ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

টাইগারদের স্মরণীয় জয়

মো. মামুন রশীদ

প্রকাশিত: ২৩:৩১, ২৪ অক্টোবর ২০২২

টাইগারদের স্মরণীয় জয়

ম্যাচসেরা তাসকিনের সঙ্গে সাকিব, সৌম্য ও শান্তর উল্লাস

অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, সমালোচনা, বিতর্কে জর্জরিত দলের বহুল কাক্সিক্ষত জয়। মরুদ্যান পেরিয়ে মহাসাগর সেচে কুড়িয়ে আনা জয়। রত্নের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু করে সর্বশেষ মরুর দেশ আরব আমিরাতে গিয়ে যা পায়নি, সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে যার দেখা মেলেনি তা বাংলাদেশ পেয়েছে ডারউয়েন্ট রিভারের মোহনায়।

অস্ট্রেলিয়ার হোবার্টে বেলেরিভ ওভাল স্টেডিয়ামে ডাচদের ৯ রানে হারিয়ে অষ্টম বিশ্বকাপে শুভ সূচনা করেছে টাইগাররা। এটা বলার উপায় নেই যে, আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশের বিপক্ষে জয় আর এমন কি ব্যাপার? কিন্তু এখানেই থেমে থাকছে না এ জয়ের মাহাত্ম্য। আগের ৭টি টি২০ বিশ্বকাপের  প্রাথমিক পর্বে ৭ জয় পেলেও প্রাথমিক পর্ব পেরোনোর পর অর্থাৎ দ্বিতীয় পর্বে কোন ম্যাচ জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ১৫ বছরের সেই অধরা জয় ধরা দিয়েছে এদিন।

তা এসেছে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের অধীনে তাসকিন আহমেদের বিধ্বংসী ক্যারিয়ারেসরা বোলিংয়ে। প্রথমবার সরাসরি সুপার টুয়েলভ পর্বে খেলতে নেমে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই কেটেছে জয়-খরা। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেও প্রথম টি২০ ম্যাচে নেমে সাফল্য- সবমিলিয়ে হোবার্ট ও বেলেরিভ ওভাল বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অনন্য এক জায়গায় ঠাঁই করে নিয়েছে। তাই অধিনায়ক সাকিবও বলেছেন, এই জয়ের গুরুত্ব অনেক।
হল্যান্ড রীতিমতো উড়ছিল প্রথম রাউন্ডে গতবার সুপার টুয়েলভ খেলা নামিবিয়াকে ও আরব আমিরাতকে হারিয়ে ২০১৪ সালের পর আবার প্রাথমিক রাউন্ড পেরিয়ে। তাদের লক্ষ্যই ছিল সুপার টুয়েলভ পর্বের ২ নম্বর গ্রুপে তুলনামূলক কম শক্তিধর বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়েকে ধরাশায়ী করার। আর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে কখনো টি২০ না খেলা, বিশ্বকাপে ম্যাচে নামার আগে প্রাকৃতিক বৈরিতায় যথেষ্ট অনুশীলন করতে না পারা অপ্রস্তুত বাংলাদেশকে প্রথম ম্যাচে পেয়েই জেতার হুঙ্কার দেয় তারা। টসেও জিতে যায় বেলেরিভ ওভালের মেঘে ঢাকা পরিবেশে।

যথেষ্ট বাতাসের মুভমেন্ট কাজে লাগিয়ে, গতিময় উইকেটে বাংলাদেশকে চেপে ধরতে আগে ব্যাটিংয়ে পাঠায় তারা। কিন্তু এদিন সৌম্য সরকার ও নাজমুল হোসেন শান্ত ওপেনিং জুটিতে গত ৩১ ম্যাচের মধ্যে বাংলাদেশ দলকে সর্বোচ্চ ৪৩ রান এনে দেন ৫ ওভারেই। যদিও সৌম্য ১৪ বলে ১৪ রানে ফিরে যাওয়াতে জুটি ভেঙ্গেছে। পরে ৬ ওভারের পাওয়ার প্লে থেকে ৪৭ রান এলেও সপ্তম ওভারের প্রথম বলে ২০ বলে ৪ চারে ২৫ রান করা শান্তও ফিরে গেছেন। পরবর্তী ৫ ওভারে ১৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের রান তোলার গতি হয়ে যায় মন্থর।
এরপরও আফিফ হোসেন ধ্রুব ২৭ বলে ২ চার, ২ ছক্কায় ৩৮ এবং শেষদিকে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত ১২ বলে ২ চার, ১ ছয়ে অপরাজিত ২০ করলে ৮ উইকেটে ১৪৪ রানের লড়াকু সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ।

জবাবে তাসকিন প্রথম ওভারের প্রথম দুই বলে এবং ১৭তম ওভারের দ্বিতীয় ও চতুর্থ বলে জোড়া আঘাত হেনে ৪ ওভারের বোলিংয়ে মাত্র ২৫ রান খরচায় ৪ উইকেট তুলে নিয়ে ডাচদের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ করেছেন। শুরুতে তাকে দারুণ সঙ্গ দেওয়া হাসান মাহমুদ ৪ ওভারে ১ মেডেনে মাত্র ১৫ রান দিয়ে ২ উইকেট নিয়ে ক্যারিয়ারসেরা বোলিং নৈপুণ্য দেখান। তাসকিন ক্যারিয়ারের সেরা বোলিং করে প্রথমবার ম্যাচ সেরা হন টি২০তে।
ডাচরা ১৫ রানে ৪টি, ১৩ ওভারে ৬৬ রানে ৬টি উইকেট হারিয়ে চরম বিপদে পড়েছিল। পরবর্তী ৭ ওভারে তারা ৪ উইকেট হারিয়ে তুলেছে আরো ৬৯ রান। এর পেছনে মূল ভূমিকা ছিল কলিন অ্যাকারম্যানের প্রথম অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৪৮ বলে ৬ চার, ২ ছয়ে করা ৬২ এবং শেষ ব্যাটার হিসেবে নেমে পল মিকেরেনের ১৪ বলে ৩ চার, ১ ছয়ে ২৪ রান। অথচ বাংলাদেশ শেষ ৫ ওভারে মাত্র ৩৮ রান তুলতে পেরেছে।

স্লগ ওভারে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ে কম রান তোলার সমস্যাটা এখানেই প্রকটভাবে ধরা দিয়েছে এবং তাই রান কম হয়েছে। এই ভেন্যুতে ১৫২ রানের নিচে সংগ্রহ নিয়োজিততে পারেনি কোন দলই। ডাচরা মূলত বড় ধাক্কা খেয়েছে প্রথম ওভার এবং ইনিংসের চতুর্থ ওভারে দুই রানআউটে। এদিন শান্ত ১৩তম ওভারে একটি সহজ ক্যাচ এবং ইয়াসির রাব্বি একটি তুলনামূলক কঠিন ক্যাচ ছেড়েছেন। এছাড়া ফিল্ডিং ছিল দুর্দান্ত।

বিশেষ করে চতুর্থ ওভারে আফিফ ও শান্তর দুটি দুর্দান্ত ফিল্ডিং এবং অতি তৎপরতার থ্রো থেকেই রানআউট পেয়েছে বাংলাদেশ যা ম্যাচটাকে নিজেদের মুঠোর এনে দিয়েছে। বোলাররাও দুর্ধর্ষ বোলিং উপহার দিয়েছেন প্রথম ১৫ ওভার পর্যন্ত। কিন্তু পরে তারা অগোছাল হয়ে গেছেন। ডেথ ওভারে বাংলাদেশের বোলিংয়ের সাম্প্রতিক সময়ে যে দুর্দশা তা এমন বিপর্যস্ত ব্যাটিং লাইনের বিপক্ষেও বাজেভাবে ফুটে উঠেছে।

এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বাঁহাতি স্পিনার এবং অফটাইম অফস্পিনারদের যে কার্যকারিতা নেই সেটাও বোঝা গেছে। এমন ম্যাচে অগোছাল এবং বিশৃঙ্খল লেংন্থে বোলিং করে সাকিব ৪ ওভারে দিয়েছেন ৩২, মোসাদ্দেক দিয়েছেন ১ ওভারে ১৪। তাসকিন প্রথম ২ ওভারে ৪ রান দিলেও পরের ২ ওভারে খরচ করেছেন ২১ রান। এক সময় ডেথ ওভারে বিশ্বের অন্যতম সেরা মুস্তাফিজুর রহমানের বাঁহাতি পেস বোলিং যে নখ-দন্তহীন হয়ে পড়েছে এই ম্যাচেও তার ৪ ওভারে ২০ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকার মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেছে।

আর এই ঘাটতিগুলোর কারণেই মাত্র ৯ রানে জিতেছে বাংলাদেশ। শেষ বল পর্যন্ত লড়াইয়ে থেকে ২০ ওভারে ১৩৫ রানে গুটিয়ে যায় ডাচরা। জিতলেও চার-ছক্কা হাঁকানোয় বাংলাদেশ পিছিয়ে। বাংলাদেশ ৩টি ছয় ও ১০টি চার এবং ডাচরা ৪টি ছয় ও ১১টি চার হাঁকিয়েছে। ডাচরা ৫৭টি ডট বল দিয়েছে আর বাংলাদেশ ডট খেলেছে ৪৭টি। এখানেই হেরে গেছে ডাচরা। জয় দিয়ে বিশ্বকাপ এবং অস্ট্রেলিয়ার বুকে টি২০ শুরু করেছে টাইগাররা।
২০০৭ সালের প্রথম টি২০ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় এক জয় দিয়ে গ্রুপ পর্ব অতিক্রম করে দ্বিতীয় পর্বে (সুপার এইট) উত্তীর্ণ হয় বাংলাদেশ। এরপর ২০০৯, ২০১০ ও ২০১২ সালের গ্রুপ পর্বেও কোন ম্যাচ জিততে পারেনি। ২০১৪, ২০১৬ ও ২০২১ সালে প্রাথমিক রাউন্ড পেরিয়ে যথাক্রমে প্রথম দুইবার সুপার টেন ও সর্বশেষবার  সুপার টুয়েলভ খেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে জিততে পারেনি।

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আগে টি২০ না খেলা, কনকনে শীত ও আবহাওয়ার বৈরিতার মধ্যে উজ্জীবিত ডাচদের বিপক্ষে অনেক শঙ্কা ছিল বাংলাদেশের সাফল্য পাওয়া নিয়ে। কারণ গত বিশ্বকাপের সুপার টুয়েলভ পর্ব থেকে শুরু করে এই ম্যাচটির আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ ২৪ ম্যাচ খেলে মাত্র ৪ জয় পায় বাংলাদেশ আমিরাত, আফগানিস্তান ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। কিন্তু সব শঙ্কাকে পেছনে ফেলে স্বস্তির জয় এবং বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বে প্রথম জয় পেয়েছে বাংলাদেশ ১৫ বছর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে।

আগের ৭ আসরে মাত্র ৭ জয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নেপাল, আফগানিস্তান, ওমান (২ বার), হল্যান্ড ও পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে। এবার বিশ্বকাপের অষ্টম কিন্ত সবচেয়ে প্রতীক্ষিত জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। তাই সাকিব ম্যাচশেষে বলেছেন, ‘এই জয়ের গুরুত্ব অনেক। আমি সব সংস্করণে খেলেছি। কিন্তু জয়ের দেখা পাচ্ছিলাম না। আমরা ১০ রানের মতো কম করেছি। কিন্তু পেস বোলাররা যা করেছে, এক কথায় অসাধারণ। তরুণ দল হিসেবে আমরা সেরা ফিল্ডিং সাইড হতে চাই। এখন আমাদের বিশ্বাস আছে ৫-১০ রান বাঁচাতে পারব, যা বড় ব্যবধান গড়ে দিতে পারে।’ 

×