়েত, আমার কাছে প্রস্তাব নিয়ে এলে তাদের একটা প্রশ্ন করে হতভম্ব করে দিই-আপনাদের বাজেট কত? তারা হয়তো আমাকে পাগল মনে করে এ কথা বলায়। কেননা যেখানে সবাই এ্যাড করতে পারলে বর্তে যায়, সেখানে কি না আমার এমন প্রশ্ন! তারপর দু-চার কথা বলে তারা মানে মানে কেটে পড়ে। আমি এমনই।
প্রবাসে চলে গেলেন কেন? খানিকক্ষণ নীরব রইলেন এনায়েত। যখনই মনে হচ্ছিল এ ব্যাপারে কিছু বলবেন না, তখনই অপ্রত্যাশিতভাবে যে উত্তর দিলেন, তাতে নিজের বহু বছরের আবেগ-ক্ষোভ যেন উগড়ে দিতে চাইলেন, শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম। ওখানে জীবনযাত্রা কঠিন ছিল। তারপর ২০০১ সালে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর সারভাইব করতে কানাডায় পাড়ি জমাই। আর কিছু না হোক, ফুটবলটা তো মোটামুটি ভালই খেলতাম। এমন এক ফুটবলারকে জাতি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে, হোয়াট ইজ দ্য ইমপ্যাক্ট অব দ্যাট? বোঝান আমাকে। হু ইজ এলাউ হিস সান টু গেট ইন টু দ্য ফিল্ড ফর প্লেয়িং ফুটবল? নো ওয়ান। আমাকে যদি স্টার বলেন, তাহলে আমাকে দেশ ছাড়তে হলো কেন? আমি তো শখ করে যাইনি! আমি একজন স্বাধীনতার সৈনিক। পরবর্তী প্রজন্ম যখন দেখবে অমুকের মতো খেলোয়াড় কাজ-কর্ম না পেয়ে বিদেশ গিয়ে কামলাগিরি করেছে, তখন তারা কি ভাববে?
কানাডা পাড়ি জমানোর প্রথম বছরেই ফুটবল-কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন-এমন অজানা গল্পও শোনান এনায়েত, ৬-৭ এবং ৮-৯ এই দুটি এইজ গ্রুপের বাচ্চাদের ফুটবল ট্রেনিং করিয়েছি। একটা টুর্নামেন্টে আমার ওই দুটি দলই রানার্সআপ হয়েছিল। এরপরের কাহিনীটাও শোনান, পরের বছর। ট্রেনিং করাতে যাব। আগের রাতেই হার্ট এ্যাটাক হয়ে গেল! শারীরিক অবস্থার উন্নতি হতে সাত-আট মাস লেগে গেল।
কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মহিলা ফুটবলাররা ছেলেদের চেয়ে বেটার বলে জানান এনায়েত, কারণ কানাডা-আমেরিকার মেয়ে ফুটবলাররা ছেলেদের সঙ্গে অনুশীলন করে।এজন্যই তাদের স্কিল এত ভাল। মহিলা বিশ্বকাপে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র মহিলা দল কয়েকবারের চ্যাম্পিয়ন, সেখানে পুরুষ দল একবারও চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি।
মাঠ মানেই যে স্টেডিয়াম, মাঠ মানেই যে গ্যালারি থাকবে-এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সংগঠক ও ফুটবলের হর্তাকর্তাদের-এমনটাই অভিমত এনায়েতের, ‘মাঠ মানে আমার কাছে ভিন্ন জিনিষ। মাঠ মাঠে চত্ত্বর, মাঠ মানে জমি। মাঠ মানে মাটি। দেশে মাঠের অভাব, ছেলেমেয়েরা খেলতে পারে না ... এসব কথা বিশ্বাস করি না। মাঠ মানেই শহরের ভেতরেই করতে হবে, এমন কোন মানে নেই। শহরের বাইরেই করা হোক, শুধু সেখানে পৌঁছানোর জন্য যোগাযোগের ব্যবস্থাটা ভাল থাকলেই হলো।
এরপর আরও যোগ করেন, আমরা ফুটবল খেলা শুরু করেছি ১২-১৪ বছর বয়সে। কিন্তু এখন সেটা করলে হবে না। খেলাটা শুরু করতে হবে ৫ বছর বয়স থেকে। কারণ পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। প্রসিডিওর একই। কিন্তু ফর্মেশন আলাদা। এটাকে ধারণ করতে হবে ও জানতে হবে।
এনায়েতকে জাতীয় দলে কখনই অধিনায়ক করা হয়নি। অবসর নেয়ার পর জাতীয় দলের কোচ হিসেবেও অফার দেয়া হয়নি। এক্ষেত্রে সেই ধাক্কা পদ্ধতি কাজ করেনি! যদি কোচ-ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দেয়া হতো, তাহলে কি এনায়েত দেশের ফুটবলকে আরও ভাল কিছু উপহার দিতে পারতেন না? প্রশ্নটা থেকেই যায়। তবে এ নিয়ে এনায়েতের হৃদয়ে যে এখনও রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সেটা বোঝা গেল পরিস্কার।
ক্লাব ফুটবলে অবশ্য মোহামেডানে ১৯৮৫ সালে ৭/৮ মাস ও ব্রাদার্সে ১৯৮৭ কোচ হিসেবে কাজ করেছেন মোহামেডানে বেশিদিন কাজ না করার কারণ? ‘মোহামেডানকে যখন প্রিপেয়ার্ড করে যখন রেডি করলাম, তখন আমাকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়, ফলে ক্লাব ছেড়ে চলে আসি।
খেলোয়াড়ী জীবনে প্রচণ্ড মেজাজী-আবেগী ছিলেন এনায়ে(তর ভাষায়, (অসম্ভব রকমের বাজে জেদী লোক!)। যখন যা ভাল মনে করেছেন, তাই করেছেন। পরিণামের কথা ভাবেননি। এ নিয়ে উদাহরণও দিলেন।
সেটা হলো চাকরি ছাড়ার গল্প। অসাধারণ খেলোয়াড়ী দক্ষতার জন্য স্বাধীনতার পর এনায়েতকে নারায়ণগঞ্জের ডকইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ লোভনীয় বেতনে তাদের হয়ে চাকরি করার প্রস্তাব দিল। নিয়ম ছিল সেখানে গিয়ে স্বাক্ষর করতে হবে, তারপর মাস গেলে বেতন। কিন্তু এনায়েত ঢাকায় থাকতেন, সেখানে যেতেন না, শুধু তাদের হয়ে ফুটবল খেলতেন। এনায়েতের মতো সুপারস্টারের জন্যই ডকইয়ার্ড তাদের বেতন দেয়ার সিস্টেম বদলে ফেলে! ১৯৭৮ সাল। ডকইয়ার্ড বনাম আদর্শ কটন মিল ম্যাচ। সেই ম্যাচের দিনে ফিরে যান এনায়েত, মঞ্জু (সাবেক জাতীয় ফুটবলার শামমুল আলম মঞ্জু) যেদিন আমাদের হয়ে ম্যাচটা খেলতে মাঠে যায়নি। কেন যায়নি, সেটা বুঝলাম পরে। সেই ম্যাচ কটন মিলের হয়ে লেফট উইঙ্গার হিসেবে খেলে চুন্নু (সাবেক তারকা ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু)। নেমেই সে কি যে বাওতি (ডজ) দিল, দুই গোল করে ফেললো অল্প সময়েই। আমি তো হার মানতে রাজী নই। চুন্নুকে রুখতে ডিফেন্সে চলে গেলাম। তাকে আর গোল করতে দিলাম না ঠিকই, কিন্তু তাকে আটকাতে গিয়ে আমার জান শেষ হয়ে গেল! ম্যাচে আমরা হেরে গেলাম।আমিও ডকইয়ার্ডের চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। কর্তৃপক্ষ অবাক। বললো, এক ম্যাচ হেরেছেন বলে এতে চাকরি ছাড়ার কি আছে? বললাম, আমাকে চাকরি দিয়েছেন জেতার জন্য, হারার জন্য নয়। যেহেতু হেরেছি, তাই আমার কোন অধিকার নেই সেই চাকরি করার। কর্তৃপক্ষ আমার হাতে পায়ে ধরেও ধরে রাখতে পারেনি। শেষে এটাও বললো, আপনার খেলতে হবে না, কিন্তু চাকরিটা করেন, বেতন নেন। কিন্তু আমি শুনলে তো!
খেলোয়াড়ী জীবনের শুরুতে যে খেলোয়াড়ের নৈপুণ্য দেখে এনায়েত বিস্ময়ে বিমোহিত হয়েছেন, তার গল্পটাও শোনা যাক, আপনারা তো মারীদার (চিহ্লা মং চৌধুরী মারী) খেলা দেখেননি। আমি দেখেছি। তার সঙ্গে খেলেছি। তিনি এক অবর্ণনীয় জিনিষ ছিলেন। শরীরটা একটু বাঁকিয়ে খেললেই ডজ খেয়ে প্রতিপক্ষের দুই-তিন খেলোয়াড় মাটিতে পড়ে যেত! তিনি ছিলেন ম্যাজিক। একটা ম্যাচে আমি তার প্রতিপক্ষ। তিনি তখন বুড়ো বয়সী। বল পায়ে এমনই ডজ ও টার্ন দিলেন, আমার দলের (ইস্ট পাকিস্তান গভর্নমেন্ট প্রেস) দুই ডিফেন্ডার একেবারে কাত! তারপর বক্সের ভেতরে ঢুকে দুর্দান্ত গোল। এরপর একই স্টাইলে করেন আরেকটি গোল। ওই সময়েই তার পায়ে ছিল ম্যারাডোনা-মেসির মতোই পায়ের অপূর্ব কারুকাজ! মারীদার গোল দুটি দেখে মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে গেল। হার জিনিষটা ভীষণ অপছন্দ করি। সেটা অনুশীলন বা ম্যাচ যেটাই হোক না কেন। উপায় না দেখে নিজেই ডিফেন্সে চলে এলাম। উদ্দেশ্য-মারীদার হ্যাটট্রিক আটকানো। মারীদাকে সামাল দিয়ে হ্যাটট্রিক আটকালাম।
এনায়েত ছিলেন সময়ের আগেই জন্মানো ফুটবলার। মাঠে ও মাঠের বাইরে এমন কিছু কীর্তি করেছেন, যেগুলো অনেক পরে বিশ্বের অন্য ফুটবলাররা করেছেন! নব্বই দশকে ইংল্যান্ডের ডেভিড বেকহ্যাম রেইনবো ফ্রি কিক থেকে গোল করে বিশ্বব্যাপী যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন, সেই ধরনের ফ্রি কিক গোল ১৯৭৩ সালেই করে দেখিয়েছিলেন এনায়েত, তাও আবার তখনকার সেরা গোলরক্ষক শহীদুর রহমান চৌধুরী সান্টুর বিরুদ্ধে (বিজেএমসি বনাম ওয়ান্ডারার্স লিগ ম্যাচে)। অথচ এমন বিস্ময়কর-নয়নাভিরাম গোলের বর্ণনা পরদিন পত্রিকার খেলার পাতায় কি না লেখা হলো অতি সাদামাটাভাবে! এ নিয়ে ক্ষোভের শেষ নেই এনায়েতের, ধিক্কার দেই সাংবাদিকতার! কিছুদিন পরেই বিজেএমসি বনাম ওয়ারি ম্যাচ। সুপার লিগে কোয়ালিফাই করতে হলে কমপক্ষে তিন গোল করে জিততেই হবে। দুই গোল করে ফেলেছে এনায়েতের দল বিজেএমসি। তৃতীয় গোলও করে ফেললো তারা। এনায়েতই করলেন। কিভাবে? আমি অনেকটা দিব্যদৃষ্টিতে ম্যাচের গতি-প্রকৃতি বুঝতে পারতাম। ফলে ম্যাচটা সহজে ছাড়তে চাইতাম না। ফলে গোল করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতাম।স্ট্রাইকার হলেও অনেকটা পেছন থেকেই খেলা শুরু করতাম। নিজেদের বক্সের দুই-তিন গজ দূর থেকে একটা পাস পেলাম। বলটা নিয়ে টার্ন করলাম। সামনে এগুতেই দেখি প্রতিপক্ষের তিন খেলোয়াড় বাধা দিতে দাঁড়িয়ে। বল নিয়ে একটা চক্কর দিলাম। বহু বছর পরে জেনেছি, এটা একটা রাউন্ড টেকনিক। জার্মানির বেকেনবাওয়ার নাকি এই স্টাইলে খেলতেন। এটাকে বলে বেকেনবাওয়ার টার্নিং। সবাই জানে তিনি ডিফেন্ডার। কিন্তু অনেকেই এটা জানে না যে তিনি খেলা শুরু করেন ফরোয়ার্ড হিসেবে। পরে হন মিডফিল্ডার। তারও পরে ডিফেন্ডার। এই টেকনিক পরে জিদানও করেছেন। যাহোক, গোলের প্রসঙ্গে আসি। বল নিয়ে রাউন্ড দিতেই দুই প্লেয়ার আমার পেছনে চলে আসে। সামনে রয়ে যায় একজন। তাকে পাশ কাটাতে কোন সমস্যাই হলো না। পরে একে একে চতুর্থ ও পঞ্চমজনকে কাটালাম। এক ডিফেন্ডার এল, তাকেও কাটালাম। গেল ছয়। সপ্তমজন গোলকিপার। সে এগিয়ে এলে তাকেও ড্রিবল করলাম। তখন দুজন দুই পোস্টের দুই পাশে গিয়ে পজিশন নিল গোল আটকাবার। কিন্তু আমার গোল করতে কোন অসুবিধে হলো না।
সাতজনকে কাটিয়ে এনায়েতের এমন গোলের বর্ণনা শুনে পাঠকদের নিশ্চয়ই একজনের কথা মনে পড়ছে? হ্যাঁ, ১৯৮৬ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের পক্ষে ছয়জনকে কাটিয়ে অনেকটা এভাবেই অবিস্মরণীয় গোল করেছিলেন আর্জেন্টিনার ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তার চেয়ে একজনকে বেশি কাটিয়ে এবং কমপক্ষে ১০ গজ বেশি পেছন থেকে ড্রিবল করেছিলেন এনায়েত! অথচ পরের দিনের পত্রিকায় সেই গোলের বর্ণনা পড়ে পাঠকের বোঝার কোন উপায়ই নেই গোলটা কিভাবে করলেন এনায়েত! বরং ম্যাচ রিপোর্টে এনায়েতকে সেলফিশ প্লেয়ার হিসেবে আখ্যায়িত করা হতো! অথচ এমন গোল আরও আছে এনায়েতের।
সময়ের আগে আরেকটা কাজ করেছেন এনায়েত। ১৯৭৭ সালে এক সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেন, বড় খেলোয়াড় হতে কী কী গুণ লাগে? বাংলাদেশের ফুটবলাররা চারটি এস-এর কথা জানে। সেগুলো হচ্ছে : স্ট্রেন্থ, স্ট্যামিনা, স্কিল ও স্পিড। এনায়েত এগুলো না বলে নতুনভাবে যে উত্তর দেন, সেটা ওই সাংবাদিক কখনো শোনেননি, ইউ মাস্ট হ্যাভ এ হায়ার ডিটারমিনেশন, হায়ার স্কিল এ্যান্ড দ্য পারসেপশন। এগুলো হায়েস্ট লেভেলে থাকতে হবে।ছাপা হবার পর এ নিয়ে সাংবাদিকরা এনায়েতকে ঠাট্টা করতেন, টিটকারি মারতেন! অথচ ১৯৮০ সালে এক সাক্ষাতকারে এনায়েতের মতোই হুবহু উত্তর দেন ফ্রান্সের কিংবদন্তী ফুটবলার মিশেল প্লাতিনি!
ঢাকা লিগে অনেক গোল আছে এনায়েতের।কিন্তু গোলের এ্যাসিস্ট? ‘আমার মতো স্কোরারের পাসে যত গোল হয়েছে, সেটা ওই সময় বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল। আমার টিমের সব ফরোয়ার্ডরাই (মালা, মোসাব্বের, বাদল) সমান হারে গোল করতো। তাদের গোলের ৯০ শতাংশই ছিল আমার এ্যাসিস্ট। বাকি গোলগুলোর জোগানদাতা ছিল পাকিস্তানের আবদুল্লাহ রাহি। আমি গোল করার চেয়ে গোল করাতেই বেশি পছন্দ করতাম। অথচ আবাহনীর সালাউদ্দিন ২০ গোল করলে দলের সেকেন্ড টপ স্কোরারের গোলসংখ্যা হতো ৫টি!
আরেকটা পরিসংখ্যানগত সারপ্রাইজ দেন এনায়েত, আমার ক্যারিয়ারে আনওয়ানটেড গোল মাত্র ৪টি। মানে ওই গোলগুলো করেছি এবং ম্যাচে হেরেছি। আরেকটা মজার তথ্য দিচ্ছি-যে ম্যাচগুলোতে আমার দল ২-০ গোলে জিতেছে, সে ম্যাচগুলোতে দ্বিতীয় গোল কখনই আমি করিনি! কিন্তু প্রথম গোলটি থাকতো আমার। এটা কিভাবে সম্ভব হলো, তা জানি না। কিন্তু হয়ে গেছে, এটা সত্য। তেমনি ১০-০ গোলে জিতেছি, দলের হয় প্রথম গোলটি আমার ছিল, নয়তো গোলই করিনি। এজন্য আমার ক্যারিয়ারে হ্যাটট্রিক খুবই কম, দুই-একটি।
১৯৬৭ সালে দ্বিতীয় বিভাগে ইয়াংমেন্স ফকিরেরপুলের হয়ে এনায়েতের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু। এরপর পর্যায়ক্রমে খেলেন ইস্ট পাকিস্তান গভর্নমেন্ট প্রেস, ভিক্টোরিয়া, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল, বিজেএমসি, ওয়াপদা এবং মোহামেডানে। এনায়েত মোহামেডানে খেলেই বেশি খ্যাতি পেয়েছেন বলে মনে করেন ক্লাবটির সমর্থকরা। কিন্তু এ প্রসঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে মজার কাহিনী শোনান এনায়েত, মোহামেডানে তো বলতে গেলে খেলিইনি! অথচ মানুষ বলে আমি নাকি মোহামেডানের খেলোয়াড়। মাত্র এক বছর সেখানে খেলেছি। তাও যোগ দিই পা ভাঙ্গার পরে! মোহামেডানে একটা গ্রুপ আমাকে নিতে আপত্তি জানালেও আমাকে দলে নিতে আগ্রহ ছিল কোচ আশরাফ আলীর, যিনি নিজেও ছিলেন একসময়ের বিখ্যাত ফুটবলার। পা ভাঙ্গা বলে মোহামেডানে খেলতে আমারও তেমন আগ্রহ ছিল না। এজন্য পারিশ্রমিক দাবি করি এক লাখ টাকা, যা ওই সময়ের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকের রেকর্ড। আগের রেকর্ডটা নান্নু ও সালাউদ্দিনের, যারা তিন মৌসুম খেলার জন্য ৬০ হাজার টাকা করে নিয়েছিল। নিশ্চিত ছিলাম এত টাকা দিতে পারবে না মোহামেডান, কিন্তু তারা রাজি হয়ে গেল। পুরো টাকাটা হাতে পেয়ে এবার পড়লাম বিপদে (হাসি)। টাকা তো পেলাম, কিন্তু ভাঙ্গা পায়ে কিভাবে খেলবো? টাকাটা খরচ না করে রেখে দিলাম। খেলতে না পারলে ফেরত দেব বলে ঠিক করলাম। যাহোক, জোর অনুশীলন শুরু করলাম। প্রথম ম্যাচটা খেলে বুঝতে পারলাম ফিট আছি। সেবার তিন ম্যাচ হাতে রেখেই অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন করালাম মোহামেডানকে। তারপরই লাখ টাকা খরচ করার সুযোগ পেলাম!
ওই লিগে ১৩ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন এনায়েত। এটারও কাহিনী আছে, ১০ গোল করে লিগে যুগ্মভাবে সর্বোচ্চ গোল মোহামেডানের তিন জনের-আমার, মোসাব্বেরের এবং বাদল রায়ের। শেষ ম্যাচ (প্রতিপক্ষ মনে নেই)। মাঠে নামার আগে কোচ আশরাফ বললেন, দুই-একটা গোল-টোল করো। তার কথাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিলাম। তিনটি গোল করলাম। হলাম এককভাবে সর্বোচ্চ গোলদাতা।
খেপ খেলা নিয়েও মজার স্মৃতি আছে এনায়েতের, সতীর্থরা মিরপুর মাঠে প্রচুর খেপ খেলে। তাদের জিগ্যেস করি, তোদের ম্যাচপ্রতি কত করে দেয়। বলে ৫০০ টাকা। এ পর্যন্ত কয়টা ম্যাচ খেলেছিস? জবাবে বলে ৪টা। তাহলে ২০০০ টাকা করে পেয়েছে। আমি জানি, পঞ্চম ম্যাচটাই ফাইনাল এবং আমার কাছে প্রস্তাব আসবে। তখন আমি দলের কর্তাদের বলি, আমাকে ফাইনালের এক ম্যাচ খেলার জন্য ২৫০০ টাকা দিতে হবে। তারা রাজিও হয়। তখন আবার বলি, আমি কিন্তু বাকিতে খেলতে পারবো না। এ কথা বলার কারণ, খেলা শেষে আয়োজকদের অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যেত না! যাহোক ২০০০ টাকা অগ্রিম পেলাম। ফাইনালে প্রতিপক্ষ দলের গোলরক্ষক ছিল সান্টু। তার বিপক্ষে ফ্রি কিক থেকে দারুণভাবে গোল করি এবং আমার দল জিতে যায়। কিন্তু ফাইনাল খেলা শেষ হবার পর উল্লাসরত আয়োজদের কাছে বাকি টাকা চাইলে তারা টাকা না দিয়ে ভেগে যায়! পরে অবশ্য তাদের (বাস ব্যবসায়ী) কাছে বহু বছর পর ওই টাকা উশুল করেছিলাম ভুরিভোজ করার মাধ্যমে! হা হা হা!
ঢাকার কালীগঞ্জে ১৯৫১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এনায়েতের জন্ম। ১৯৭৩ ও ৭৫ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা ফুটবল, ১৯৭৬ সালে থাইল্যান্ডের কিংস কাপ ফুটবল এবং ১৯৭৮ সালে ব্যাংককে এশিয়ান গেমস ফুটবলে অংশ নেয়ার পর আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নেন এনায়েত। ১৯৮৫ সালে মোহামেডানের কোচ ও ম্যানেজার হিসেবে ৭/৮ মাস দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৭ সালে ছিলেন ব্রাদার্স ইউনিয়নের কোচ।
ফুটবলার হিসেবে এনায়েত ছিলেন প্লে-মেকার। খেলতেন মাঠজুড়ে। গোটা দলের চালিকাশক্তি হয়ে উঠতেন। পরিশ্রমী, শক্ত-সামর্থ্য ও লড়াকু এই ফুটবলার বল প্লে করা, প্রয়োজনে মুহূর্তে ড্রিবলিং, ডেড বলে আচমকা শট, বলকে নিয়ন্ত্রণে রেখে বলের যোগান দেয়া এবং দূর থেকে নিপুণ লক্ষ্যভেদী আচমকা শট দিয়ে গোল করার ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতেন। সেই অভিমানী এনায়েতের না-বলা কথাগুলোয় নতুন প্রজন্মের ফুটবলার উপকৃত হবে, উজ্জীবিত হবে, এটাই নিগুঢ় প্রত্যাশা।
রুমেল খান