মালা রাণী সরকার
আমার ৫৬ বছরের দীর্ঘ জীবনে সুখের অুনভূতি মেয়েদের সাফ জয়। পুরো জাতির স্বপ্ন পূরণ করেছে মেয়েরা। সাফ চ্যাম্পিয়নে ১১ জনের যে দল খেলেছে তার ৮ জনেই কলসুন্দর গ্রামের। তাই এই জয়ে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত মালা রাণী সরকার। কারণ কলসিন্দুর নারী ফুটবল টিমের ম্যানেজার হিসেবে নিজ হাতে তাদের গড়ে তুলেছেন তিনি।
যে শামসুন্নহার জুনিয়রের গোলে বাংলাদেশ দল প্রথম এগিয়ে যায় সেই শামসুন্নহারকেও এক বছর খাইয়ে পড়িয়েছেন মালা রাণী। পিতৃহারা অভাব অনটনের সংসারে তাকে তিনি প্রেরণা যুগিয়েছেন একজন ফুটবলার হতে। শুধু শামসুন্নহার জুনিয়রই নন, ওই আটজনের সবাইকেই তিনি সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা বাঁধা বিপত্তির পেরিয়ে দক্ষ ফুটবলার হিসেবে গড়ে তুলেছেন। আজ নিজেকে গর্বিত মনে করছেন এই টিম ম্যানেজার।
তার ভাষ্য, আমার জীবনের সুখের আনন্দের দিন মেয়েদের সাফ জয়। এটা আমার স্বপ্ন ছিল। মেয়েরা একদিন বিশ্বকাপও জিতবে বলে আশা করি। কলসুন্দরের টিম ম্যানেজার হিসেবে আমি গর্বিত। জাতীয় দলের কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটন ভাইকেও অভিনন্দন। আগামীতে ছেলেরাও ভালো করবে। আমি ছেলেদেরও তৈরি করছি।
এই মেয়েদের তৈরি করার পেছনে একটা মানুষের কথা না বললেই নয়, শুভাকাক্ষী হিসেবে আমাকে সব সময় সহযোগিতা করছেন মৌলবী ও জনপ্রতিনিধি আব্দুল কাদের। তিনিও আমার সঙ্গে মেয়েদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়েছেন। এলাকার মানুষদের সচেতন করিয়েছেন।
নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা জিতল বাংলাদেশ। এর ফলে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের শিরোপা জিতল মেয়েরা। ময়মনসিংহের ‘কলসিন্দুর’-এ বেড়ে ওঠা আটজন আছেন এ দলে। নানা প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অবিচল লক্ষ্য, অদম্য মনোবল, প্রবল ইচ্ছাকে সঙ্গী করে তাঁরা পাড়ি দিয়েছেন স্বপ্নপূরণের পথ। এ দলের মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন, শামসুন্নহার সিনিয়র, শামসুন্নাহার জুনিয়র, সাজেদা খাতুন, মার্জিয়া আক্তারের বাড়ি কলসিন্দুরে।
মালা রানী বলেন, এই ফুটবল কন্যাদের তৈরি করতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ২০১১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মাধ্যমে তারা আলোচনায় আসে। এরপর আরও তিনবার চ্যাম্পিয়নের ধারা অব্যাহত রাখে।
তিনি আরও বলেন, এবার গ্রীষ্মকালীন প্রতিযোগিতায় স্কুল-মাদ্রাসা পর্যায়ে কলসুন্দর স্কুল চারবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ছেলে-মেয়ে দুইটি টিমই চ্যাম্পিয়ন হযেছে। দেশের জন্য ছেলেদেরও তৈরি করছে। তারাও ভালো করবে।
কলসিন্দুর হচ্ছে একটা প্রত্যন্ত এলাকা। মেয়েদের কল্যাণে ওই এলাকায় রাস্তাঘাট হয়েছে। এলাকায় এসেছে বিদ্যুৎ। এক সময় মেয়েরা খেলবে তা ছিল কল্পনাতীত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারণা, মেয়েরা মায়ের সঙ্গেই বাড়িতে কাজ করবে। বঙ্গমাতা গোল্ড কাপ প্রতিযোগিতায় মেয়েরা অংশ নেয়। তিনবার জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয় কলসুন্দর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। তখনই আলোচনায় উঠে আসে।
যখন উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলো মেয়েরা তখনই বেশি বাঁধার সম্মুখীন হয়েছে। ওই সময় তারা টিনেজার। তাদের বাবা-মা চায় না খেলুক। তাদের ধারণা, খেললে বিয়ে দিতে পারবে না। মেয়েদের প্রচন্ড ইচ্ছা তার খেলবে। পরে বয়সভিত্তিক খেলায় একের পর এক সফলতা পেয়েছে মেয়েরা। সবাই খুশি। বাংলাদেশের নারী ফুটবল টিম বলতো কলসুন্দকেই বুঝায়।
আমি মেয়েদেরকে বুঝাই, তোমরা খেল, তোমাদের ভবিষ্যৎ ভালো হবে। তাদের পরিবাবকে বুঝাই। আমি সব সময়ই আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছি। প্রাতিষ্ঠানিক সব দায়িত্বই আমি নিয়েছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি ফ্রি করে দিয়েছি। উপবৃত্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
মেয়েদের যেই স্টেডিয়ামেই খেলা হয়, আমি ছুটে যাই। আমি ওদেরকে মানসিক সাপোর্ট দেই। শুধু যে কলসুন্দর মেয়েদেরকে সাপোর্ট দিতাম তা না, পুরো টিমের মেয়েদেরকেই আমি সাপোর্ট দিতাম। যেখানেই খেলা হয় ওদের সঙ্গে আমি সব সময়ই থাকি।
ওদের পারিবারিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এখন তারা সবাই সচ্ছল। তাদের কল্যাণে এলাকার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। মেয়েদের বাবা-মাদের সম্মান করে সবাই। কলসুন্দর হাই স্কুলটিও সরকারিকরণ করা হয়েছে।
সাবিনা খাতুনের মৃত্যুটা আমার কাছে খুব কষ্টের। ওর জ্বর এসেছিল। হাসপাতলে নেয়ার আগে মারা যায় সে। তখন টিমের অন্য মেয়েরা ভেঙে পড়েছিল। তারা আর খেলবে না। আমি ওদেরকে বুঝাই। তোমরা না খেললে সাবিনাকে কেউ মনে রাখবে না।