অনুশীলনে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের ফুটবলাররা
বহুল প্রতীক্ষিত কাতার বিশ্বকাপের ফাইনাল আজ। একদিকে আর্জেন্টিনা অন্যদিকে ফ্রান্স। দীর্ঘ ৩৬ বছরের শিরোপা-খরা ঘুচিয়ে স্বপ্নের বিশ্বকাপ জিততে মরিয়া লিওনেল স্কালোনির দল। আরেকদিকে টানা দুইবার বিশ্বকাপ নিজেদের শোকেসে তুলতে উন্মুখ হয়ে রয়েছে দিদিয়ের দেশমের খেলোয়াড়রা। স্বপ্নের শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় কাতারের লুসাইল স্টেডিয়ামে একে অপরের মুখোমুখি হবে লিওনেল মেসি এবং কিলিয়ান এমবাপের দল।
প্রায় এক মাসের লড়াইয়ের পর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আর্জেন্টিনা আর ইউরোপের প্রতিনিধি হিসেবে ফ্রান্স উঠেছে কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে। বিশ্বমঞ্চের এই মহাযুদ্ধে দুই দলই হট ফেভারিট। ফ্রান্স জিতলে টানা দুই বিশ্বকাপ জয়ের কীর্তির পাশাপাশি গড়বে মোট তিনবার সোনালি ট্রফি উঁচিয়ে ধরার নজির। অন্যদিকে তৃতীয় শিরোপা জয়ের রেকর্ডের পাশাপাশি আর্জেন্টিনার বড় পাওয়া হবে মেসির হাতে বিশ্বকাপের আরাধ্য ট্রফি।
দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। ১৯৭৮ সালে প্রথম। এরপর ১৯৮৬ সালে সর্বশেষ বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পেয়েছিল আলবিসেলেস্তারা। সেবার দেশটির কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনার অসাধারণ নৈপুণ্যে বিশ্বফুটবলের সোনালি ট্রফিতে চুমো একেছিল আর্জেন্টিনা। এরপর কেটে গেছে দীর্ঘ তিন যুগ। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর পূরণ করতে পারেননি কেউ। তবে ২০১৪ বিশ্বকাপে শিরোপা জয়ের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া দলটি এবারও হট ফেভারিটের তকমা গায়ে মেখে কাতারের মিশন শুরু করেছিল।
অথচ গ্রুপ পর্বে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই সৌদি আরবের কাছে হেরে চাপে পড়ে যায় আর্জেন্টিনা। কিন্তু সেই হারের পরই যেন দেখা যায় ভিন্ন এক দলকে। এরপর কোনো ম্যাচে না হেরেই ফাইনালের টিকিট কাটে লিওনেল স্কালোনির দল। টানা পাঁচ ম্যাচ জিতে স্বপ্নের ফাইনালের টিকিট কাটে তারা। তিন বছরের বেশি সময়ে টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে বিশ্বকাপে খেলতে নামে আর্জেন্টিনা। অথচ প্রথম ম্যাচেই বড় অঘটনের শিকার হয় তারা। সৌদি আরবের কাছে ২-১ গোলে হেরে যায় মেসি-আলভারেজরা।
যে কারণে গ্রুপের বাকি দুই ম্যাচ তাই আর্জেন্টিনার জন্য হয়ে ওঠে বাঁচা-মরার লড়াই। যেখানে মেক্সিকো এবং পোল্যান্ডের বিপক্ষে দাপুটে জয়ে শেষ ষোলোতে জায়গা করে নেয় স্কালোনির শিষ্যরা। শেষ ষোলোতে তারা ২-১ গোলে অস্টেলিয়াকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেয়। যেখানে টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে ব্যবধানে হল্যান্ডকে হারিয়ে গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজের বীরত্বে সেমির টিকিট কাটে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। শেষ চারে ক্রোয়েশিয়াকে তো ৩-০ গোলে রীতিমতো উড়িয়েই দেয় মেসি-আলভারেজরা।
এই ম্যাচেও পারফর্মেন্সের ধারাবাহিতা ধরে রাখেন দলের সেরা তারকা লিওনেল মেসি। নিজের পঞ্চম গোল করে স্বদেশী কিংবদন্তি গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে (১০) ছাড়িয়ে আর্জেন্টিনার জার্সিতে বিশ্ব মঞ্চে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড নিজের করে নেন ৩৫ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড। সেইসঙ্গে বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ (২৫) খেলার রেকর্ডে জার্মান কিংবদন্তি লোথার মাথিউসের পাশে বসেন মেসি এলএম টেন। ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষেও নিঃসন্দেহে আর্জেন্টিনার বড় অস্ত্রের নাম মেসি। সেইসঙ্গে আলভারেজও দুর্দান্ত ফর্মে। ফিট হয়ে প্রস্তুত রয়েছেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়াও।
আর্জেন্টিনা প্রথম ম্যাচে হার দিয়ে শুরু করলেও উড়ন্ত সূচনা করে বর্তমান চ্যাম্পিয়নের তকমা গায়ে মাখানো থাকা ফ্রান্স। প্রথম দুই ম্যাচ জিতে সবার আগে শেষ ষোলোতে জায়গা করে নেয় তারা। কিন্তু গ্রুপ পর্বে নিয়মরক্ষার শেষ ম্যাচে তিউনিসিয়ার কাছে হারটা ছিল এবারের বিশ্বকাপের অঘটনগুলোর মধ্যে একটি। এরপর আর পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে হয়নি দেশমের দল। শেষ ষোলোতে পোল্যান্ড, এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ড এবং সেমিফাইনালে মরক্কোকেও রীতিমতো উড়িয়ে দেয় গতবারের চ্যাম্পিয়নরা।
আর্জেন্টিনার মেসি যেমন অতিমানবীয় পারফর্মেন্স করছেন কাতারে। তেমনি ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপেও নজর কেড়েছেন গোটা দুনিয়ার ফুটবলপ্রেমীদের। মেসির মতো তারও কাতার বিশ্বকাপের গোল সমান ৫টি। অন্যদিকে আলভারেজের মতো ফরাসি তারকা অলিভিয়ের জিরুডেরও গোলসংখ্যাও সমান ৪। কাতারে দেশমের দলে দুর্দান্ত ভূমিকা রেখেছেন অ্যান্টনি গ্রিজম্যান। ফাইনালে উঠার পেছনে রয়েছে মাঝমাঠে তার অসাধারণ পারফর্মেন্স। নিজে গোল না করলেও এবার গোল করাতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছেন তিনি। সতীর্থদের দিয়ে তিন গোল করিয়েছেন এবারের বিশ্বকাপে।
তবে মহারণের আগে বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের দুশ্চিন্তা হিসেবে দাঁড়িয়েছে ক্যামেল ভাইরাস। ক্যামেল ভাইরাসে আক্রান্ত আন্দ্রিয়া র্যাবিয়ট, দায়োত উপামেকানো ও কিংসলি কোমানোর মধ্যে শুক্রবার দুজন অনুশীলন করেছেন। কোমান পুরো সুস্থ হননি বলে অনুশীলনে ছিলেন না। তার সঙ্গে অনুশীলনে যোগ দেননি ফ্রান্সের আরও দুই খেলোয়াড়। সূত্রমতে, জানা যায়, রাফায়েল ভারান এবং ইব্রাহিমা কোনাতেও ঝুঁকির মধ্যে। তারা দুজনেই ফ্রান্সের শুরুর একাদশের নিয়মিত সদস্য।
এদিকে ফাইনালের আগে আলোনায় থাকা করিম বেঞ্জেমাকে আজ খেলাবেন কি না দেশম অবশ্য সে ব্যাপারে নিশ্চিত কিছু বলেননি। যদিওবা ফরাসি তারকা অবশ্য ইন্সটাগ্রামে ‘আগ্রহী নই’ পোস্ট করেই ইঙ্গিত দিয়ে দিয়েছেন ভক্ত-অনুরাগীদের। ফ্রান্স-আর্জেন্টিনার মাঠের লড়াইয়ের পাশাপাশি ডাগআউটেও দেখা যাবে দুই কোচের দ্বৈরথ। কেননা স্কালোনি আর দেশম বলে কথা। স্কালোনি যেমন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বদলে দিয়েছে আর্জেন্টিনাকে। কোপা আমেরিকা জয়ের পর টানা ৩৬ ম্যাচে অপরাজিত থাকার কীর্তি। তেমনি দেশমও অপ্রতিরোধ্য! খেলোয়াড় এবং কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের পর এবার টানা দুইবার বিশ্বমঞ্চে শ্রেষ্ঠত্বের প্রদশর্নী। স্বাভাবিকভাবেই ফুটবলপ্রেমীদের বাড়তি আগ্রহ থাকবে আজকের ডাগ আউটে।
বিশ্বকাপে মুখোমুখি লড়াইয়ে এগিয়ে রয়েছে আর্জেন্টিনা। তিনবারের মুখোমুখি লড়াইয়ে আর্জেন্টিনার দুই জয়ের বিপরীতে ফরাসিরা জিতেছে একবার। দুই দলের প্রথম দেখা ১৯৩০ সালে বিশ্ব ফুটবলের প্রথম আসরে। আর দ্বিতীয় দেখা ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপে। দুই আসরেই আলবিসেলেস্তেদের বিপক্ষে ধরাশায়ী হয়েছিল ফরাসিরা। কিন্তু সর্বশেষ রাশিয়া বিশ্বকাপের রাউন্ড অব সিক্সটিনের ম্যাচে ফ্রান্স ৪-৩ গোলে হারায় আর্জেন্টিনাকে। এবার তাই মেসি-মার্টিনেজদের প্রতিশোধ নেওয়ারও হাতছানি। দুই দলের মোট মুখোমুখি লড়াইয়েও পিছিয়ে ফ্রান্স। ১২ দেখায় আর্জেন্টিনা জিতেছে ৬ ম্যাচ আর ফ্রান্স জিতেছে ৩টিতে। বাকি ৩ ম্যাচ ড্র।